রবিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১২

বিধানের বিধান! -StorY


বিধানের বিধান!
ফিডেল ডি সাংমা

অন্য সংসারে এর চেয়েও অধিক লোকজন বসাবাস করে। এক ছেলে আর এক মেয়ে হওয়ার পর আর কোন সন্তান নিতে একদম আগ্রহ নেই বিধান চিরানের। একটা বেসরকারী সাহায্য সংস্থায় কাজ করে। বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ সভা পরিচালনা অথবা বক্তব্য উপস্থাপনা সবই করতে হয় বিধানকে। যে কোন উপস্থাপনা কিংবা বক্তব্য ভালই দিতে পারে। অনেক জলন্ত উদাহারণ দিয়ে ভারী গলায় হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য দেওয়ায় বহু প্রশংসা কুড়িয়েছে সে। এইতো সেই কয়েকদিন আগেও সংসার ছোট রাখার বিষয়ে বক্তব্য দিল। তার নিজের ঘর ভরতি ছেলেপেলে থাকবে এমন স্ববিরোধি কথাবার্তা বা কাজকর্ম আর যাই হোক বিধানকে দিয়ে মানায় না। ছোট বেলাথেকে এমনই এক রোখা মানুষ; সে ভাঙ্গবে তবু মচ্‌কাবে না। বাড়ীতে তিনটা শ্যালক বর্তমান। ছোটটা বালক, তার বড়টা ছাত্র আর তার বড়টা ভবঘুরে-বখাটে টাইপের। বিধানের টানা পোড়েনের এই সংসারে অন্ন ধ্বংস করার মত মানুষের অভাব নেই। স্ত্রীর বড় ভাই-বোনের ছেলে মেয়েরা নানী-দাদী বলতে অজ্ঞান। তাদের বাপের বাড়ী কী নানী-দাদীর বাড়ীর মধ্যে ওরা তফাৎ করে না। বিধান মনের দিক থেকে বড় আমুদে আর উদার মনের মানুষ, তাই এতদিন তার কাছে এগুলো আনন্দই দিয়েছে। কিন্তু এই সমাজ, সংসার, স্ত্রী পরিবার নিয়ে আগের সেই উদারতা দেখাবার মত সুযোগ তার আর হয় না। বিষয়টি নিয়ে তার নিজেরই বড় আফসোস হয়। জীবনে কি চেয়ে- কি পেল! তাই এতদিন অনেকবার অনেক কিছু ভেবেছে; কিন্তু তার কোন কূল-কিনারা খুঁজে পায় না সে।


বরাবরের মত সেদিনও বিছানায় সন্তান দুটিকে মাঝখানে রেখে দুজন দুপাশে ঘুমিয়েছে বিধান। অভ্যাসবশত মাঝরাতে উঠে বাইরে বের হবার সময় টর্চ লাইট দিয়ে দুই সন্তানের মুখ দেখে নেয়। কী নির্মল পবিত্র শিশু দুটি। দেখলেই মায়া হয়; আদর করতে, ভালবাসতে ইচ্ছে করে। স্বপ্নবাজ পুরুষ আজীবন সবচেয়ে সুখী মানুষ হওয়ার বাসনা-স্বপ্ন দিনকে দিন দূর্বল হয়ে পড়ছে। কল্পনায় ছেদ পড়ে মেয়ের ডাকে। অনেক্ষণ নড়াচড়া করতে করতে এবার জেগেই গেল। এ মূহুর্তে বাইরে না নিয়ে গেলে বিছানা ভিজিয়ে একাকার করে দেবে। স্ত্রী সীমাকে ডেকে তোলার আগেই তার উদ্দেশ্যে বলে, 'মেয়েটা অনেক্ষণ নড়াচড়া করছে, পুরুষ মানুষ বলে কি মেয়েটাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না? মা হয়েছি বলে আমাকেই কি সব করতে হবে...?' মুখে কোন উত্তর না দিয়ে মেয়েটাকে তুলে নিয়েছিল বিধান। সীমা ইদানিং ঘন ঘন মেজাজ খারাপ করে; রাগারাগী করে। তাকে না হলে সন্তানদের উপর; তা না হলে ছোট ভাইদের উপর। বিধান জানে, মেজাজ খারাপ না হবার কোন উপায় নেই। বড় সংসারের বড় ঝামেলা। তার উপর টাকা-পয়সার দিক দিয়ে এমন টানা-পোড়েন চলছে যে এ নিয়ে অনেকদিন ধরেই মনোমালিন্য চলছে। এইতো আজই স্ত্রীর সাথে সংসার চালানো, সমাজ রক্ষা নিয়ে বাক্‌-বিতন্ডা হল। আচিক্‌ সমাজের চিরদিনের রীতি নক্রম প্রথার এ কী হাল! হারে হারে টের পাচ্ছে বিধান।


