গল্পসমগ্র-ফিডেল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্পসমগ্র-ফিডেল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৫

লতিফ ভায়ের সাথে দেখা হলো না

লতিফ ভায়ের সাথে দেখা হলো না
------------------------------------------
.
চিত্রপটঃ জলছত্র কর্পোস খ্রীস্টি মিশন। আলোকিত মধুপুরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক লতিফ ভুইঞা সেখানে এসেছেন। খবরটি শুনেই আমারও আগ্রহ হলো। ভাবলাম, যাই আমিও দেখা করে আসি। তারপর তিনি যদি শোনেন, আমি তার কাছে পিঠে থেকেও দেখা করতে আসলাম না; তাহলে তিনি মাইণ্ড করতে পারেন। এমনিতে গ্রুপের কার্যকরী কমিটির সভাপতি পদথেকে আমার সড়ে আসাতে উনি ব্যাক্তিগতভাবে খুশি নন, ভেতরে ভেতরে মানাভিমান রয়ে গেছে- সেটা আমি জানি। সুতরাং দেখাটা না করলে আমার নিজেরও ভালো লাগবে না। আগেরবার নির্বাচনকালীন সময়ে উনি ২ মাসের জন্য ছুটিতে এলেও আমার সাথে কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। সাথে এসেছেন সুন্দর ধবধবে সাদা শাড়ি পরিহিতা মহিলা। দূরথেকে দেখে আমি ভাবলাম, মহিলাটি মিশনের কোন সিস্টার (নান) হতে পারেন; কিন্তু পরে জানলাম, মহিলাটি লতিফ ভায়ের মা।
.
দেখলাম, লতিফ ভাই, উনার মা আর আমার অপরিচিত একজন ফাদার (খ্রিস্টান ধর্মের পুরোহিত)-এর সাথে আলাপ করছেন। মনে হলো, উনাদের আলাপটা শেষ পর্যায়ে। আমি পৌছতেই লতিফ ভাই এবং আমি একসাথে হ্যাণ্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। তখন আমার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি চাপলো। আমাকে চিনতে পারেন কিনা ভেবে আমি বললাম- আমি ফিডেল সাংমার ছোট ভাই। কিন্তু আমার মনে হলো না, আমার কথাটা তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। সুতরাং ব্যস্ততার ভান করে মিশন প্রাঙ্গন ঘুরে দেখার নামে অন্যান্য লোকজনদের সাথে সাক্ষাৎ করতে অন্যদিকে চলে গেলেন। এরই মধ্যে রফিক ভুইঞা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রফিক ভুইঞা আমার পূর্ব পরিচিত এবং খাতির; যা বিশ্বের কোন ভুইঞা বংশের সাথে আগে কখনও ছিলো না। ধরে নিলাম, এই রফিকও লতিফ ভায়ের সফর সঙ্গী। রফিকের সাথে খোশ গল্প করতে করতে জানলাম, লতিফ ভাই এই মিশনের জন্য ৫ লক্ষ টাকা অনুদান দিতে চাইছেন। আমি কিছুক্ষণ ভেবে ভ্রু কুঁচকে রফিককে বললাম, তগর ভুইঞা বংশের টেহা কি বেশি অয়া গেলো গা নাকি? এই মিশনরাতো চাইলের বিদেশী ডলার সাহায্য পায়তে পারে।- আমি কিবায় কমু, যার যেবা ইচ্ছা-- নাকি আবার নির্বাচনী প্রচারণা?- তাইবান-- কিন্তু এডা অয়লে- চিন্তা করসস? হাতে এহনও ৫টা বসর রয়সে, যে কোন (নির্বাচনী) পরিস্থিতি, যে কোন সময় পাল্টায়া যাবার পারে। - তাওতো কতা-- তাইলে এই অনুদান পরের নির্বাচনের আগে দিলেই বেশি বালা অইত নাকি?- হেডা হেই বালা বুজবো নি- যাই অউক, হেরে আবার কবাইন, ফিডেল দাদার বড়বাই অথবা সুডুবাই আইসিলো। দেহি, হে আমারে চিনা হায়কিনা-
.
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলাম, তার কাছাকাছি এলাকার নিম্ন আয়ের লোকজন কাজ করছে। মাঝে মাঝে দুজনই তাদের কাজ করার দিকে তাকাচ্ছি আর আলাপ করছি। আমার একটা খুব খারাপ একটা বদ-অভ্যাস আছে, তা হলো সিগারেট খাওয়া। আমি রফিককে সরাসরি না বলে আমার স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি করে বললাম, আমার দুই আঙ্গুলের চিপায় কেন্নিগা জানি খায়জায়তাসে। বুঝলাম, রফিক আমার কথা বুঝতে পারে নি। তাই চোখ দুটো বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়। আমি আবার বললাম, যাইন, আমরা কতা কইতে কইতে এইন্দা হাঁটি। কথা না বাড়িয়ে রফিক আমার সাথে হাঁটে।
আলাপ করতে করতে আমরা বড় এবং অনেক উঁচু একটা পানির ট্যাঙ্কের পেছনে চলে এলাম। পরিবেশটা খুব সুন্দর। আশেপাশে ছোট ছোট ফল আর বাহারী ফুলের গাছ। ছোট ছোট রঙিন প্রজাপতি আর পাখিগুলো উড়াউড়ি করছে। শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগছে টের পাচ্ছি। চারপাশ দেখে মনে হলো, সিগারেট খাওয়ার মতো নিরাপদ স্থান। যদি না লতিফ ভাই লোকজনের সাথে আলাপ শেষ করেন, তাহলে এখন এদিকে কারোর আসার সম্ভাবনা নাই। সুতরাং এবার সিগারেটটা এখানেই খাওয়া যায়। পকেটথেকে সিগারেট বের করে গ্যাসলাইটে চাপ দিতে যাবো, ঠিক সেসময় ঢুম করে বিকট শব্দ শুনে দুজনই চমকে গেলাম। ত্বরিৎ গতিতে ভাবছি, শব্দটা কিসের হতে পারে, কাছেই মজুররা ট্যাংকির উপড়ে চড়ে কাজ করছিলো। ওদেরই কিছু হলো নাতো! আশঙ্কা এবং ভয়ে ঘেমে যাচ্ছি। আমরা আর দাঁড়িয়ে না থেকে যেদিকথেকে শব্দটা এসেছে সেদিকে দৌড়াচ্ছি আর হাঁপাচ্ছি। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমরা দুজনই প্রচণ্ডভাবে ঘামছি। আমাদের পরনের শার্ট ভিজে শরীরের সাথে লেগে চপচপ করছে; তবুও দৌঁড়াচ্ছি। কিছুক্ষণ পরই আবার ততোধিক বিকট শব্দ! ঢুরররুম করে আওয়াজটা হতেই দেখি, আরে এতো ফুলের বাগান নয়, মামুন খানের খরখরে বিছানা।
.
অগত্যা, আমার আফসোস; লতিফ ভায়ের সাথে আর দেখা হলো না। আমি মনে মনে বলি, আরে হালা খোয়াব, তর গুষ্টি কিলাই
  -----------------------
(তারিখঃ ১৫ মে, ২০১৪)

সোমবার, ১০ মার্চ, ২০১৪

**অন্ধকার** (কিছুটা ১৮+)

**অন্ধকার**

- (বিঃদ্রঃ গল্পটি অতিরিক্ত লজ্জাশীল ব্যক্তিদের পড়া নিষেধ)-

(১)

বেলা পরে যাচ্ছে। চারিদিকে ফুরফুরে হাওয়া। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগছে। শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডায় নয়- উত্তেজনায়। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও সেকান্দর ঘেমে নেয়ে ওঠে। সেকান্দর ভাবে, সূর্য ডোবার সাথে সাথে মানুষের আশাও কি ডুবে যায়! অন্ধকারের মতোই কি মুছে যায় ভালোবাসার রঙ?

পাক্কা ১৫ বছর আগে সেকান্দর গ্রাম ছেড়েছে। টাঙ্গাইল, জামালপুর আর ময়মনসিংহ শহরের ঠিক মাঝামাঝি সেকান্দরের পৈত্রিকভিটা। পোড়খাওয়া পরিবারের দরিদ্র পিতার একমাত্র পুত্র সে। গ্রামের নাম চানপুর। গ্রামের নাম চানপুর হলে কি হবে, এ গ্রামের লোকজন চিরজীবনই অমাবশ্যার মধ্যে বাস করে যাচ্ছে। অর্থাৎ অন্ধকারে জন্ম নিয়ে অন্ধকারেই মরেছে। কারণ, এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই; নেই এলাকার লোকজনের মধ্যে শিক্ষা এবং সচেতনতা। এখানে বেশির ভাগ লোকের সর্বোচ্চ শিক্ষার মান হল- স্থায়ীভাবে ভাঙ্গা-আধচালার মকতবে ২ বছরের আরবি ও পাক কোরআন-এর কিছু প্যারা মুখস্ত পর্যন্ত। সেকান্দরের বাবার শিক্ষা-দীক্ষাও এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনিও মনে করেন, ৫ ওয়াক্ত নামাজের সময় আরবি আর দোয়া বলতে পারলেই মানুষের চলে যায়। তারপর, ক্ষেত-খামারের কাজে বাপ-দাদার কাছথেকে শিক্ষা নিয়ে সেটা কাজে লাগালেই জীবনটা পার করে দেওয়া যায়। এমন লোকদের সচেতনতা দান করার লক্ষ্যে একটি বেসরকারী সাহায্য সংস্থা কাজ করছে। আর ৩ বছরের মাথায় ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত প্রায়মারী স্কুল কোনরকমে চালিয়ে যাচ্ছে। পাশের গ্রামে একটা প্রাইমারী স্কুল থাকলেও, এ গ্রামের লোকজনের ধারণা, এতদূরে গিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করে পড়ার চেয়ে- নিজের ক্ষেত-খামারে কাজের মূল্যটাই বেশি। সেকান্দরের বাবাও তাই মনে করেন। এমন পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে এ গল্পের অবতারণা।

