বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারো শহীদ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারো শহীদদের স্মরণে The Garo Labour Corps Day

তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনথেকে এই বাংলাকে মুক্ত করতে এ বীর সেনারা সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই এই বাংলার মানুষ অর্জন করেছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধিনতা। বাংলাদেশের ইতিহাসথেকে যে ক’জন গারো মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন- হালুয়াঘাট (ময়নসিংহ) উপজেলার বাঘাইতলা গ্রামের শহীদ আরং রিছিল, মনিকুড়া গ্রামের শহীদ পরিমল দ্রং, ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ি গ্রামের শহীদ অনীল সাংমা প্রমূখ। এছাড়াও আরো একজন গারো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম শোনা যায়, তিনি হলেন জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার দিগলাকোনা গ্রামের শহীদ সম্রাট দালবত (সূত্রঃ শফিউদ্দিন তালুকদার, ‘বাংলাদেশের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা’ পৃ-২৯; প্রকাশ- ২০১০, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ)।

কোন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, দেশ মাতৃকার স্বাধিনকল্পে গারোদের বীরত্বগাথা শুধুমাত্র বাংলাদেশ বা ভারতের মাটিতে নয়; বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রয়েছে এমন বীরত্বগাথা। সুদূর ফ্রান্সের মাটিকেও সিক্ত করেছে গারো জাতিসত্ত্বার মানুষ; এ কথা আমরা হয়তো অনেকেই জানি, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানে না, জানার সুযোগও হয়তো পাচ্ছে না। অতীতে গারোদের মধ্যে হয়তো অনেকেই ফ্রান্স গেছেন অথবা অদূর ভবিষ্যতে যাবেন। ফ্রান্সে যাওয়ার সুযোগ হলে অনুগ্রহ করে, গারো জাতিসত্তাকে ভালোবেসে এবং সম্মান প্রদর্শণ পূর্বক অন্তত একবার ফ্রান্সের পেরণ (Péron), আমিয়া (Amia) এবং লংগো (Longou) ঘুরে আসুন আর দেখে আসুন যেখানে গভীর সম্মান নিয়ে শায়িত রয়েছে ৫৫ জন গারো বীরপুরুষ। লেখক লুই চিরান বর্তমানে ফ্রান্সে অবস্থানকালে গ্রন্থে “‍প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারোদের অংশগ্রহণ সম্পর্কীত তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশে উক্ত কবরগুলো পরিদর্শন করেছেন। সুদূর ফ্রান্সের মাটিতে গারোদের কবরে নামের সাথে সাংমা, মারাক, মোমিন, আরেং টাইটেলগুলো