টগবগে কৈশর বয়সে মিতা নামের মেয়েটির সাথে ভাব ছিল। তা প্রেম ছিল কিনা- তা বলা মুশকিল। দিনে কমপক্ষে দু'বার দেখা হওয়া চাই-ই চাই। তা না হলে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত, এমন কি পেটুক বিধানের মহা সুস্বাদু খাবারও চিরতার মত অখাদ্য মনে হত। তবে তার সেই মধুর সম্পর্ক কদিনেই ভেঙ্গে গেল। বাবার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে বিধানের একান্ত প্রিয় মানুষটি তার পিসাতো বোনের সাথে বিয়েতে রাজি হল। বিধানের মনে পড়ে- কলেজে পড়ার সময় শরৎ চন্দ্রের লেখা 'বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়..' কথাটি কলেজের বাংলা স্যার এমনভাবে পড়াতেন যেন গল্পটি ঐ স্যারের জন্যই লেখা হয়েছে। শরৎ চন্দ্রের প্রেমও এমনই ছিল কিনা কে জানে! মনে মনে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বিধানের অত্যন্ত আপন মনে হয়। বিধানের বিয়ের প্রায় এক যুগ কেটে গেল। বিয়ে-ঘর-সংসারটাকে বিধানের কাছে কখনও আনন্দ-সুখ, কখনও কঠিন দুঃখের মনে হয়। হয়তবা এ জন্যই কে যেন বলেছিলেন, বিয়ে একটা লাড্ডুর মত, কেউ খেয়ে পস্তায় আর কেউ না খেয়ে পস্তায়। হতভাগা মানুষের আফসোসের কোন সীমা নেই। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বিধান।


একটা সময় ছিল, যখন আদিবাসীদের জীবন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল আদিবাসীদের জীবনে চাওয়া ও পাওয়ার আশা-আকাঙ্খা অত্যন্ত সীমিত এবং একেবারেই সামান্য জীবন সম্পর্কে এদের ধ্যাণ- ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিত্যান্ত সাধারণ। পাহাড়ী অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক। বহু আদিবাসী আজ শিক্ষা লাভের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার জন্য সুস্থ্য স্বাভাবিক মন মানষিকতা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ধর্মান্তরিত হয়ে, কেউবা বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে আবদ্ধ হয়ে এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজেদের আদি কৃষ্টি, সংস্কৃতির অভ্যাসের বলয়থেকে দূরে সরে গিয়ে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। তারপরও গারো মূল্যবোধ আর রীতি নীতি বলে কথা। নিজে গারো হয়ে তার রীতি নীতি বা দাকবেওয়াল অমান্য করবে কি না বুঝে উঠতে পারে না বিধান। নিজের জীবনের করুণ অধ্যায় আর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে নিজের মেয়ে এবং হবু জামাইএর কথা ভাবে। নক্রম কাকে করা যায় কিংবা আদোও নক্রম কাউকে করবে কিনা।


নক্রম প্রথারইবা কি দোষ! বংশধর হিসাবে মামার বংশ মর্যাদা রাখার বিধানতো খারাপ না। কাউকে না কাউকে স্ত্রীর বাবা মার দায়িত্ব নিতেই হবে। তবে নক্রম হয়ে তাকে শশুরের তাবৎ দায়-দায়িত্ব, দেনা পাওনা পরিশোধের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে এবং কোন কোন সময় কোন কারণ-অকারণে ব্যর্থ হলে লোকজনের গালমন্দ, অপবাদ শুনে হজমও করতে হচ্ছে তা প্রহশনের সমত্থল্য। প্রহশন বলা হত না যদি পরিবারের অবস্থা ভাল হত। শশুর জীবিত থাকতেই তারর অবস্থা দেখেছে বিধান। আজ তার চাইতেও করুণ অবস্থা তার। এত বড় সংসারের বোঝা টানতে টানতে কাহিল হয়ে পড়েছে সে, তার উপর আবার সমাজ রক্ষা। প্রতি বছর সামাজিক রক্ষা করতে গিয়ে ৫/৭টি করে শুকড় আর তার জন্য আনুসাঙ্গিক খরচ করতে হয়। বিধানের পক্ষে এ ভারী বোঝা টানা কোন ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। তার স্বল্প আয়ে সংসারের যাবতীয় চাহিদা মিটিয়ে তিনটা শ্যালকের বিয়ে দেওয়া, সমাজের বিয়ে-শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে তার নিজের ছেলে-মেয়ের মানুষ করার খরচের কথা ভাবতেই পারে না বিধান।