পৌষ মাস। এ সময় ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছুকদের পাশের গ্রামের স্কুলে ভর্তি করানো হয়। একাজটি চানপুরের শিক্ষকরাই করে থাকেন। প্রতি বছর পৌষ মাসে সবাইকে একসাথে নিয়ে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। সেকান্দরের ভাষায় আজ রাগী, বেরসিক আক্কেল আলী স্যারের পালা। ৭জন ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করার কথা। কিন্তু এবছর ১ম স্থান অধিকারিণী ময়না খাতুনের দেখা নেই। সেকান্দরের বাড়িথেকে ময়নার বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। বড় একটা খাল পেরোতে হয়, তবে বছরের বেশিরভাগ সময় এ খালের সাঁকো থাকে না। এই একমাত্র খালটিতে পানি যতই থাক; কারোর কাপড়ই ভিজে না। কায়দা ওদের জানা। পুরুষরা খালটি পারাপারের সময় লুঙ্গি তুলতে তুলতে আর নামাতে নামাতে পার হয়। আর মহিলাদের পারাপারের জরুরী মনে হলে এর সাঁকো ঠিক হয় আর বাকীটা সময়ে ভাঙ্গাই থাকে। আক্কেল আলী স্যার অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে বললেন, কিরে সেকান্দর- ময়নাদের বাড়ি তোদের বাড়ীর কাছে, অথচ ময়নারে ডাইকা সাথে নিয়া আসতে পারলা না? তুই নাহয় এক ক্লাশ উপ্রে পড়স, এইটুক সহানুভূতি দেখাইতেতো পারতা। নাকি মিছা কইলাম? সেকান্দর উত্তর দেয়, স্যার, ময়নার মায় আঙ্গর বাড়ি আইছিলো। কয়ছে, মাইয়া ডাঙ্গর অইয়া গেছে। ভিনদেশে পড়বার দিবো না। বালা সমুন্দ আইলে বিয়া দিয়া দিবো।
-      ছিঃ ছিঃ এইডা কি কথা। সেদিনইতো ওদের বাড়ি গিয়া আলাপ পাইড়া আইলাম।
-      হ স্যার। আমার আম্মাও বুঝায়া দিছে-
-      থাইক, তর হিস্টোরি শুইন্যা দেরী করন যাইবো না। লও- তুই আর আমি দুইজনে যাইয়া ময়নারে নিয়া আসি। বাকীরা তোমরা আগাইতে থাক-
স্যারের এমন আদিখ্যেতা পছন্দ হল না। ওরে আমার বাসায়া (অপেক্ষা করে) আনন নাগবো, এত ঠ্যাকা ক্যাকথাটা বলতে ইচ্ছে করছিলো সেকান্দরের। তার ধারণা- সেও চালু পোলা।

স্যারের উচ্চতা অনেক বেশি। লম্বা লম্বা পা। তাই তার পেছন পেছন হাঁটা মানে হাঁটা নয়; প্রায় দৌড়ের কাছাকাছি। সেকান্দর রাগে গজ গজ করলেও বাধ্য ছেলের মতো স্যারের পেছন পেছন হাঁটে।
-      সেকান্দর তুই ওদের বাড়ি যা। গিয়া ময়নারে নিয়া আয়। ওর বাপমায় না ছাড়বার না চাইলে, কইবা- ময়নার জন্যে এত ভাবতে হয়বো না।
-      তারপরেও যুদি না ছাড়ে-
-      তারপরেও যদি না ছাড়ে, কইবা- স্যার খাল পাড়ে ময়নার অপেক্ষায় খাড়ায়া আছে।
-      স্যার, সাঁকো বাঙ্গা। পানি মুন্নয় আমার কোমরের উপ্রে অবো
-      তাতে কি, নাইম্যা পানি ভাইঙ্গাই যা। লুঙ্গি পরছস অসুবিধা নাই। ডরেরও কিছু নাই, শরমেরও কিছু নাই। পানি বেশি অইতে থাকবো, তর লুঙ্গি তুলতে তুলতে যাবা। আর পানি কমতে থাকবো, তুইও লুঙ্গি নামাইতে থাকবা। কেউ দেখবো না- এই আমিও ঘুইরা খাড়াইলাম।
আক্কেল আলী স্যার সেকান্দরের প্রত্যুত্তরের প্রয়োজন মনে করছেন না, তবে ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছে। শীতকাল। তার উপর এ খালের পানি সবসময়ই ভীষণ ঠাণ্ডা থাকে। পানির ছরছর করা আওয়াজটা বলছে- সেকান্দর পার হয়ে যাচ্ছে। তিনি পেছন ফিরেই সিগারেটের মাথায় দিয়াশলায়ের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চিন্তা করিস না সেকান্দর। কাইলই এখানে একটা সাঁকোর ব্যবস্থা করে ফেলবো।
স্যার, এম্মুরা (এদিকে) তাকাবাইন না, আমি শরম পামু...। .ছেলেটা মালকোঁচা দিয়ে নেমেছিলো। এবার খুলেছে বোধয়; হয়তো ছেলেটা আগেথেকে পানির গভীরতা আন্দাজ করতে পারে নি। পোলাপান মানুষ, এখনই তোর শরম কিরেবলতে বলতে আক্কেল আলী স্যার আবার সিগারেটে মনযোগ দেন।

সিগারেটটা শেষ হবার আগেই সেকান্দর ওপারথেকে বলছে, স্যার একটা বাঁশ নিয়া আইছি। এইটা ফালায়া দরলেই ময়না পারয়া যাইতে পারবো। স্যার, বাঁশের ঐ মাথায় আপনের একটু দরন নাগবো। আচ্ছা, ভালা কাম করছস। বাঁশের মাথাটা এপারে আগায়া দেও, আমি ধরি। কিরে ময়না তরে মায় ছাইড়া দিল?’ সেকান্দর বাঁশটা আড়াআড়ি রাখার পর ময়না কিছু দূর এগিয়ে আসে। কিন্তু মাঝখানে এসে বাঁশটাএখন ভীষণ দুলছে। ময়না ভয় পাচ্ছে দেখে আক্কেল আলী স্যার বলেন, সেকান্দর তুই পানিতে নাইম্যা যা। বাঁশের মাঝখানে ধইরা থাক। মাঝখানের পোতা বাঁশটা দুর্বল অইয়া গেছে মনে হয়। .বাঁশের আরেক মাথা ছেড়ে দিয়ে সেকান্দর লুঙ্গিটা ছোট করে কোমরে গিঁট দেয়। তারপর পানিতে নেমে মাঝখানে ধরে রাখে। তবে, উপকার করতে গিয়ে হয়েছে আরেক বিপদ। বাঁশ আর ময়নার ভারে সেকান্দরের কিছুক্ষণ আগের হাসি মুখ ভোঁতা হয়ে গেছে। ভারে আর বিরক্তিতে সেকান্দর মুখ কুঁচকায় আর দাঁত কটমট করতে থাকে।

ময়না পার হয়ে আসার পর সেকান্দর বাঁশটা ওপারে রেখে নিজেও পার হয়ে আসে। পায়ে কাদা লাগাতে ধোয়ার জন্য ময়না পারে দাঁড়িয়ে পা চুবিয়ে নিল। সেকান্দরেরও লুঙ্গির অর্ধেক অংশ ভিজে গেছে। তাই সেকান্দর লুঙ্গিটা তুলে ছিপে পানি বের করতে থাকে। কাপড়টা একটু সাবধানে তোল বাপসেকান্দরের অবস্থা দেখে আক্কেল আলী স্যার না বলে পারলেন না। কৌতুহল ছিল না, তবু স্যারের বলার সাথে সাথে ময়না সেকান্দরের দিকে তাকায়। ওর জিনিসটা ঠাণ্ডায় জমে এই এতটুকুন হয়ে গেছে দেখে-  ফিক করে হাসে ময়না। ময়নার দিকে তাকিয়ে সেকান্দরের কানটা ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। তারপরথেকে লজ্জায় সারা রাস্তায় দুজনের চাওয়া-চাওয়ি কথাবার্তা বন্ধ।

(২)