দেখে যে কেউই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়বেন; তেমনই গারো, সকলেই নিজ জাতিকে নিয়ে গর্ববোধ করবেন- এটাই স্বাভাবিক। জানা যায়, একসময়ের তুখোড় ছাত্র-যুবনেতা, সাহিত্যানুরাগী ও ভ্রমণবিলাসী রঞ্জিত রুগা নিজেও ফ্রান্স ভ্রমণকালীন সময়ে উক্ত স্থান পরিদর্শনের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত মেজর এ প্লেফেয়ারের ‘The Garos” নামক গ্রন্থে গারোদের সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “ The Garo had the reputation of being headhunters”, অর্থাৎ গারোরা ‘নরমুণ্ড শিকারি’। আসলেই গারোরা নরমুণ্ড শিকারি? না, কারণ, আফ্রিকার আদিবাসিদের মতো গারোদের নরমাংস খায় বা খেতো- এমন কথা আমরা কখনোই শুনি নি। শুধু তাই নয়, প্রায় অর্ধ শতাধিক দেশি-বিদেশি লেখক গবেষকগণ গারোদের নিয়ে লেখা প্রবন্ধ, গবেষণা, ইতিহাস, বইপত্র ঘেটেছি- কিন্তু কোথাও গারোদের নরমাংস ভোজনের ইতিহাস পাওয়া যায়নি বৃটিশ সেনাদের অত্যাচার এবং অন্যান্য জাতিদের আক্রমণের প্রতিবাদে কিছু লোকদের মাথা হয়তো কেটেছে, আগেকার দিনে কোন দাঙ্গায় খুনোখুনি হওয়াটাই স্বাভাবিক; এমনকি বীরত্বের প্রমাণ হিসাবে গণ্য হতো- এটাকেই বৃটিশরা বিশেষ করে মেজর এ প্লেফেয়ার ‘The Garos” গ্রন্থে গারোদের মুণ্ডু শিকারি বলে উল্লেখ করে বসলেন। গারোদের কিংবদন্তী পুরুষ চেল্লা আসানফা ব্রারা নকমা ছিলেন ভুবনবিজয়ী মল্লবীর। তবে, তিনি কখনোই নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন না। তিনি প্রায়ই দিগ্বিজয়ে বের হতেন এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পেলে তাকে মল্লযুদ্ধে আহবান করে পরাস্ত করে তবেই বাড়ি ফিরতেন। অন্যদিকে দিগবিজয়ী না হয়েও প্রখর বুদ্ধিমত্তার জন্য বিখ্যাত ছিলেন গারো লোককাহিনীর কিংবদন্তী নায়ক গাংবো নকমা চিপফু রাজা। তিনি ইর্ষাকাতর নিজ গ্রামবাসীর প্রবল শত্রুতা এবং ষড়যন্ত্র একের পর এক নস্যাত করে দিয়েছেন। স্বীয় বুদ্ধিবলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী এবং শত্রুদের (প্রায়ই পানিতে চুবিয়ে) নাশ করতেন। গাংবো নকমা চিপফু রাজার দেহে ছিলো বিশাল শক্তি এবং তিনি ছিলেন প্রচুর ধনসম্পদের মালিক যুগে যুগে এসব লোককাহিনীগুলোই আদি গারোদেরকে আজীবন সাহস যুগিয়েছে। গারোদের বিশ্বাস, একারণে গারোরাও সাহসের সাথে বিভিন্ন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে জাতিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে।