দায়িত্ব একটা মহান। যা মহান তাই অত্যন্ত কঠিন বিষয়। দায়িত্ব না-কি ঈশ্বরের কাছথেকে আসে। তাই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করা হয়; তাঁকে আরাধনা করা ব্যর্থ হয়। বিধান ভাবে, তার এমন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে? ঈশ্বর যদি তাকে সংসার ধর্ম করার, নক্রমগিরির গুরু দায়িত্বই দিলেন, তবে সামর্থ দিলেন না কেন? নিজের কিংবা পরের বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে কত কিছুই না চেষ্টা করছে বিধান; কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আসলে বিধানের জন্য বিধাতার পরিকল্পনা কি? আজকাল মানুষের কাছে কোন প্রকার ন্যায় বিচারতো আশাই করা যায় না; সবাই কেমন করে দিন দিন বদলে যাচ্ছে। বিধাতার কাছে ন্যায় বিচারের মানে যে কি, তাই বা কে জানে? বিধাতা কি তার সংবিধানে বিধানের জন্য শুধু কঠিন বিধানই লিখে রেখেছে? কিন্তু সেটাই বা কি? বড় একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে সে.......।


কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গেছে সে। মানক আর জিকচল; একেবার 'জলে কুমিড় ডাঙ্গায় বাঘ' অবস্থা। এমন সংকট অবস্থাথেকে কি ভাবে রক্ষা পাওয়া যায়; এ মূহুর্তে তার কোন কিছুই মাথায় আসছেনা। মানক- জিকচলে রেষারেষি; রীতিমত কঠিন ঝগড়া। শালিস বিচারের দিন তারিখ হয়েছে। মানকের পক্ষে কথা বললে স্ত্রী পক্ষ বেজাড় হবে আবার জিকচল পক্ষ নিলে মানক পক্ষ বেজাড় হবে। গারো জাতির মূল্যবোধ আসলে একটা কঠিন বিষয়। মানুষতো সুখের আশা-ই সংসার পাতে অর্থাৎ কলিকালের ভাষায় সংসারটা নাকি নিজের বাড়ি। স্বামী- স্ত্রী, সন্তান সবাই মিলে সুখ-দুঃখের সাথী।