-      বহ দোস্ত বহ। কি খবর। ম্যালাদিন কোন খবর নাই। আইজ এতদিন পর হুট কইরা আসলা-
-      হ। তরা কিবা আছ? আর চাচা-চাচি ওরা?
সেকান্দরের কথা শেষ না হতেই শৈশবকালের বন্ধু আবু তালেবের মুখে কথার তুফান বইতে লাগল। আবু তালেবের ছোটবেলাথেকেই সে একই স্বভাব। কথার মাঝখানে কখন দম নেয়, ঠিক বুঝা মুশকিল। সেকান্দর সুযোগ খুঁজে কখন, কিভাবে ময়নার কথা পারবে। বেকুবটা নিজেথেকে বলছেও না। দোস্ত ভাবীরে কও এক গ্লাস পানি দিতে। গলাটা শুঁকায়া গেছেভাবী কও ক্যা, ফরিদা। হ, হেই ফরিদা খাতুন। যার পিছে ম্যালাদিন নাইগ্যা (লেগে) আছিলাম’- সেকান্দর হাসে। ও তাই? শ্যাষমেশ তুই ফরিদারেই-। .সেকান্দরের কথা শেষ না হতে বলে, ‘খালি বিয়া না, তিনডা বাইচ্চার জরম দিসি। .আবু তালেব বিজয়ীর মত হাসে। ‘‘ও গেন্দির মা- দোস্তের নিগা এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি দিয়া যাও। বুচ্ছো ভাই, মাইনসে যখন কয় বসন্তকাল, তখন আমি কই চৈতমাস। কপাইল্যাগর মনে জাগে প্রেম, আর আকপাইল্যাগর শুকায় গলা, হা হা হা। তাইলে দোস্ত, তুই একটু জিরা, তারপর হাত-মুখ ধুইয়া আহ, হাল্কা নাস্তা খাবা। আর ততক্ষনে আমি কয়ডা কাঁচা বাজার কইরা, গরুডাও নিয়া আহি- বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় আবু তালেব। তারপর কিছুটা ঝুঁকে লুঙ্গির উপর দিয়ে কচকচ করে চুলকোতে থাকে। সেটা দেখে সেকান্দরের বিরক্তিটা গিয়ে পরে লুঙ্গিটার উপর। বিরক্তির কারণ তার সেই ছোটবেলার লুঙ্গি কাহিনী। যে ঘটনা সেকান্দরকে এখনও ভীষণভাবে বিব্রত করে, লজ্জা পায়। কাহিনী আরও আছে; প্রথমতঃ লুঙ্গি পরে ঘুমানোর পর সকালে সে লুঙ্গি খুঁজে পায় তার গলায়, আর নাহয় খাটের তলায়। দ্বিতীয়তঃ লুঙ্গি পরে হাঁটলে তার নিচের দিকটা ভীষণ খালি খালি লাগে। তখন মনে হয়, আশপাশের সব লোকজন বোধয় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তৃতীয়তঃ মাঝে মধ্যে মাছেরা যেমন পানির ভেতরে থেকে শ্বাস নেওয়ার জন্য হা করে উপরে মাথা বের করে, লুঙ্গি পরে বসলে তার জিনিসটাও ওরকম করে বলে মনে হয়। তাই বাধ্য হয়ে সেকান্দরকে তার লুঙ্গিটা সবসময় চেপে ধরে থাকতে হয়। একারণে ঢাকা শহরে যাওয়ার পরথেকে লুঙ্গির উপর ক্ষ্যাপা সেকান্দর পারতপক্ষে শুধু প্যান্টই পরে।
তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আর ভায়ের জন্য বড় দেইখ্যা একটা মাছ নিয়া আইবেনবলেই একহাতে গ্লাস আর আরেকহাতে জগে ভরা পানি নিয়ে এসে সামনে এসে দাঁড়ায় ফরিদা। পানির জন্যে হাত বাড়াতে বাড়াতে সেকান্দর বলে, কিরে ফরিদা। তুমিতো দেখছি আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছ। বিয়াশাদী করলে সব মাইয়াই এমন সুন্দর হয়? ফরিদা হাসে। কি খবর বোইন, তরা ভালো আছ?
-      হ বড় ভাই। আপনি কেমন আছেন?
-      এইতো যা দেখতাছ। বলা যায়, ভালোই আছি।
-      আপনিতো ভালোই আছেন, আর ময়নার খবর রাখছেন কিছু?
-      নারে, বলতে পারস- তোদের সবার খোঁজ লইতেই আমার গ্রামে আসা-
-      ময়না কেমনে ভালো থাকবো কন। সেই যে আপনারা সবাই চইলা গেলেন, আর আইলেন না। এদিকে ময়না চোখের পানি ফালাইতে ফালাইতে গাং বানায়া ফালাইলো। আহারে ছেরিডা-
-      কেন ফরিদা, ময়নার কি হয়ছে?
কথাটা বলেই সেকান্দরের বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপতে থাকে। যার জন্যে এতদূর ছুটে আসা- সে কি নিষ্ফল হয়ে ফিরে যাবে? সেকান্দরের মনে পরে, প্রায় ১৫ বছর আগে বাবার সাথে সে গ্রাম ছেড়েছে। অবশ্য সে দায় সেকান্দরের নয়; বাবা এবং চাচাদের। দাদুর মৃত্যুর পর খালের পানিতে বাড়ি-ভিটাটাও ভেঙ্গে গেল। তারপর বাবা-চাচাদের সাথে পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে। সেদিনথেকে বাবা অভিমান করে গ্রাম ছেড়ে সবাইকে ঢাকায় গেছেন। ছোট্ট মুদির দোকান খুলে সংসার শুরু করেছেন। চাচাদের সাথে জিদ করে বাবা নিজেও গ্রামে আসেন নি, আর কাওকেই আসার নাম পর্যন্ত নিতে দেন নি। একারণে প্রচণ্ড টান আর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেকান্দরের গ্রামে আসা হয় নি। সেকান্দরকে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার পর পাশ করতে করতে এবার সে বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। তাই বাবার কাছে অনেক অনুরোধের পর এবার গ্রামে আসার সুযোগ পেল।
-      হেতে আর কেমুন থাকবো ভাই।
-      ক্যান, কি হয়ছে?
-      হওনের আর কি বাকী আছে বড় ভাই। আপনেগর শহরে চইল্যা যাওনের পরথিকা ময়না পত্যেকদিন ইস্কুলে যাওয়া-আসার সময় একবার কইরা আমগর বাড়িত আয়তো। খালি আপনের কতা জিগায়তো আর গুফনে চোখের পানি ফালায়তো। আহারে ছেরি! হেরে দেইখ্যা মাজে-মইদ্যে আমার মনে অয়তো, হের দম বুজি আইটকা যায়-
ফরিদার কথাগুলো শুনতে শুনতে সেকান্দর ঘোরের মধ্যে চলে যায়। হাইস্কুলে পড়ার ২ বছরের মাথায়; একদিনের কথা মনে করে সেকান্দর। সেদিন স্কুলথেকে ফেরার সময় ময়না তার সামনেই সাঁকো পেরোতে গিয়ে ঝুপ করে পানিতে পরে গেল। তার জানা ছিলো না গ্রামের মেয়ে হয়েও ময়না সাঁতার জানে না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সেকান্দর কিছুক্ষণ থেকে সেও পারে বই ছুঁড়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পরল। পানিথেকে টেনে হিঁচড়ে ময়নাকে যখন ডাঙ্গায় তুলল, তখন ময়না দাঁড়িয়ে মাথাটা নীচু করে সামনে ঝুঁকে ভয়ে কাঁপছে। লজ্জারাঙা মুখে পুঁটি মাছের মত খাবি খাচ্ছে। অনেকদিন আগে সেকান্দরের জিনিসটা উন্মুক্ত হবার পর ময়নার দিকে ভালো করে কোনদিন তাকায় নি পর্যন্ত। আজ ময়নাকে সে খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে; এবং এ মূহুর্তে ময়নাকে তার নতুন মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন মনে হচ্ছে? জলপরিরাও এমন সুন্দর হয় কিনা গল্প বইয়ের পোকা সেকান্দর জানে না। লাল-নীল পরীরা দেখতে কেমন, তা কোনদিন কল্পনাও করে নি সে। মৎস-কন্যারাও কি পানিতে ভিজে? কিন্তু ময়নার সারা শরীর ভিজে চুপসে গেছে। ভাগ্যিস কয়েক ঢোক পানি গিলেই রক্ষা হয়েছে, নাহলে কিযে হতো কে জানে। ময়নার সালোয়ার-কামিজ বেয়ে টপ-টপ করে পানি ঝরছে। তখন পশ্চিমের সূর্যটা কোনভাবে ঝুলে থেকে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। আ-আমার ও-ওড়নাটা কই-ময়না কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে। চমকে গিয়ে সেকান্দর এদিকওদিক তাকায়। একসময় দেখে দূরে- খালের মাঝপানিতে ভেসে যাচ্ছে ময়নার আবরন।

(৩)

গেন্দির মা, বাজারে তেমন কিছু পাওয়া যায় নায়। নেও সদাইগুলা ধর। দোস্ত হারাদিন কিছু খায় নায়। তাড়াতাড়ি রাইন্দালাও। আমি গরুডা গোয়ালে তুলিবলেই আবু তালেব তার কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে। ফরিদা যখন বাজারের ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল তখন আবু তালেব ফিসফিসিয়ে বলে, ‘দোস্ত ময়নারে খবর দিয়া আইছি। খালপাড়ে আহনের কতা। সাবদানে যাও, ফট কইরা দেহা কইরা আস
কথাগুলো শুনেই সেকান্দরের সারা শরীর আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যেন ঐশ্বরিক বলে শক্তি ফিরে পেল। এখনই যাবো?’ ‘না, একটু পরে যাও। ওর আইতে দেরিও অইতে পারেবলেছিল আবু তালেব কিন্তু সেকান্দরের তর সইল না। তাই সে হিসু করার অজুহাতে বেরিয়ে পরল।

খালপাড়ে চলে এসে দেখে কোথাও কেউ নেই, চারিদিক কেমন খা-খা; শুন্যতা। ময়না আসলে কি হবে, আর কথাটা কিভাবে বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এলোপাথাড়ি ভাবতে ভাবতে সেকান্দর গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে পরে। ক্লান্ত শরীর। বেশ কয়েকদিন যাবত সে অসুস্থ্য ছিল। তার উপর সারাদিন খাওয়া নাই। এখন সেকান্দরের শরীরটা হেলে পরতে চাইছে। গাছের গোড়ায় হেলান দেওয়ার পর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। খালপাড়ের চারিদিক হিম শীতল বাতাস বইছে। সেকান্দর ভাবে, এসব কাজে পৃথিবীর কোন মানুষকে যেন এভাবে অপেক্ষা করতে না হয়। কী নির্মম এই অপেক্ষার সময়টা। তর সইছে না, তবুও কেমন ঘোরের নেশায় পেয়ে বসে সেকান্দরকে।

ঐতো খালের ওপারে ছায়ামানবী ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। হ্যাঁ ময়নাইতো। খুব সাবধানে এদিকওদিক তাকিয়ে সামনে পা ফেলছে। হাঁটার সময় ময়নার শরীরটা যেভাবে দোলে, তা সেকান্দরের চেনা। এখন সেভাবেই শরীরটা দুলছে আবার থামছে। দুলছে আবার থামছে। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে, আবেগে সেকান্দরের মন থৈ থৈ করতে শুরু করল। আবার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ছেলেবেলার সেই ঝকঝকে দৃশ্যগুলো। লুঙ্গি পরা সেকান্দর খালের মাঝপানিতে নেমে সাঁকোর এক পা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরী ময়না তার ফর্সা, আলতারাঙা পায়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। সেকান্দরের কাঁধের উপর দিয়ে খুব সাবধানে সাঁকো পার হয়ে আসছে ময়নার পা দুটো। কিন্তু ময়নাকে আজ বাতাসের মত কেমন হালকা মনে কেন? ভালবাসলে কি মানুষের শরীর হালকা মনে হয়! নাকি ময়নাই ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে চাইছে না বলে নিজের ভারটাকে হালকা করে দিচ্ছে। এ কি কখনও সম্ভব? আবার দেখে সেকান্দর, বোঝার চেষ্টা করে। ঠিকইতো! ময়না তার কাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। না, কোন কষ্টই হচ্ছে না তার, বরং নিজেকে খুবই নিষ্ঠাবান, দায়িত্ববান অভিভাবকের মত মনে হচ্ছে। যাকে সেকান্দর ভালোবাসে, আজ সে মাথাথেকে শুরু করে বুকের উপর দিয়ে হেঁটে গেলেও বোধয় কোন কষ্টই হবে না তার। সেকান্দর বোঝার চেষ্টা করে, চোখের পলকে ময়না যেন ভয়াবহ সাঁকোটা নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেল।

সেকান্দর কোনদিন যা করে নি, আজ সে তাই করল। সে ময়নার হাত ধরে পাড়ে নিয়ে এসে দুজন দুজনার খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি দাঁড়ায়। দুজনই দুজনার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ভালোবেসে যে সীমাহীন শান্তি, এতোটা তৃপ্তি; ভাবতেই পারে নি সেকান্দর। কারো মুখে কোন কথা নাই। ওদের কথা হয় শুধু চোখের ইশারায়, মনের ভাষায়। আজ যেন জন্ম-জন্মান্তরের একই অঙ্গ, একই মন, একই আত্মায় আবদ্ধ। তারপর অক্টোপাশের মত ওরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে কতক্ষণ ছিল; কেউ জানে না।

সেকান্দরের হঠাৎ মনে কেন মনে হল- সারাপৃথিবী দুলে দুলে উঠছে। প্রচণ্ড বেগে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝর বয়ে যাচ্ছে। চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। আর খুব ক্ষীণ স্বরে, দূরে- বহুদূরে কেউ যেন তার নাম ধরে সে-কা-ন্দ-র, সে-কা-ন্দ-রবলে ডাকছে। হ্যাঁ, ঠিকইতো। এইতো, এখন প্রায় স্পষ্টই সে শুনতে পাচ্ছে- সেকান্দর, এই সেকান্দর। দোস্ত, এই দোস্ত- তাড়াতাড়ি ওঠবলে আবু তালেব ডাকছে। সাথে সাথে তাকে ধরে ঝাঁকুনিও দিচ্ছে। ঘোরের মধ্যেই সেকান্দর কিছু বুঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোন কথা মুখ ফুটে বের হচ্ছে না। সোজা হয়ে বসার চেষ্টা সে করল, বুঝার চেষ্টা করেই যাচ্ছে সে। তার কি হয়েছে? সেই কি ঘুমিয়ে পরেছিল? অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেকান্দর কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। নির্বাক, শুধু ফ্যালফ্যাল করে আবু তালেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবু তালেব আবার বলে, দোস্ত- তর কি হয়ছে? তরে এত ডাকতাসি। তুই এইহানে এত ঠাণ্ডার মইদ্যে ঘুমায়া আসস ক্যা? আর ওইদিকে কি অইছে জানস? তর কাছে আসনের সময় ময়নারে ওর স্বামী ধরছে। আর তারে টাইন্যা হ্যাঁচড়ায়া বাড়িত নিয়া মাইর-ধর কইরা হেষে গলা টিইপ্যা মাইরালাইছে।


হঠাৎ সেকান্দরের মনে হচ্ছে, চারিদিকে ঠাঠা শব্দ করে এইমাত্র মাথায় বজ্রপাত হয়ে গেল। সেশব্দে স্পষ্ট কোন কথা শোনা যাচ্ছে না, কোন কথার কোন মানে বুঝা যাচ্ছে না। আবু তালেবের কথাগুলো ধীরে ধীরে ক্ষীণথেকে ক্ষীণতর হচ্ছে, সারা পৃথিবী সীমাহীন অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে ... 

সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৩

এ জার্নি বাই মাইক্রো টু ভার্সি


এ জার্নি বাই মাইক্রো টু ভার্সিটি...
(এক মিনিটের গল্প)
ফিডেল ডি সাংমা

গতকাল মাঝরাতে বেবীকে তার গালে একটা কিস্‌ দিয়ে গুড নাইট বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওয়াল ক্লকে এলার্ম শুনেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। রাতে ঘুম হলে শরীরটা খুব টায়ার্ড লাগে। তবুও নিজের অনিচ্ছার সাথে ফাইট করে উঠতে হল। বেডথেকে নেমে দেখি আমার ওয়াইফ তাড়াহুরা করে ব্রেকফাস্ট রেডি করছে। আজ হলি ডে। ভার্সিটিতে ভ্যালেন্টাইন ডে'র ফাংশান হবে। চার্মিং ব্যান্ড দল আসবে। দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ব্রাশটা হাতে নিয়েই দেখি টুট পেষ্ট নেই। আজ বেবীর টুট পাওডার দিয়েই কাজ সারতে হবে। বেশ কয়েকদিন যাবত বাচ্চার মার জন্য ফেইস ওয়াশ আনতে হবে; তাও মনে থাকে না। স্যুট- টাই পড়ে হালকা ফ্লেভারের পারফিউমটা সারাটা শরীর স্প্রে করে নিলাম। আন্টিকে বাসার মেইন গেইট লক করতে বলে প্রায় দৌঁড়ে ফুটপাট ধরে হাঁটছি। মেইন রোড আজ খুব বিজি। রোড সাইডে হকাররা প্যাপার, ম্যাগাজিন ভাগাভাগি করছে। আজ ভাবছি- টেঙ্ক্যিাব বা স্কুটারে যাবো না। ইদানিং সিটিতে ভাড়ায় মাইক্রো পাওয়া যায়। তবে রেন্ট এ কার লেখা থাকে না। যাই হোক- টাইম কিল করার সময় নাই। প্রফেসর জন আর আমাকে সব দায়িত্ব না দিলেও পারত। আমরা যেন অল রাউন্ডার। সবাই আমাকে পেয়ে বসেছে, বউ-বাচ্চার জন্য সময় দিতে পারি না। আমার পুরো ভার্সিটির লাইফটাই খাটিয়ে মারল।

কালচারাল অনুষ্ঠানের টোটাল ম্যানেজমেন্ট কেমন হবে তা নিয়ে ভাবছি আর হাঁটছি। প্যান্টের পকেটথেকে বেরসিক মোবাইলটা বার বার রিং হচ্ছে। অমনি একটা রিক্সা বেল না বাজিয়ে বেক করতে গিয়ে আমার হ্যান্ড বেগের চেইনটা ছিঁড়ে দিল। ভেরী বেড লাক। রাগে ফায়ার হয়ে গেলাম। আজ প্রচন্ড রাগলেও প্রকাশ করা যাবে না। ফ্রেন্ডরা বলে, রাগলে না-কি আমাকে খুবই বিধ্বস্ত চেহারা লাগে, আনস্মার্ট লাগে...। - ওসব ফাল্টু কথা ভেবে লাভ নেই। শার্ট পকেটথেকে সান গ্লাসটা বের করে চোখে দিলাম। ফার্ম গেইটের ওভার ব্রিজ পেরিয়ে আবার মেজাজটা বিগড়ে গেল। আনন্দ সিনেমা হলের সামনেও প্রচন্ড জ্যাম। দাঁড়িয়ে কোন খালি গাড়ি আসলে হাত নেড়ে ডাকবে কিংবা চট্‌ করে গাড়িতে উঠে পড়বে- তারও উপায় নেই...। - সরকারের মহা মন্ত্রীরা জনগনের ইনকাম টেক্সের টাকা খেয়ে খেয়ে গদি আগলে বসে আছেন। দেশের কেন্দ্রস্থল রাজধানী ঢাকা সিটিকেই যারা শান্তিতে রাখতে পারেন না, তারাই দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। আর আর মেয়র সাহেব, উনি কি করেন.....,ক্ষোভটা যেন বেড়েই উঠছিল। হঠাৎ পেছনথেকে বোমা সাইজের ড্রাইভার বলে উঠল-
'স্যার যাইবেন..?'
হ্যাঁ- যাবো...
মনে মনে বলি- শালা ইডিয়েট! বেটা বলে কি, চৈত্রমাসের খরা রৌদ্রে রোডের উপর দাঁড়িয়ে আছি কি তামসা করার জন্যে... যাবো মানে- আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্ঠি যাবে...।
'কই যাইবেন স্যার'
'ও হ্যাঁ, ভারসিটি যাবো, যাবেতো না-কি? '
'জী স্যার- যাবো'
'ভাড়া কত নেবে...?'
'তিনশো টাকা দিয়েন স্যার'
'আহ্‌ এতো কেনো, জিনিস-পাতির দামের সাথে তোমাদের ভাড়াও বেড়ে যায় নাকি...'
'ঈদতো আইসা গ্যালো স্যার, বোনাস দিবেন না....'
'আহ্‌ যে ভাবে বলছ- আমার মানি ব্যাগযে খালি করে দেবে। যাও, সব মিলিয়ে তোমাকে ২০০.০০ টাকা দেবো, চলবে....?'
'জ্বি স্যার....'
পাবলিক লাইব্রেরীতে ঢুকতে হবে। গতকাল সেক্রেটারীকে বলেছিলাম ওয়েটিং রুমের টেবিলের উপর পেপার ট্রে-তে লটারীর টিকিট আর লাঞ্চের টোকেনগুলো রাখতে। ওই বেটা সেভাবে রেখেছে কি-না কে জানে! এখন মেইনরোড একটু ফাঁকা হয়েছে। দুদিকথেকে ছোট, বড়, মাঝারী, লাল, নীল, বেগুনী, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি বিভিন্ন সাইজ আর কালারের গাড়ী ছুটাছুটি করছে।

'খুব কেয়ারফুলি চালাবে, বুঝলে। রোডে এক্সিডেন্ট করে বসো না....'
'এক মিনিট স্যার, প্লিজ আপনি সিটে বসুন, আমি এসি-টা ছেড়ে দিচ্ছি। কন্‌ফেকশনারীথেকে একটা মিনারেল ওয়াটার নিয়ে আসি, লেইট হবে না।'
'ওকে গুড- যাও- তাড়াতাড়ি কর....'

সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে আমার টেনশান তার ডাবল হচ্ছে। সাইড লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে লেজি চালকের জন্য ওয়েট করছি। সামনের রেড লাইট অফ হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ হুইসেল দিয়ে হাত নাড়ছে। অবশেষে আমাদের মাইক্রো রিস্টার্ট দিয়ে রেইল ক্রসিং ওভারটেক করল.....।

সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, আসুন আমরা এই গল্পে কতটা ইংলিশ ওয়ার্ড আছে, তা ভাবার আগে একবার নিজের সংস্কৃতি নিয়ে একবার ভাবি। আমরা কি নিজেদের মধ্যে নিজস্ব ভাষায় কথা বলি? নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাচ্ছি কি?   আসুন আমরা আমাদের নিজস্ব জাতি-সংস্কৃতিকে ভালবাসা ও সম্মান দেই। ধন্যবাদ।

বুধবার, ১২ জুন, ২০১৩

((জামাই)) -গল্প


((জামাই)) -গল্প- জুয়েল রানাকে

by Fidel D Sangma (Notes) on Wednesday, June 12, 2013 at 10:13pm
(১)
জাহিদুল ইসলাম আরমান ওরফে মাষ্টর সাব। মেধাবী অথচ চালচলনে সহজ সরল। প্রায় ১৫/১৬ কিমি দূরে গ্রামের “আলোকিত মধুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়”-এর সহকারী শিক্ষক। একবছর আগে চার বন্ধু- সুলতান মাহমুদ, সামিউল আলম, হারুনুর রশিদ, বচন পোদ্দার সকলেই একসাথে শিক্ষকতায় চাকুরী পেয়ে যান। প্রতিদিন যাতায়াতে অসুবিধা হওয়ায় পিতা হাজী মোঃ আতিকুল ইসলাম ছেলেকে রসুলপুর গ্রামে মোঃ আব্দুল লতিফ মন্ডলের বাড়িতে জায়গীর থাকতে বললেন। জাহিদুল কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রসুলপুর গ্রামের নিরক্ষর জনগণদের প্রিয় মাষ্টর সাব হয়ে উঠলেন। এভাবেই মোঃ আব্দুল লতিফ মন্ডলের ৪/৫ বছরের নাতি ফজলুর সাথে সখ্যতা জাহিদুলের। ফজলুর দাদু ফজলুকে আদর করে “বর-বাই” বলে ডাকেন। মাষ্টর সাবের ঘরেও শুকনো খাবারগুলো ফজলুর জন্যই রাখা থাকে। স্কুলের পরও ফজলু প্রায় সারাদিন স্যারের পেছন পেছন ঘুরে। তাই জাহিদুল ইসলাম ইঁচড়েপাকা ফজলুকে নিয়ে গিয়ে তার দাদুর সামনে দাঁড়ায়-
-       আসসালামুয়ালাইকুম চাচা,
-       আলাইকুম ছালাম, কিরম আছুইন- মাষ্টর সাব?
-       জী চাচা- ভালোই আছি, আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন। আর তুমি করে বলবেন-
-       আইচ্ছা, তা কইর- কিছু কইবা?
-       জী চাচা। আপনার এ নাতি খুব চালু। তাই অভ্যাসের জন্য তাকে স্কুলে ভর্তি দিতে চাই- কি বলেন”।
-       এইডা কি কও! বাইত তুমারে হারাদিন জ্বালায়, আবার ইশকুলেও...