এবার মূল বিষয়ে আসি- http://hiddenhistorieswwi.ac.uk ওয়েবসাইটে ‘‘The Center for Hidden Histories: Community, Commemoration and the First War” শিরোনামে একটি লেখা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই বৈশ্বিক সংঘাতের কারণে আধুনিক সভ্যতার প্রথম সংস্পর্শে আসার ফলে নাগা, খাসি, গারো এবং লুসাইদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ধীরে ধীরে উদিত হতে শুরু করে”। এই বিষয়টা যথাযোগ্য কাজে লাগিয়ে চতুর বৃটিশ সরকার। এই সময় বৃটিশ সরকার বিভিন্য অঞ্চলথেকে বা জাতিগোষ্ঠিথেকে যোদ্ধা সংগ্রহ করে এবং এই লেবার কর্পসের নামকরণ করা হয়েছিলো তাদের যে সমস্ত এলাকাথেকে আনা হয়েছে সেভাবে; যেমন- গারো লেবার কর্পস, খাসি লেবার কর্পস, লুসাই লেবার কর্পস, মণিপুরি লেবার কর্পস, নাগা লেবার কর্পস এবং চিন লেবার কর্পস (মায়ানমার) ইত্যাদি।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, আজ থেকে ৯৬ বছর আগে ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে) ৬৯ ব্যাচে শ্রমিক কর্পোরেশন কর্তৃক ভারতের পাঁচশত গারোকে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিলো। নিয়োগ প্রদানের উদ্দেশ্য ছিলো, রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগের রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণে সাহায্য করা এবং যুদ্ধাস্ত্র, খাদ্য অন্যান্য সরকারি পণ্য পৌঁছিয়ে দেওয়ার কাজে এদের ব্যবহার করা একারণে বৃটিশ সরকার কৌশল অবলম্বন করে ইউরোপে ২০০০ হাজার গারোদেরকে স্বেচ্ছ্বাসেবক হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রজ্ঞাপন জারীতে বলা হয়েছিলো, ইউরোপে সম্মুখ সমরে যেতে হবে না, তাঁদের সৈনিকদের পেছনে থেকে সহযোগিতা দিতে হবে। এবিষয়ে ভারতের ইতিহাসবিদ শিক্ষাবিদ . মিল্টন এস. সাংমা, তাঁর “The First World War and The Garo Labour Corps” (প্রকাশকালঃ জুলাই, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রন্থে বলেছেন, বৃটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লড়াকু সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ১৮-৩৫ বছর বয়সী সুঠাম শক্তিশালি পুরুষদেরকে বাছাই করে ১২০জন গারো প্রশিক্ষনার্থিদের তুরা ক্যাম্পে একমাস প্রশিক্ষণ দানের পর এদের মধ্যথেকে ৬৯জনকে ফ্রান্সে পাঠানোর উদোগ গ্রহণ করে। সূত্রমতে, গারোসহ ৫০০ জনের একটি দল ফ্রান্সে পাঠানো হলেও শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সে মাত্র ৪৫৬ জনের উপস্থিতি লিপিবদ্ধ করা হয় বলে জানা যায়। বাদবাকী ৪৪ জনের অনেকেই পথিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন এই ৪৫৬ জনের দলকে কয়কটি দলে বিভক্ত করে  ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজ্যে- যেমন, পুঁইসিউ (Puisieux), বক্যোয়্যা (Bocquoy) ল্যা চ্যাপ্লেট (La Chappellette), ব্রুল (Brusle) ইত্যাদি শহরসমূহে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পালন শেষে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই ফ্রান্সের মার্শাই শহরথেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। ‍প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারো যোদ্ধাদের অংশগ্রহণ করে শহীদ হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন . মিল্টন এস. সাংমা, তাঁর “The First World War and The Garo Labour Corps” গ্রন্থে উল্লেখিত বর্ণনা অনুসারে, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট তারিখে ৫০০ জন ভারতীয় নাগরিকের একটি দল ফ্রান্সের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে এবং এই দল ফ্রান্সে ১৯ অক্টোবরে পৌঁছেন। ফ্রান্সে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে বিভিন্ন কারণে অনেক লোক মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে গারো ৩জনআর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (ফ্রান্সে) মোট ৫৫ জন গারো যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন; ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজ্যগুলোতে তাঁদের কবর যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত হয়ে আছে। সম্পর্কে “The First World War and The Garo Labour Corps” গ্রন্থে বলা হয়েছে, “Recruitment's to the 69th Garo Labour corps were done in three centres at Damra in the north, Baghmara in the south and at Tura, during the months of April and May 1917 totalling more than one thousand men. All these recruits were assembled and camped at Tura, than accommodated in the American Baptist Mission Compound in the Hostels and Dormitories through the enthusiastic favour of Rev. F,W Harding. This is clear from the letter of the Assam Government and the Chief Commissioner… (Reference: page 05, 06)”। তিনি গারো যোদ্ধাদের অংশগ্রহণ করে শহীদ হওয়ার বিষয়ে রেফারেন্সসহ লিখেছেন “… only 120 men actually came at Tura. While They were still camping at Tura, one man died, one at Garden Reach, Calcutta, one board the ship at Alexandria and 55 men in France (reference: Garo Readers IV, published Tura Book Room, page 77).”। অন্যদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯১৭ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে, প্রায় সমস্ত লেবার কর্পসকে ছেড়ে দেওয়ার পর অবশিষ্ট ভারতীয় কর্পসকে মোট চারটি কোম্পানিতে পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং এই চারটি কোম্পানি যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল। তাদের মধ্যে একটি ছিল ৮৪তম গারো কোম্পানি অন্যতম। আগের কিছু লোক ফিরে গিয়ে নতুন (৮৪তম) গারো কোম্পানির অংশ গ্রহণ করেছিলো কিনা এব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।