গারো সমাজের রীতি অনুসারে সংসারের যাবতীয় সম্পদের মালিক বিধানের স্ত্রী। পুরুষ হয়ে জন্ম নিয়ে সে সম্পদের মালিক হতে পারল না। হলে এই সংসারে, এই সমাজে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারত। শশুর বেঁচে থাকতে নিজের তার মান-সম্মান রক্ষার্থে ঘরের জমি-জমা, সম্পত্তি বিক্রি করে সামাজিকতা রক্ষা করেছেন। আর সেটাকেই প্র্যাক্‌টিস করে যাচ্ছে তার স্ত্রী, শাশুড়ী অর্থাৎ পুরো পরিবার। প্রায়ই শাশুড়ী বলেন, 'আমার জমি আমি বিক্রি করে দেবো, এখানে কার বলার কি আছে...,' তার কোন আত্মিয়ের বড় আকারের শুকড় নিয়ে যেতে না পারলে তার পরিবারের মান-সম্মান চলে যাবে। শাশুড়ী নিজেও অসুস্থ; বলা যায়- কোনরকম করে চলা-ফেরা করেন। তিনি নিজের চিকৎসার কথাও একবারও ভাবলেন না। অথচ তার সামাজিক রক্ষা করা চাই-ই চাই। বিধানের স্ত্রীর মানসিকতাও এমনই হয়েছে, এ যুগের মানুষ হয়েও মা কিংবা পরিবারের বিরুদ্ধে কিছুই বলবে না। শত কষ্ট হলেও না। স্বামীর দিকটা বিবেচনায় আনার কোন আগ্রহ নাই। চারিদিকে টাকার খরচ করতে করতে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে বিধান। শত অভাব, দুঃখ-কষ্ট সত্বেও মুখ ফোটে কাউকে কিছু বলতে পারছে না বিধান অথচ বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। কোন কোন সময় মনে বিধানের মনে হয়, তার নিশ্বাসটাও এখনি বের হয়ে বুঝি। বিধান এতদিন জেনে এসেছে, সংসারের সুখ-শান্তি-দুঃখ-কষ্টে সহভাগী স্বামীর স্ত্রী আর স্ত্রীর স্বামী। কিন্তু বাস্তবে বিধানের বিধানে বিধাতা সে রকম কিছু লিখে দেননি বলেই মনে হয়। আর এ জন্যই হয়ত আজ মস্ত বড় এই পরিবারে অপ্রত্যাশিত অযাচিত ঘটনা ঘটে গেল- অশান্তি হয়ে গেল। বলা যায়- রীতিমত একটা মহা-কেলেঙ্কারী।
- তোমার অফিস আর বাইরের লোকজন তোমাকে মনে করে তুমি কত ভদ্র, নম্র, বুদ্ধিমান- চালাক-চতুর; তা এতদিন আমিও ভেবেছিলাম....
- কি বলতে চাও তুমি...
- আমার সে ভুল ভেঙ্গেছে। যে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না, আমার পরিবারকে, বাবা-মাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে জানে না, গুরুজনের সিদ্ধান্ত- উপদেশ মেনে চলতে পারে না- সে কেমন পুরুষ! আর তার আবার কেমন ভদ্রতা! তুমি আসলে একটা নির্দয়-অভদ্র। আজ শুধু তোমার জন্য আমার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে আমাদের কত বড় অপবাদ দিয়ে গেল, গাল-মন্দ করে গেল...। .যে ব্যক্তি পরিবারের মান-সম্মান রক্ষা করতে পারে না, করতে চায় না; সে আবার ঘর-জামাই। আবার তার না-কি পরিবার রক্ষার দায়িত্ব - থুঃ! নিকুচি করি ঘর জামাইয়ের। তোমাকে বিয়ে করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি
- কি বলছ তুমি, পাগল হয়ে গেছ না-কি তুমি...
- হে-হে আমাকে তুমি পাগল করে তুলেছ। তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না তুমি আমার সামনে থাকলে এক্ষুনি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব.....
অনেকগুলো কথা এভাবেই বলে যাচ্ছে বিধানের স্ত্রী।