গ্রামটিতে এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে নি। তবে এলাকার লোকজন যেমন-  ধর্মপ্রাণ; বয়স্করা নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পরেন, খানকা শরিফে সাপ্তাহিক জিগির হয়। রোজা রাখেন, জাকাত-ফিতরা দান করেন। তেমনই জুয়েল চৌধুরী, বাবুল সরকার, লুই মারাক, সঞ্জিব নাথ, হিমেল সরকার, সুজিত দাস; উনারাও যার যার সংসার ধর্ম পালন করে যাচ্ছেন, পরস্পরের সুবিধা অসুবিধার খবর নিচ্ছেন এবং একে অপরের পারিবারিক উৎসবেও উপস্থিত হচ্ছেন। এমনই শান্তিময় সহাবস্থানের এই গ্রামের নাম রসুলপুর।

মোঃ আব্দুল লতিফ মন্ডলের ২ ছেলে ৪ মেয়ের মধ্যে শেষ মেয়ে ফিরোজা আক্তার ওরফে জবাকুসুম; ১০ম শ্রেনীতে পড়ে। প্রায় দুই কিলো দুরের মাধ্যমিক স্কুলে গিয়ে তাকে পড়াশুনা করতে হয়। প্রথমদিকে বড় ভাই কবিরুদ্দিন সাইকেলে করে দিয়ে আসতো, কিন্তু এখন রাস্তা আর আশপাশের লোকজন পরিচিত হওয়ায় আর দিয়ে আসতে হয় না। জাহিদুল ইসলাম আরমান ওরফে মাষ্টার সাহেবও একই পথে যায় বলে জবাকুসুমের সাহসটাও একটু বেড়েছে। দেখতে সুন্দরী হওয়ায় গ্রামের সব যুবকের চোখে জবাকুসুমের দিকে। তবে গ্রামের নানী দাদী, কুটনী বুড়ীরা তাকে খুব কমই সহ্য করতে পারেন। এর রেশ ধরে মাষ্টর সাব আর জবাকুসুমকে নিয়ে সমালোচনা হলে- হতেও পারে।

(২)
তিনদিনের এজতেমায় গেছেন আঃ লতিফ মন্ডল। পাহাড়ি রাস্তা; ঝোঁপঝাঁড়ের কাঁটা আর নুঁড়ি বিছানো থাকে বলে তাঁর বড় ছেলেটাই সাইকেলে করে দিয়ে এলেন। ফজলুও খুব করে বায়না ধরেছিলো এজতেমায় যাওয়ার। “বড়-ভাই, আপনি তো কালই ফিরবেন, ছেলেটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবেন” বলেই জাহিদুল তার প্রিয় শিষ্য ফজলুকে রিজার্ভ করা ভ্যানে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো।

হাজারের কাছাকাছি লোকের সমাগম। সে তুলনায় সামিয়ানা ছোটই মনে হচ্ছে। এতগুলো মুসল্লি এক সাথে কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পরা যাবে কিনা বলা যাচ্ছে না। এদিকে অজু সারতে হবে একটা ছোট্ট দিঘিতে। গতবছর বৃষ্টি কম হয়েছিলো বলে দিঘিতে এবার পানিও কম। তাই যাতে পানি ময়লা-ঘোলা না হয়, এজন্যে খুব সাবধানে অজু করার নোটিশ টানানোর পরও বার বার মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। ধর্মপ্রাণ লোকজন অবশ্য তা মেনেও চলছেন।

২য় দিন ভোরেই সবাই জেগে উঠল। কবিরুদ্দিন তার ছেলে ফজলুকে নামাজের পরেই নিয়ে ফিরে যাবেন। সবাই যে যার মত অজু সেরে নামাজে সামিল হলেন। কিন্তু নামাজ শেষে মাষ্টর সাহেবের দামী জুতো-জোড়া আর খুঁজে পেলেন না। এখন উপায়! অগত্যা পুরোনো জুতো দেখে পরে আরও দুইদিন কাটিয়ে দিল। আশে পাশে খাবার এবং দুয়েকটি টুপি আতরের দোকান ছাড়া অন্য কোন দোকান নেই। জুতো কিনে নিরাপদে ফিরবেন। আগামীকাল জুম্মার নামাজের পর সবাই যার যার মত করে বাড়ী ফিরে যাবে। মেরাজ, মিঠু, মুহিদ, সবুজ সবাই মিলে খোঁজাখুঁজির পরও তার দামী জুতো-জোড়ার কোন হদিস মিলল না।

এজতেমার শেষদিনে বিশ্বের সকল মানুষের মঙ্গলের জন্য, বিশ্ব-শান্তির জন্য জুম্মার নামাজে আখেরি মুনাজাত করা হল। সবাই যার যার মত ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মাষ্টার সাহেব  ফিরবেন কি করে, খালি পায়ে?  রাস্তা জুড়ে যে ভাবে কাঁটা আর নুঁড়ি ছড়ানো ছিটানো থাকে, মনে হবে- কেউ ইচ্ছে করে যেন বিছিয়ে রেখেছে। আসার পথে এমরান আর আরমানের পায়ে বিঁধে রক্ত ঝরল, সোহেলের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হল; আর মুন্নাফ চাচা আরও একধাপ এগিয়ে; হুঁচোট খেয়ে নুড়িতে পরে গেল আর পেছনের চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে ধপধপে সাদা জোব্বাটা রক্তে ভিজে চপচপ করছিল- ওহ! এসব ভাবতেই জাহিদুলের গা শিওরে উঠছে। কিন্তু কোথায় পাবে তার জুতো-জোড়া? জাহিদুল ভাবতে লাগলো- তার জুতো যিনি নিয়ে গেলেন, তার জুতো কই? ওটা হলেও চলতো। নিশ্চয়ই তার পায়ের মাপ একই হবে। সেটা জানা যখন আর মোটেই সম্ভব না, অন্য কারোর জুতো পরেই ফিরতে হবে। তাই বলে জুতো চুরি (নাউজুবিল্লাহ)!

(৩)
জায়গির বাড়িতে মাষ্টার সাহেবের থাকার রুমের বারান্দায় সবসময়ের জন্য চেয়ার টেবিল পাতা থাকে। ৩দিন পর ফিরে এসে দেখে তার রুম, বারান্দা, চেয়ার টেবিল সব ঝকঝক করছে। আর  টেবিলের ওপর একটা গোলাপী রঙের জবাফুল পরে আছে। ‘পরে আছে নয়; বলতে হবে দিয়ে গেছে’ অবাক হয়ে ভাবতে থাকে জাহিদুল। কে করলো এত সুন্দর কাজ? জবাকুসুম কি? এমন একজনকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেলে মন্দ হতো না।

বারান্দায় বসে রাস্তার অনেকদূর দেখা যায়। লোকেরা দল বেঁধে কাঁধে ব্যাগ-বোচকা নিয়ে ফিরছে। সেই দলে মাঝ বয়সী এক লোক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছেন। আহা! উনাকে দেখে মায়াও লাগছে। এই ধর্মপ্রাণ মানুষের ব্যাগটা নিয়ে উনার বাড়ীতে দিয়ে আসতে পারলে- একটা সওয়াবের কাজ হয়ে যেত। কিন্তু এতদূর নিজের ব্যাগ কাঁধে বয়ে এসে নিজেও অত্যধিক ক্লান্ত; ওটা যখন কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না, তাই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইলো জাহিদুল। এবার জবাকুসুমকে নিয়েই ভাবতে শুরু করছে জাহিদুল।

“স্যার স্যার, আমি আন্নের জুতাডা আমার ব্যাগঅ ভইরা নইয়া আইসি”। .ফজলুর চিৎকারে জাহিদুলের ভাবনায় ছেদ পরে। মাষ্টার সাহেব তার জুতো-জোড়া দেখে থ।
-       এটা কোত্থেকে পেলে তুমি?
-       ক্যা-? হেদিন আন্নে এবা দামী জুতা বারান্দায় হালাই থুইয়া নামাজঅ গেলাইনগা, আর-ত ফিরুনের নামগুন্দ আছাল না। এন্নিগাই ত- আমি এইন্না আমার ব্যাগঅ ভইরা হালাইছিলাম।
-       তারপর-
-       তারহরে আর কি, আমি আন্নের নিগা খারই অইছি, হেসুম বাজান আমারে জুর কইরা সাইকলঅ তুইল্যা নইয়া আইলো।
-       হায়হায়রে বাজান, তুই করছস কি-
-       হ- স্যার, বাজানের জুন্তে আন্নেরে জুতা দিয়া আহাইলাম না
-       ইয়াল্লাহ! তবে আমি কার জুতা ...।
কথাগুলো শুনে জাহিদুলের দু’কান গরম হয়ে উঠল, আর মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। জুতো-জোড়া হাতে নিয়ে ফজলুকে কোলে তুলে নেয়। ফজলুর জন্য রাস্তার দোকানথেকে লেবেনচুস আনতে ভুলে নি জাহিদুল। ওগুলো হাতে ধরিয়ে দিতেই ফজলুর ছানাভরা চোখ চলে যায় তার অতিপ্রিয় মাষ্টর সাব-এর পায়ের দিকে। জুতোগুলো ফজলুর চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু আবার সে ব্যস্ত হয়ে পরে লেবেনচুসে।

ফজলু তার স্বভাবমত প্রায় ১৫ মিনিট ধরে বকবক করছে। সুযোগ বুঝে জবাকুসুমের খবর নেয় জাহিদুল। হঠাৎ ফজলুর ডাকে চমকে যায় সে। ছেলেটি চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘দাদু গো, অ দাদু- আন্নে এবাই খুড়াইয়া আতটাছুইন ক্যা? অ দাদু- আন্নের ঠ্যাং খাইল্যা ক্যা?’ দাদুকে খুব কাহিল দেখাচ্ছে; গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না; তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে একটুখানি কাশলেন। ততোধিক জোরে ফজলু আবার বলে- ‘দাদু, অ দাদু, এই য্যা আন্নের জুতা...’
ফজলুর ছোট্ট আঙ্গুলের ইশারা অনুসরণ করে দাদু তার জুতো-জোড়া দেখতে পেলেন জাহিদুল মাষ্টরের পায়ে। যাকে কিছুক্ষণ আগেও জবাকুসুমের সাথে বিয়ে দিয়ে ছোট জামাই করার কথা ভাবছিলেন... 