ড. মিল্টন এস. সাংমা’র “The First World War and The Garo Labour Corps” গ্রন্থথেকে প্রাপ্ত ফ্রান্সের পেরণ, আমিয়া এবং লংগো রাজ্যগুলোর বিভিন্ন স্থানে ‍প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৬৯তম গারো লেবার কোম্পানির ৫৫ জন গারো বীর শহীদের তালিকা দেয়া হলো-

১। নাজক সাংমা ২। মানদিং মারাক ৩। চাকরাং মারাক ৪। জিংজা সাংমা ৫। খিউ মারাক ৬। রাচান সাংমা ৭। থরিন সাংমা ৮। তিলক সাংমা ৯। বাংলাসিং গারো ১০। গরান সাংমা ১১। মনসি মমিন ১২। মোহন মারাক ১৩। জইন মারাক ১৪। ‍সন্না সাংমা ১৫। উসানসিং সাংমা ১৬। জিন্না সাংমা ১৭। থেজাং সাংমা ১৮। থিজান মারাক ১৯। চাংরান সাংমা ২০। রিংসা সাংমা ২১। ওয়াজান সাংমা ২২। থিয়ান সাংমা (২৩। পুচিন্দ্র মারাক ২৪। বরুন মারাক ২৫। ‍আদিং সাংমা ২৬। ‍সাংগিন মমিন (২৭। জাকমান সাংমা ২৮। রমন মারাক ২৯। খিনজাং মারাক ৩০। রিংজাং সাংমা ৩১। খুমান সাংমা ৩২। খামিন সাংমা ৩৩। রাখিন মারাক ৩৪। জিতা আরেং ৩৫। পদারসিং সাংমা ৩৬। দমা মমিন ৩৭। বিতাল মমিন ৩৮। আবিং সাংমা ৩৯। অমরসিং সাংমা ৪০। মাদু গারো ৪১। গেন্নিং মারাক ৪২। সিঙ্গারা মারাক ৪৩। জিসাং সাংমা ৪৪। শলমন সাংমা ৪৫। খমপেং গারো ৪৬। জন তারন মারাক ৪৭। ঐজান মারাক ৪৮। সিঙ্গা সাংমা ৪৯। গাজাং সাংমা ৫০। ‍শিবনাথ মারাক ৫১। আদিং সাংমা ৫২। মানজিং সাংমা ৫৩। জেমিং মারাক ৫৪। সাঙ্গিন সাংমা ৫৫। সাইমন সাংমা

ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বীর শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দথেকে প্রতি বছর ১৬ জুলাই “The Garo Labour Corps Day” উদযাপন করে আসছে এবং ১৬ই জুলাইকে “গারো শ্রমিক কর্পস দিবস” হিসাবে মেঘালয় সরকার স্থানীয়ভাবে ছুটি হিসাবে ঘোষণা করেছে। এই লেখার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের গারোরাও গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি বিশ্বযুদ্ধে নিহত বীর শহীদদের প্রতি

সূত্রঃ ১) The First World War and The Garo Labour Corps- . মিল্টন এস. সাংমা

২) The Center for Hidden Histories: Community, Commemoration and the First War-http://hiddenhistorieswwi.ac.uk

৩) Deputy Commissioner - West Garo Hills fb page

৪) গারো সংস্কৃতির মাধুর্য- প্রকাশিতব্য।  

সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২২

গারো সমাজের আদি এবং বর্তমান বিবাহ পদ্ধতি- ০৫

 হিন্দু ধর্মাবলম্বী গারোদের বিবাহ পদ্ধতি 

 

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রকারের বিবাহ পদ্ধতি রয়েছে যেমন, ইত্যাদি তন্মধ্যে প্রজাপত্য বিবাহ পদ্ধতিটিই এখন বেশি প্রচলিত সেধারায় গারো হিন্দুদের মধ্যেও এই প্রজাপত্য বিবাহটাই বেশি হয়ে থাকে বাংলাদেশের গারো হিন্দুদের বিবাহ পদ্ধতিটি নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-

 

)      বিবাহের পূর্ববর্তী ক্রিয়াদি- ছেলে বিবাহের উপযুক্ত হলে ছেলে এবং অভিভাবকের পক্ষে কয়েকজন মিলে মেয়েকে দেখতে যায় মেয়ে দেখে পছন্দ হলে মেয়ে পক্ষও ছেলের সম্পর্কে জানতে এবং ছেলের পারিবারিক অবস্থা আত্মীয়স্বজনদের দেখতে চলে আসে উভয় পক্ষই যদি এই বিবাহতে সম্মতি থাকে তাহলে বিবাহের কাজ যেমন পণ নিয়ে আলোচনা, লগ্ন দেখে বিবাহের তারিখ বা সময় নির্ধারণ এবং বিবাহের যাবতীয় কেনাকাটা হতে থাকে

)     বিবাহের জন্য হবুবরকে সাজিয়ে বিবাহের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে প্রায় ৫০ থেকে ২০০/৩০০ জন পর্যন্ত লোক কনেবাড়িতে যায় কনেপক্ষ তাদেরকে আপ্যায়ণের পর হবুবরের বসার জন্য নির্ধারিত ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেখানেই বরকে বিবাহের পোষাকে পরানো করা হয় এদিকে অন্যঘরে মেয়েকেও বিবাহের পোষাক অলংকারাদি দিয়ে বউ সাজানো হয় আর এরইমধ্যে বিবাহ মণ্ডপের জন্য চারটি কলাগাছে চারকোণায় দিয়ে ফুল, পাতা আল্পনায় সুন্দর করে সাজানো হয়