.
এমন কঠিনতম কথার কিভাবে উত্তর দেওয়া যায় বিধানের তা জানা নাই। আজ সমাজের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে মদ খেয়ে নেশায় ধরেছে। জমি-জমা বিক্রি করে দাওয়াত খাওয়া, সমাজে পরিবারের মান-সম্মান রক্ষা করার অনর্থক চেষ্টা করা- এ যুগের শিক্ষিত-সচেতন ব্যক্তিদের মানায় না; আজ রাতেই কথাটি স্ত্রীতে বোঝানো কথা ভেবেছিল কিন্তু তা নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। স্ত্রী-শাশুড়ী আর সমাজের আব্দার, অভিযোগ মেটাতে গিয়ে বাড়ীর পাশের ভাল জমিটা বন্ধকী দিয়ে স্ত্রীর আজং বাড়ীর দাওয়াত রক্ষার আয়োজন করে রেখেছে। আজ ভোরেই সেখানে যেতে হবে। এতকিছুর পরও এমুহুর্তে স্ত্রীর অযাচিত নিষ্ঠুর আচরণ আর তার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার কথা শুনে তার নিজের নিঃশ্বাসই যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবু শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধৈর্য ধরার চেষ্টা করে সে। মদ ছাড়া আজ আর কিছুই খায়নি বিধান। প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে টলতে টলতে বাড়ীতে এসে স্ত্রীর কাছে খেতে চাইবে; ঠিক এমুহুর্তে স্ত্রীর রুদ্র মূর্তি আচরণে হতবাক বিধান। আফসোস হয়, মা-বাবার সংসার ছেড়ে স্ত্রীর সংসারে এসে জান-প্রাণ দিয়ে খেটে-খুটে যেখানে তার আদর-সম্মান পাওয়ার কথা; আজ কিনা সেখানে পাচ্ছে ভর্ৎসনা! দুঃখে-ক্ষোভে বিধানের কলজ্বেটা ছিড়ে যাচ্ছে যেন। মদ খেলে মান্দিদের মনটা নরম-কোমল হয়ে যায়। এমুহুর্তে ভিষণ কান্না পাচ্ছে বিধানের। নিজেকে কিছুতেই কোনভাবে সম্বরণ করতে পারছে না সে। তাই নিজেকে লুকানোর জন্য টয়লেটে চলে যায় বিধান। সেখানে গিয়ে নিজের দুর্ভাগ্য আর পরাজয়ের কথা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে শিশুর মত কেঁদে ওঠে। এভাবে অনেক্ষণ কান্নার পর নিজেকে একটু হালকা লাগছে। চোখে-মুখে পানি দিয়ে টয়লেটথেকে বের হয়ে যাবার কথা ভাবে সে। ভাবতে ভাবতে হাত দিয়ে আজলা ভরে গামলাথেকে পানি তুলতে যাবে এমন সময় গামলার পানিতে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখে নিজের জন্য মায়া হয়। আবারও কান্না পায় তার। ঝর-ঝর করে চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে। কান্না থামতে চায় না। নিজের উপর জোড় করে মগ দিয়ে গামলার পানিটা তুলে সামনে রাখে। তারপরও তার সে কান্না থামতে চায় না; চোখের পানি পড়ছে তো পড়ছেই..।
.
পানির অপর নাম জীবন; আজ সে জীবনের সাথে তার চোখের পানি মিশে যাচ্ছে। আজ সে চোখের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে তার মানসিক অবসাদ দূর করতে চায় বিধান। ভাবতে ভাবতে চোখেমুখে মাত্র একবারই পানি দিয়েছে; এমন সময় শুনতে পায় কোথাও টুং...টুং... করে করুণ সুরে ঘন্টা বাজছে। কোন মানুষের মৃত্যুর সময় এই ভাবে, এই সুরে মানুষ ঘন্টা বাজায়। বিধানের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না- এটা নিশ্চিত মৃত্যু সংবাদের ঘন্টা। বিধানের হৃদপিন্ডে রক্তকণিকাগুলো তরিৎ গতিতে ছুটোছুটি করছে, আচঁড়ে পড়ছে। বিধানের মনে পড়ে- তার মাও মৃত্যুশয্যায়। শেষ দেখার জন্য মা গতকাল তাকে খবর পাঠিয়েছিল; কিন্তু সে যেতে পারে নি। ভাবতে ভাবতে বিধানের মাথাটা চক্কর দিয়ে ভীষন ভাবে ঘুরতে থাকে। কখন কে বা কারা টয়লেটথেকে বিধানকে এনে বিছানায় শুইয়েছে তা সে জানে না।

.
একসময় সে মানুষের অস্পষ্ট স্বর শুনতে পায়- বহুদূরে কে যেন বলছে, বিধানের জ্ঞান ফিরছে...।. বিধানের খুব কষ্ট হচ্ছে। এবার সে বুঝতে পারে, সে জ্ঞান হারিয়েছিল। জ্ঞান যদি তার হারিয়েই থাকে তবে তা চিরকালের জন্যই হারিয়ে যাক। আজ আর তার জ্ঞান ফেরার কোন ইচ্ছে নেই..., এই রাত যেন আর কোনদিন শেষ না হয়..., কোনদিন ভোর না হয়...।

সোমবার, ৫ নভেম্বর, ২০১২

রণাঙ্গনে

ফিডেল ডি সাংমা
(বাবুল নকরেক @ মেঘ রোদ্দুরকে)

অস্থির অল্েয দিবানিশি; স্বপ্নের জাবড়কাঁটা
ফোসকা পড়া হৃদয় অমলিন- জ্বলন্ত লৌহ শিখা
ঝরাও নিরবে অশ্রু বৃষ্টি; অখন্ডিত বিধান লিখা।
রণাঙ্গনে বুঝি বিকিকিনি হয় নি কোন সুখ
অন্তহীণ বৃথা প্রতীা, নির্বাক; নিশ্চল কার তরে
শোন, কুসুম কলি কখনো ভাঙ্গে না ভ্রমর ভারে।
যেন সাপের মুখে অদীতি স্তব্ধ ব্যাঙের ছানা,
আজ বুঝি মাঘের শীত ঝেঁকেছে তোমার গায়-
ওই খরায়; ভরা শ্রাবণের অঝর বৃষ্টির ধারায়।