(গল্প এবং চরিত্র কাল্পনিক. কাউকে ব্যক্তিগত সুখ বা আঘাত করার জন্য নয়।)

শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

মিতা- ফিডেল ডি সাংমা

মিতা-  ফিডেল ডি সাংমা
 সোমবার, 29 আগস্ট 2011 15:53

‘যেখানে ভালবাসা আছে, হৃদয়ের টান আছে, সেখানে সুবিধা-অসুবিধা, লাভ-ক্ষতির ব্যপারটা গৌণ...’
 মিতার কথাগুলো শুনে নড়ে-চড়ে বসে অয়ন। মিতাদের মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ। শুনেই আগ্রহ জন্মে মেধাবী ছাত্র অয়নের। পুরো নাম- মোঃ মতিউর রহমান। মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় মিতা, ‘তা আপনি কি আমাদের নিয়ে থিসিস্ লিখতে চাচ্ছেন না-কী?’
- আচ্ছা মিতা, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সারা বিশ্বের সমাজ চলছে সেখানে তোমাদের মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, কেন? তোমাদের সমাজের পুরুষরাই বা এটাকে কি ভাবে নেয়?
- আমাদের আদি-সমাজ ব্যবস্থাই এমন। আমরা আমাদের জাতটাকে, সমাজকে এবং আদিবাসি সংস্কৃতিকে অন্তর দিয়ে ভালবাসি। পৃথিবীতে মঙ্গোলীয়দের অনেক জাতির মধ্যে এখনও মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ প্রচলিত আছে। এখানে আমাদের আলাদা জাতিসত্ত্বা, আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা; আর এজন্যই আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র বলে দাবী করতে পারি, তাই না?
- হয়তবা পার। কিন্তু এমন হাই থটেরর কথা-বার্তা রেখে একটু সহজ করে বল, শুনি-
- যেমন ধরেন, আমাদের সমাজে যেটুকু জাতীয় মূল্যবোধ এখনও টিকে আছে, তা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। যেমন ধরেন...

মিতার কথায় বাঁধা দেয় অয়ন। ‘থামতো, ধরেন-টরেন, লেন-দেন শব্দগুলো বাদ দাও, না হলে আলাপটা ভাল জমবে না। তারপর তোমাদের জাতীয় মূল্যবোধের বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা দাও।’ - এ ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশের ফাঁকে ওদের আড্ডার শুরু...।

রিতা ও মিতা দুই বোন। মিতা বি.এ অনার্সের ছাত্রী। বাবা-মা অনেক কষ্টে-শিষ্টে পড়তে দিয়েছেন। মিতা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের ফ্যাকালটিতে একমাত্র আদিবাসী মেয়ে। তার ওপর দেখতে মোটামুটি সুন্দরী। দেহের গঠন বাঙালী- আদিবাসীর মাঝামাঝি। প্রথম দেখায় মিতাকে বুঝার উপায় নেই যে সে অবাঙ্গালী। একমাত্র কথা বলার জড়তা ছাড়া। তবুও গলায় মিষ্টি স্বরের কারণে পার পেয়ে যায় সে।

হোষ্টেলে মিতার জায়গা হয়নি; তাই ৪/৫ জন ছাত্রী মিলে একটি মেসে থেকে পড়াশুনা করছে। প্রায়ই একই বাসে করে ক্লাশে যাওয়া-আসা করতে হয়। মিতা ছাড়া তার সহপাঠী সবাই শহুরে। তাদের কোন জড়তা নেই, যখন যা ইচ্ছে করতে পারে, চলতে পারে, বলতে পারে, কিন্তু তা মিতা পারে না। অপরিচিত কারোর সাথে মিশতে বা কথা বলতে দ্বিধাবোধ হয় তার। ছাত্র-ছাত্রী মিলে সবাই যখন আড্ডা-গল্প-ঠাট্টা-হই-হুল্লোড় করে, মিতা তখন থাকে চুপচাপ। মাঝে মধ্যে হু-হাঁ জাতীয় শব্দ দিয়েই চালিয়ে দেয় সে।

মিতার বড় বোন রিতা বিয়ে করে সংসার চালাচ্ছে। তার স্বামীটা একটু গোবেচারা টাইপের; এনজিওতে চাকুরী করে। বাবা স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টারী শেষ করে মোটামুটি ধর্ম-কর্মের দিকে মনযোগ দিয়েছেন। মা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় প্রচন্ডভাবে শূচি-বায়ূগ্রস্থ। মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ ও তার পরিবারের পাক্কা গৃহিনী হয়ে সংসারের যাবতীয় বিষয় দেখা-শুনা করেন। স্বামীর অল্প আয়ের কারণে আর্থিক লেন-দেন, লাভ-লোকসানের হিসাবে বড়ই কড়া মনোভাব।

ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা মোঃ মতিউর রহমানদের পরিবার। অয়ন নামেই সে বেশী পরিচিত। বড় লোকের একমাত্র সন্তান। তাই তার চাল-চলন, ভাব-সাব একটু অন্য রকম। আধুনিক যুগের ছেলে বলতে যা বুঝায়! সহপাঠী শেফালী আক্তারের অয়নের গা ঘেষার বেশ আগ্রহ তা বুঝা যায়। বোধ হয় মনে মনে ভালই বাসে, তবে এক তরফা। অয়ন তাকে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। সেই শেফালী আক্তারের সাথে সাজেশান নিতে গিয়ে অয়নের সাথে পরিচয়। বিশ্ব-বিদ্যালয়ের পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতেই কেটে গেল মিতার একটি বছর। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নতুন আর একটি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল মিতাকে।
‘বাহ্-বাহ্ তোমার হাসি তো খুব সুন্দর, আমি তো কোনদিন খেয়াল করিনি...’ অয়নের এমন উক্তি শুনে লজ্জা পায় মিতা। সে কোন রকমে বলে- চলুন, উঠে পড়ি। এই শেফালী, চল্..।
‘আরে না না, তোমাদের জাতীয় মূল্যবোধের বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করে বলবে না?’ আবার আদিবাসি বিষয়েই কথা তোলে অয়ন। ‘এই শেফালী বস তো। আজ খুব সুন্দর বাতাস, বসে আড্ডা দিয়ে তোমার কথা শুনতে ভাল লাগছে...’ শেফালী উঠতে যাচ্ছিল, তাই হাতটা ধরে বসিয়ে দেয় অয়ন। ‘তা হলে একটু পরেই যাই। আমারও তোমার কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছে..।’ অনেক্ষণ পর কথা বলল শেফালী। মিতা শুরু করে...
- আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কোন লিখিত বিধি-বিধান নেই; তবে এর প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। মুখে মুখে প্রচলিত সামাজিক নিয়ম-নীতি এবং সংস্কৃতিতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা চলে। আপনাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে অনেক তফাৎ।
- যেমন...?
- বলছি, আমাদের সমাজে বড়দের সম্মান এবং ছোটদের আদর-স্নেহ- ভালবাসার ধরণ দেখলে আপনারা অবাক হবেন। আপনারা সংখ্যাগুরু মানুষরা আমাদের ক্ষুদ্র জাতীদের সব কিছু অতি ছোট- ক্ষুদ্র বলেই মনে করেন। তুচ্ছ্ব-তাচ্ছিল্য করেন। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার সব কিছু বাঁকা চোখে দেখেন। অনেক সময় আমাদের এ সব বিষয়গুলো আপনাদের কাছে নিন্দনীয়, হাসির পাত্র, করুণার বিষয়। কিন্তু দেখেন, আমাদের এসব কিছুর মূলে আছে আমাদের সারল্য-সততা। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি শোষন-নির্যাতন-যন্ত্রণার করুণ কাহিনী। আমাদের সমাজে যেমন তালাক-যৌতুক নেই, তেমনি প্রতারণা, স্বার্থপরতা, হিংসা-নিন্দা, ঘুষ-শোষন-নির্যাতন, ডাকাত, ধর্ষণ, বলাৎকার, এ জাতীয় শব্দের কোন প্রতিশব্দ নেই; ব্যবহারও নেই। পাশের বাড়ীর কেউ না খেয়ে থাকে না। বৃদ্ধ বাবা-মা, ময়-মুরুব্বী, পঙ্গু- এতিম কাউকেই বোঝা মনে করা হয় না। কারোর বিয়ে-শ্রাদ্ধের খরচে গোষ্ঠি, পাড়া-প্রতিবেশী একে অপরের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমরা কারোর মনে কষ্ট দিতেও জানিনা, পেতেও জানিনা। এ সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের সমাজে এখনও নেই। যেটুকু আছে সব বাঙালীদের চাপিয়ে দেওয়া। আপনাদের কাছে শেখা...
- তুমি কিন্তু আমাদের ডাইরেক্টলি অপবাদ দিচ্ছ; আমার মনে হয় সবাই তা করে না...
- আমি একক কারোর উপর দোষ চাপাচ্ছি না; একদিন গ্রামে যান, সত্যি কি না দেখে আসবেন..
- তোমাদের অভিযোগগুলো কতটুকু সত্যি আমি জানি না। তবে-
- তুমি এত কথা জান মিতা? প্রশড়ব করে শেফালী। এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিল সবাই। অয়নও অবাক হয় মিতার কথা বার্তা শুনে।
- অবাক হওয়ার কি আছে। আমি লেখা পড়া জানা মেয়ে, বাধ্য হয়েই অনেক কিছু শিখে নিতে হয়। চল্- উঠে পড়ি, আজ আর ভাল লাগছে না।’
- ঠিক আছে, চল। বাকী সব পরে শুনবো। অয়নের কথায় তারা যখন উঠতে যাচ্ছে ঠিক তখনই

ছাত্রদের মধ্যে কোন্দলে দৌঁড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। হাতে লাঠি সোটা নিয়ে এদিকেই এক দল আরেক দলের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। অয়ন তাড়াতাড়ি করে শেফালী আর মিতাকে টেনে হিঁচড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে তাদের বাসায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে।
-ধন্যবাদ অয়ন ভাই, আজ আপনি না থাকলে আমাদের যে কী হতো.. মিতার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে।
- অনেকদিন পরে এলি, কতদিন থাকবিরে শালি..। ছড়া কাটে মিতার দুলাভাই। ঢাকায় গেলি কাঁদতে কাঁদতে, ফিরে এলি হাসতে হাসতে..। অনেক ফর্সা হয়ে গেছিস্, সিনেমার নায়িকাদের মত তোকে খুব সুন্দর লাগছে, আফসোস্! কেন যে তোর দিদিকে বিয়ে করেছিলাম। তোকে কে গাড়িতে উঠিয়ে দিল রে..


ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করে মিতাও অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। মিতা উত্তর দেয়- আমি এলাম আর অমনি ঝগড়ার তাল শুরু করেছ, কেন আমি থাকলে বুঝি তোমার সমস্যা হয়..। প্রতি উত্তরে কি যেন বলতে যাচ্ছিল দুলাভাই ঠিক তখনই মিতার গলা শুনে তার মা সামনে এগিয়ে এলেন।
- ঘরে আসতে না আসতেই শালী-দুলাভাইয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল, না? হাতের ব্যাগ-ট্যাগ রেখে হাতমুখ ধুয়ে নে..।
- যাচ্ছি মা, কিন্তু তোমরা সবাই মিলে দুলাভাইয়ের স্বভাবটাকে ঠিক করতে পারলে না..।

দুলাভাইয়ের উদ্দেশ্যে ভেংচি কেটে ভেতরে যায় মিতা। রাতে আদিবাসিদের প্রিয় বহু পদের তরকারীর আয়োজন। অনেকদিন পর তৃপ্তি সহকারে খেল মিতা। সারাদিন জার্নি করে খুব ক্লান্ত লাগছে অথচ অনেক্ষণ শুয়ে থেকেও ঘুম আসছে না। চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। শুধু এপাশ-ওপাশ করে। ঘন ঘন হাই ওঠে দু’চোখে জল ভরে উঠছে আর জ্বলছে। মিতার মনে হচ্ছে- এক বছরেই বাবার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। মা অবশ্য আগের মতই; চটপটে স্বভাব। বোধ হয় দুলা-ভাইয়ের বেশ খাটুনি যাচ্ছে অথবা টেনশানে আছেন। বড় বোন সন্তান সম্ভবা। হিসাব ঠিক থাকলে আগামী মাস দেড়েকের মধ্যে একটা মেয়ে হবে।
- মা ঘুমিয়েছিস্..? বাবার চিরাচরিত শান্ত গলা, বারান্দায় থেকে প্রশ্ন করেন।
- না বাবা, ঘুমাইনি, ঘুম আসছে না। এসো..
- আমি তোমার নানীর বাড়ী যেতে চাচ্ছি। তোমার জ্যেঠির মেজো মেয়ের বিয়ে ঠিক হচ্ছে, তাই নিয়ে আলোচনায় বসবো।
- একটু বসে যাও বাবা। দরজা খুলে দেয় মিতা।
- অনেক বড় হয়ে গেলি রে মা ...।
বাবা চেয়ারে বসতে বসতে অনুযোগের সুরে বললেন। কিন্তু কেন, তা হঠাৎ করে মিতা বুঝতে পারছে না। বাবার কথা বলার স্বর আজ অন্য রকম লাগল। থতমত খেয়ে যায় মিতা।
- কেন কী হয়েছে বাবা?
- আজ যে এসে তোর এই বুড়ো ছেলের খোঁজও নিলি না..
- ইয়ে বাবা, মানে- তখনতো তুমি ছিলে না বাবা। মা’ৱ’র কাছে গিয়ে দেখ, তোমার জন্য আজকের পেপার নিয়ে এসেছি; আর সাথে রবি ঠাকুরের উপন্যাস...
- ঠিক আছে মা, তুমি বিশ্রাম নাও, ওরা আবার আমার জন্য রাত জেগে বসে থাকবে।

বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাবা। ঘুম আসে না মিতার। চোখের সামনে ছবির মত ভাসতে থাকে কিছুদিন আগের ঘটনা। বান্ধবীদের নিয়ে বাসে চেপে ক্লাশে যাচ্ছিল মিতা। ভাড়া চাইতে এসে কণ্ট্রাক্টর তাচ্ছিল্যের সুরে বলছিল -ওই গারো আফা, ভারা দ্যান তারাতারি..

কণ্ট্রাক্টরের ধৃষ্টতা দেখে মিতা রাগে ফেটে পড়ছিল। মিতাকে অবাক করে দিয়ে পেছন থেকে অয়ন ঠাস্ করে কণ্ট্রাক্টরের গালে চড় মেরে দিল। বেচারার চোখ দিয়ে দর-দর করে পানি পড়ছে। এমনটি হবে আশা করেনি সে। চড় খাওয়া গালটা টক-টকে লাল হয়ে গেল। উচিত শিক্ষা হয়েছে। মিতার ধারনা, সেদিনের কথায় অয়ন বোধহয় এ কাজটি করে আদিবাসীদের কাছে বাঙালীদের দায় কিছুটা সারল। আদিবাসিদের সাথে যারা এমন আচরণ করে তাদের সবার গালে যদি চড় মারা যেতো...।

ঠিক তার দু’দিন পরের ঘটনা। ক্লাশে যাওয়ার পথে পাতা বাহারের ঝোঁপ থেকে বেড়িয়ে একটা গোখরো সাপ ফণা ধরেছে। মিতা প্রচন্ড ভয় পেয়ে পেছাতে গিয়ে পড়ে অয়নের বুকে। এভাবে সে কতক্ষণ ছিল কে জানে। শেফালী যখন মিতাকে টেনে নিয়ে গেল তখনই সবার হুঁশ এল। সেদিন ভয় আর লজ্জায় ক্লাশ করা সম্ভব হয়নি মিতার। বাসায় গিয়েও ঘুম হল না। পরদিন ক্লাশে গিয়ে সহপাঠীদের এ মুখ দেখাবে কেমন করে। আবার ভাবতে গিয়ে কখনো কখনো শরীরে কেমন যেন শিহরণ লাগছিল। আর যাই হোক শিহরণ-টিহরণ ভুলে যেতে চায় মিতা। আদর্শ শিক্ষক পিতার সন্তান এমন কোন অসম যোয়াল বাঁধতে চায় না সে। মিতা কখন ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ের ডাকে দরজা খুলে দেখে রোদ ঝল্-মলে সকাল...।

দিন গড়িয়ে গড়িয়ে কয়েকটা বছর চলে গেল। মিতার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পড়াশুনায় উন্নতি করছে। পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা, আচার-ব্যবহার সব কিছুতেই স্মার্টনেস্ চলে এসেছে। তবে উন্নয়ন(?) হয়েছে তার প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রেও। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মিতার অনেক কাছাকাছি আসার অয়নের সুযোগ হয়। পরিণতিতে ‘ইসলাম ধর্ম মতে বিবাহ’। মিতার নামও পরিবর্তন হয়েছে, মিনারা বেগম মিতা।

আদিবাসি মেয়ে বিয়ে করায় বিয়েটা মেনে নিতে পারল না অয়নের পরিবার। তাদের ঘর ছাড়া করেই ছাড়ল ওরা। অথচ ভাগ্য বিড়ম্বিতা নারী, সহজ সরল আদিবাসি মিতা বুঝতেই পারল না- চতুর অয়ন রাজকন্যা আর রাজত্বের আশায় তাকে বিয়ে করেছে। সন্তান পেটে আসায় ফাইনাল ইয়ার শেষ করা হল না। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ফাইনালটা শেষ করার আশা ছিল। কিন্তু সে আশায় গুড়ে-বালি। পর পর দুটি সন্তান এলো মিতার কোলে। অয়নের একার আয়ে ঢাকা শহরে বেশীদিন ভাল থাকা যায় না। সংসারে টানা-পোড়েন শুরু হল। কখন, কোথায় যে তাদের কাছথেকে সুখ নামের পাখিটা উড়ে চলে গেল; তা তাদের দুজনের কেউ টের পেল না। চারজনের সংসারে যখন চাহিদা বেড়ে গেল; ঠিক তখনই অয়ন মিতার কাছে তার ভাগের ওয়ারিশের কথা তোলে।

বলে- ‘তোমাদের না মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ, যাও তোমার বাব-মার কাছথেকে তোমার ভাগের সম্পত্তিটা নিয়ে এসো।’ মিতা উত্তর দেয়, ‘ভুলে গেলে কি করে যে ওরা আমাকে ত্যাজ্য করেছে।’
- তাতে কি হয়েছে, এখনতো আমাদের দুজনের সংসার না, না খেয়ে-পরে, জায়গা-বেজায়গায় পড়ে থাকবো। আমি একা সামাল দিয়ে কুলাতে পারছি না, দেখছ না...?
- কোলের বাচ্চাটা না থাকলে চাকুরী করে আমিওতো তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম...
- মায়ের কাছে গিয়ে মাপ চাপ চেয়ে চেষ্টা করে দেখ না...
- না, আমি সেটা পারব না
- তোমাকে পারতেই হবে, নইলে তোমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রান্তায় পঁচে মরোগে যাও...

মিতা ভাবে, তার ভুলের কারনে ছোট্ট দু’টি শিশুদের মরতে দেওয়া যাবে না। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে রাতের অন্ধকারে মায়ের দারে উপস্থিত হয়। মা রাজি হলেন না, বরং বললেন, ‘তোর বাবা টের পেলে কেটে দু’টুকরো করে ফেলবে তোকে’। শত কষ্ট সত্বেও শুধু গাড়ী ভাড়াটুকু দিয়ে রাতের অন্ধকারেই ফিরিয়ে দিলেন মা। শিক্ষিত আদিবাসীদের অনেকেই এখন মোটামুটি সচেতন। সমাজপতি, গোষ্ঠীর লোকজন প্রতিবাদ করায় এবং দুলাভাই নামকরা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুবাদে তাদের অফিসের আইন বিশেষজ্ঞ-এর সহায়তায় সম্পত্তি রক্ষা হয়ে গেল।

এদিকে ফেরার পর মিতার সাথে অয়নের বিরোধ বাড়ে। একসময় শারিরীক- মানসিক অত্যাচারে রূপ নেয়। শেষে দুজনের মতের মিল না হওয়ায় মিতা হতাশ হয়; অবশেষে চুড়ান্ত তালাকের মাধ্যমে মিতার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
অনুশোচনায়, লজ্জায়, ঘৃণায় আদিবাসী সমাজে ফিরে যায় না মিতা; আর কোনদিন যাবেও না সে। জীবনের সব কিছু ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করে চাকুরীর জন্য অফিসে অফিসে ঘুরে। এক সময় ছোট্ট একটা অস্থায়ী চাকুরী পেয়েও যায় মিতা। তার দুই সন্তানসহ ঢাকা শহরেই ছোট্ট একটি কামরা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে।

কিন্তু বিধি বাম! একসময় তার অফিসেরই বসের কু-নজরে পড়ে। একদিন কোন কুক্ষণে মাতাল বসের দ্বারা লাঞ্চিত হতে হল। লজ্জায়, ঘৃণায়, রাগে, অপমানে চাকুরীটাই ছেড়ে দিতে হল মিতাকে। প্রকৃতির মাঝে আদিবাসি সমাজে থর-থর করে বেড়ে ওঠা, জাতিকে ভালোর দিকে আলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা- তার জীবনে কত বড় অধঃপতন হয়ে গেছে; এখন দুঃখে-কষ্টে থেকে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মিতা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ সংসার সবকিছু ছাড়তে হল; পরিবারের সম্পত্তির মালিকানাও হারাল। মিতা মনে মনে ভাবে, আর কোন আদিবাসী মেয়ে যেন তার মত ভুল না করে। অন্ধকারের পথে মরিচিকার পেছনে যেন আর কেউ না ছুটে...। এই ভুলের কারণে অসহায়ের মত পদে-পদে, ধুকে-ধুকে তাকে মরতে হচ্ছে।

সহপাঠী শেফালীর আশ্রয়ে কয়েক মাস থেকে দ্বিতীয়বার প্রাইভেট ফার্মে টেলিফোন অপারেটরের চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছে। তবে তা অনেক কষ্টে শিষ্টে। ফার্মেরই এক সহকর্মীর সহযোগিতায়। এখানেও খুবই রিস্ক। প্রতি মাসে ঠিক মত বেতন ভাতা দেওয়া হয়না, নানা রকম তাল বাহানা। মিতার চেহারা বেশ সুন্দর আর পরিপাটির কারনে সহকর্মী পুরুষদের চোখগুলো কেমন চক্-চক্ চুক্-চুক্ করে। এটা-সেটার অজুহাতে গা ঘেষার চেষ্টা করে। তবু সমাজ, আত্মীয় স্বজনদের ধিক্কার, সহকর্মীদের রক্তচক্ষু, প্রতিহিংসা, বান্ধবী শেফালীর করুণা আর সন্তানদের করুণ মুখ, ক্ষুধার আহাজারী সবকিছু উপেক্ষা করে কোন রকম ভাবে দিন পার করে নিচ্ছিল মিতা।