)     লগ্ন ঘনিয়ে আসলে হবুবরকে ঘরথেকে পিঁড়িতে বসিয়ে বিবাহ মণ্ডপে নিয়ে এসে বরকে মণ্ডপের মাঝখানে দাঁড়ানোর পর হবুবঁধুকেও পিঁড়িতে বসিয়ে দুটো বড় পান দিয়ে মুখ ঢেকে বিবাহ মণ্ডপে আসা হবে এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় শুভদৃষ্টি এসময়ে প্রথমে কনের পিতা বা অভিভাবক বরের হাতে কনেকে সম্প্রদান করেন তারপর নববঁধুর বহনকারীরা বিয়ের পিঁড়িতে বসা অবস্থায় বঁধুকে নিয়ে বরের অর্থাৎ বিবাহ মণ্ডপের চারিদিকে ৭বার প্রদক্ষিণ করবে প্রদক্ষিণ করার সময় প্রত্যেকবারই হবুবঁধু বরের কপালে এবং মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে বরকে বরণ করে নিবে

)      বিবাহ মণ্ডপ প্রদক্ষিন সম্পন্ন হবার পর বর বধূকে মুখোমুখি বসিয়ে দুজনের হাত কাশপাতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হবে, সেসাথে বরের ধূতির সাথে বঁধুর কাপড়ের আঁচলে বেঁধে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হবে তারপর ঠাকুর, বর বধু তিনজন মিলে বিবাহের মন্ত্র পাঠ করতে থাকবেন এবং জলন্ত আগুনের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে বর নিজহাতে বঁধুকে শাঁখা সিঁদুর দান করবে বর বঁধুর বিবাহিত জীবনের মঙ্গল কামনা করে সমবেত জনতার তুমুল করতালি এবং উলুধ্বনির মাধ্যমে প্রথম দিনের মূল বিবাহ অনুষ্ঠান আপাতত এপর্যন্ত

)     পরেরদিন আরও কিছু বিবাহের আচার পালন করতে হয়, যাকে বলা হয় বাসিবিয়া বা বাসি বিবাহ এজন্য বিবাহ মণ্ডপে প্রায় দেড় বর্গফুট পুকুরের মত গর্ত করে সেখানে পানি দেওয়া থাকে বরবধূ দুজনের আংটি খুলে সে পানিতে একেকজন করে লুকাবে এবং কে দ্রুত সেটিকে খুঁজে বের করতে পারে সেটি পরীক্ষা করা হয় কাজটি হয়ে গেলে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বরকে তার নববঁধুর আঁচলে মোট ৭টা পান এবং ৭টা সুপারি কনের আঁচলে বেঁধে দিতে হয় বর নববধূকে কোলে নিয়ে এই লাফ দিয়ে এই পুকুর ডিঙ্গাতে হয় পুকুর ডিঙ্গানোর পর ঠাকুর বরবধূর হাতধরে দুধ ঢেলে মন্ত্র পড়ে দম্পতিকে আশীর্বাদ করেন তারপর বর মণ্ডপে রাখা ঘট বা হাঁড়ি আছড়িয়ে ভেঙ্গে পানি ফেলে দিতে হয় সেখানথেকে কাঁদা তুলে যুবকযুবতীরা পরস্পর মাখামাখি করে আনন্দ করে এরপর কনেপক্ষ সবাইকে বিবাহভোজে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান

)     এবার বঁধুর বিদায়ের পালা এপর্বে আগেই বঁধুর আঁচলে কিছু চাল বেঁধে রাখা হয় বিদায়ের সময় আচলথেকে সে চাল নিয়ে মাথার উপর দিয়ে পেছনে তার মাবাবার উদ্দেশে ছুঁড়ে এই নাও তোমাদের ঋণ শোধ করে গেলাম

)     বরের বাড়িতে উপস্থিত সকলেই উলুধ্বনি দিয়ে ধান দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বঁধুকে বরণ করে নেওয়া হয় এবং সেসাথে আরও কিছু আচারসহ কালরাত্রি পালিত হয় অর্থাৎ এদিন দম্পতিদের বাসরশয্যা নিষিদ্ধ

8)     ফিরাগমনের দিন বরকনে এবং বরপক্ষের লোকজন শ্বশুরবাড়ি যাবে এবং ঐদিনের ভোজের সকল খরচ বরকে দিতে হয় সেখানে আড়াইদিন অতিবাহিত করে বর স্ত্রীকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে

 

গারো মুসলিমদের বিবাহ পদ্ধতি আচার


প্রথমেই বলে নেওয়া প্রয়োজন, গারো নও মুসলিমরা নিজেদের গারো বলে প্রকাশ করতে চান না; বরং বাঙালি হিসাবেই পরিচিত হতে চান আর বৃহত্তর বাঙালি মুসলিমদের মাঝে মিশে যেতে আগ্রহী বলে গারো নও মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিবাহ প্রায় ৯৯% বাঙ্গালি মুসলিমদের সাথে হচ্ছে অবশ্য নও মুসলিমদের নিজ সম্প্রদায়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিবাহ না হওয়ার বড় একটা কারণও রয়েছে; তা হলো- এই গারো সমাজ থেকে বের হয়ে আসা নও মুসলিমরা বাঙালি মুসলিম সমাজের মতো চাচা/কাকাত ভাইবোনের মধ্যে বিবাহকে (গারোদের ভাষায় এইটি মাদং বা বাকদং; দ্রষ্টব্য- মাদং, বাকদং, পৃষ্টা- ) মেনে নিতে পারেন না ফলে বাধ্য হয়েই বাঙালি মুসলিমদের সাথে সম্পর্ক গড় তুলছে সেকারণে এই নবু মুসলিমদের চেহারাতেও প্রায় বাঙ্গালিয়ানা চলে এসেছে গারো সমাজের লোকদের মতোই এই নও মুসলিম পুরুষদের মধ্যে যখন তখন বিভিন্ন অজুহাত/কারণ দেখিয়ে তালাক দিতে বা বহুবিবাহ করতে দেখা যায় না এছাড়াও বৃহত্তর বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রচলিত যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক সম্পদের উপর পুরুষদের একচ্ছত্র অধিকার ইত্যাদি প্রথাগুলো স্বাভাবিকভাবে মানতে পারেন না গারো সমাজথেকে বের হয়ে আসা এই নব্য মুসলিম সমাজ  শুধু তাই নয়, এই নব্য মুসলিমরা মুখে গারো পরিচয় না দিলেও তাদের আচারে এখনও কিছু কিছু গারোত্ববোধ লক্ষণীয় কেননা, এই নব্য মুসলিমরা এখনও বৃহত্তর গারো সমাজে পারিবারিকভাবে নিকটাত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে এখনও নিজগোষ্ঠী বা মাহারিদের বিবাহ বা শ্রাদ্ধতে গারোদের মতোই গিম্মিন/গুম্মুম (শূকরের পরিবর্তে ছাগল) নিয়ে স্বপরিবারে অংশগ্রহণ করেন বলে স্বীকার করেছেন (দ্রষ্টব্যঃ গিম্মিন/গুম্মুম, পৃষ্ঠা...) প্রকারান্তরে, বৃহত্তর গারো সমাজ বা খ্রিষ্টানদের সাথে তাদের কোন প্রকার ক্ষোভ, আক্ষেপ, হিংসা, দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ নেই বলে জানা যায়

 

এবার আসা যাক মূল আলোচনায় গারো মুসলিমদের বিবাহ পদ্ধতি অন্যান্য বাঙালি মুসলিমদের মতোই একারণে নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করছি না সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে এই- প্রথমে ছেলে এবং ছেলেপক্ষের লোক মেয়েকে দেখতে যায়, পছন্দ হলে মেয়ে পক্ষরাও ছেলের বাড়িতে আসে তারপর উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে কাজী ডেকে এনে দেনমোহর ধার্য করে কাবিননামায় স্বাক্ষর প্রদান করতে হয় তারপর উভয় পক্ষ মিলে দিন নির্ধারণ করে বরকনেকে সুরা পাঠ ও মোনাজাত করার মাধ্যমে বর-কনে উভয়কেই স্বামী স্ত্রী হিসাবে স্বীকার (কবুল) করানো হয়। খাওয়া-দাওয়া শেষে নববধূকে নিয়ে বরযাত্রী বরের বাড়িতে চলে আসে অন্যান্য বিবাহ অনুষ্ঠানের মতোই এই নব্য মুসলিমদের অনুষ্ঠানে বৃহত্তর বাঙালি মুসলিমরা নিমন্ত্রিত হন এবং উপহার সামগ্রী প্রদান করে বিবাহভোজে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে প্রচুর আমোদ ফুর্তি করে থাকে এছাড়াও নব্য মুসলিমরা বউভাতের দিনে গারো সমাজ থেকে তাদের নিকটাত্মীয়দের নিমন্ত্রণ দিয়ে থাকে