ফার্মের বর্ষ পূর্তিতে জমকালো পার্টি দেন বস। পার্টির পর মাসের বেতনটা দেওয়া হবে। মিতার ছেলে মেয়ে দু’টোই অসুস্থ্। ফেরার পথে ঔষধ কিনতে হবে। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে পার্টি শেষ হল। প্রধান ও বিশেষ অতিথিদের আপ্যায়নে মিতাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। অফিসের বস অত্যন্ত খুশী হলেন মিতার দায়িত্ব পালনে। মিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিথিদের সাথে বস বেড়িয়ে গেলেন। কিন্তু মিতার যে আজ টাকার খুবই প্রয়োজন ছিল তা বসকে কোনভাবেই বলার সুযোগ হল না।

পাশের রুমে সহকর্মীদের কথাবার্তা আর হাসা-হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মদ-টদ খেয়ে ওরা মাতাল হয়েছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। মিতা ভাবে, কোন ভাবে যদি কারোর কাছে কিছু টাকা ধার পাওয়া যায়। অন্ততঃ ছেলের জন্য ঔষধের ব্যবস্থা করতে পারবে। ‘মিনহাজ ভাই, আমি মিনারা মিতা, আপনি দয়া করে একটু বাইরে আসবেন?’ ভেতর থেকে কিছুক্ষণ নীরব। কিছুক্ষণ পর অন্য একজনের কন্ঠ, ‘মিতা ভেতরে এসো।’ কিছুটা ইতস্তত করে দরজা খুলে মিতা ভেতরে আসে। ভেতরে আলো- আঁধারী। বাইরের আলো থেকে এসে স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনেকগুলো লোমশ হাত মিতাকে আকড়ে ধরে। কোন ভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না মিতা। ছেলের জন্য যে করেই হোক আজ ঔষধ নিতে হবে। নিজেকে কোন রকম গুছিয়ে এই নরকপুরীথেকে বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে মিতা।

ছেলের জন্য ঔষধ কেনার পর রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে মিতা। রিক্সাগুলো যা আসে সব কটাতেই যাত্রী; কোনটাই খালি আসে না। মিতার শরীর ও মন কোনটাই ভাল লাগছে না। সব কিছুতেই বিরক্তি, অরুচি ধরে যাচ্ছে। সে তন্ময় হয়ে ভাবছিল আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অতীতের সব দূর্ঘটনাগুলোর কথা। হঠাৎ দেখে সামনে মাঝ বয়সী এক রিক্সা-ওয়ালা কলিং বেল বাজাতে বাজাতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। ‘এই রিক্সা...’ বলে ডাকে মিতা। সাথে সাথে পেছনথেকে প্রায় পরিচিত পুরুষ কণ্ঠও ডেকে ওঠে, ‘এই খালি...। ছ্যাৎ করে ওঠে মিতার বুকটা। রিক্সার কথা ভুলে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে- সামনের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে অয়ন। মিতার চোখের সামনে স্পষ্ট রঙিন হয়ে ভাসতে থাকে ফেলে আসা সব সুখময় স্মৃতিগুলো। মূহুর্তের জন্য পৃথিবীর সব দুঃখ-বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিন্তু পাশের সুন্দরী এই মহিলাটি কে! অয়নও কাছে এসে চম্কে ওঠে, ‘তুমি.. মানে...আপনি...। সম্বিৎ ফিরে পায় মিতা। ভেতরে ভেতরে অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে খুব সাবধানে সামলে নিয়ে দু’জনের উদ্দেশ্যে সালাম দিতে ভুল করল না সে। মহিলাটি সন্তান সম্ভবা। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে উত্তরে তিনিও সালাম দিলেন। কিছুটা ইতস্তত করে পাশের মহিলাটিকে দেখিয়ে অয়ন বলে-
- আমি পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি হচ্ছেন আমার স্ত্রী, আর উনি হচ্ছেন মিতা। আর-
- থাক, আমার আর কোন পরিচয় দিতে হবে না...’

হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিল মিতা। অয়ন তাড়াতারী করে মিতাকে ধরে ফেলে; সাথে সাথে অয়নের স্ত্রীও এগিয়ে আসে। বিরম্বনা আর অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন সুন্দরী মহিলাটি। স্বামীর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
- আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উনি অসুস্থ্। এই রিক্সায় উনাকেই উঠিয়ে দাও...
- কিন্তু এভাবে, এ অবস্থায়, রিক্সায় করে তাকে একা পাঠানো কি ঠিক হবে...?
- তাহলে কি করতে চাও তুমি, ঝামেলা বয়ে বাসায় নিয়ে যাবে...
‘আমি একাই যেতে পারব...’ বলেই অবশ শরীরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়ে মিতা। মনে মনে বলে ‘শোন অহঙ্কারিনী, তুমি যে বাসার কথা বললে, সেখানেতো আমারই থাকার কথা ছিল...’।

মহিলাটি কোন কিছু আঁচ করতে পেরেছেন কি-না বুঝা গেল না। ‘তা হলে যান, আমরা যাচ্ছি...’ বলেই অয়নের হাত ধরে টানতে টানতে ভীরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।

রিক্সা-ওয়ালাটা আগেই কেটে পড়েছে। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করে আর কোন লাভ নেই। পায়ে হেঁটেই ফিরতে হবে। কখন যে মেঘ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল; মিতা বুঝতে পারেনি। অবিরাম ঝম্-ঝম্ বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে উচ্চ স্বরে হর্ণ বাজিয়ে নীল রঙের একটা জীপ ছুটে আসছে। আসুক। আজ মিতার রাস্তা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। গাড়ীটা সামনে আসলে ঝাঁপিয়ে সে পড়বে কি না বুঝতে পারছে না। তার তল পেটটা ভীষনভাবে কামড়াচ্ছে। যেন পৃথিবীর সমস্ত ময়লা আবর্জনা ওখানে জমা হয়ে আছে। হাজার মানুষের ক্লান্তি মিতাকে পেয়ে বসেছে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও আজ তার নেই; তবুও শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে হাঁটতে থাকে মিতা।

আধুনিক শহুরে এই পরিবেশের সাথে তাল দিয়ে চলা অনেক কঠিন, অনেক কষ্টের। তার উপর মিতার মত অসহায় অবলা নারীদের পদে-পদে তিলে-তিলে অপমান-অপবাদ সহ্য করতে হয়। এই যুগে ভাল চাকুরী পাওয়াও দুস্কর। কিন্তু এভাবে আর কতদিন, এখন কোথায় কি করবে ভেবে কোন কূল পায় না মিতা। আদিবাসি সমাজে ফিরে যাওয়াও আর সম্ভব নয়। ওই সমাজে আর কেউ তাকে গ্রহণ করবে না। নিজের জাত-ধর্ম সব কিছু ছেড়ে অ-আদিবাসির সাথে চলে আসায় বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার মান-সম্মান খেয়েছে।

মিতা শুনেছে, তারই কারনে আদর্শবাদী শিক্ষক পিতা আত্ম-হত্যা করতে গিয়েছিলেন। অল্পের জন্য বেঁচে থাকলেও আজ তিনি অন্যরকম মানুষ হয়ে গেছেন। দ্বিতীয়বার সেরকম বিড়ম্বনায় ফেলতে চায় না সে। কিন্তু তার অবুঝ সন্তানদের কিভাবে মানুষ করবে সে। সমাজ যা বলার বলেছে, তার ছেলে-মেয়ে দু’টো বড় হলে মাকে কি বলবে। তাদের কছে ‘জন্মদাত্রী মায়ের’ স্থান কোথায় থাকবে। যে মায়ের ভুলের কারণে তাদের করুণ পরিণতি! সন্তানরা কি তাকে ক্ষমা করবে; কিংবা বিধাতা!

এখন সে কোন পথে যাবে, কোন সমাজে যাবে! মাঝে মাঝে আত্ম-হত্যা করতে ইচ্ছে করে। পরের কাছে আর কতই হাত পাতা যায়! হাতে কাজ নেই- বেকার। হাতে যা কিছু সম্বল ছিল, তা দিয়ে সন্তানদের ঔষধ আর খাবার কিনে সব শেষ করেছে। মিতা আজ সারাদিন পায়ে হেঁটে একটা চাকুরী খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে; এবং খুবই ক্লান্ত। বাধ্য হয়ে একটা বাসায় কাজের আশায় ঢুকেছিল। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া আর বাচ্চা দেখার জন্য আয়া নিবে। বাসার মালকিন না থাকার সুযোগে মালিক মিতাকে টেস্ট করে ছাড়লেন।

মিতা ওই বাসাথেকে কিছু টাকা আর তার সাথে ময়লা নিয়ে এসেছে, বাসায় এক ঘন্টা ধরে শাওয়ার ছেড়ে শরীরটা ধুয়েছে, মুছেছে, তবু- ওইসব ময়লা পরিষ্কার হল না। মিতার মনে হচ্ছে- শেফালী বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছে। আজই বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়ে বসবে কি-না বুঝা যাচ্ছে না। মিতার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে, কিন্তু বাচ্চাদের সামনে কাঁদতে পারে না, দুই ঠোঁট চেপে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে সে।

বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে; যেন সে নেশা করেছে- হঠাৎ অদূরে নিজের ছায়া দেখতে পায় মিতা। ছায়াটা বলছে ‘তোর জীবনের সব কিছুই ভুলে ভরা মিতা, ভুলে ভরা তোর জীবন...। সারাটা জীবন এই ভুলের মাশুল তোকে দিতে হবে; ভুলের মাশুল দিতে দিতে তুই শেষ হয়ে যাবি..., তোর মরে যাওয়াই ভাল...। তোর দেখাদেখি আরো অনেক মেয়েই নষ্ট হবে..., তুই মরে যা...।’
- নাহ্- আমি মরে গেলে আমার সন্তানদের কি হবে!
- কেন, না খেয়ে-পরে ওরাও একদিন মরে যাবে, নয়তো বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষা করবে, টোকাই হবে; বড় হলে চোর-গুন্ডা-মাস্তান-বদমাশ হবে...। আর তোর মেয়েটা বেশ্যা...’

‘নাহ্’ - যেন তার গলাটা কেউ চেঁপে ধরেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দর-দর করে সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে মিতার। অনেক কষ্টে অন্যদিকে মুখ ঘুরায় সে। ওদিকেও আর একটা ছায়া; তারই, ‘ভাল-সৎ কোন আদিবাসী মেয়ে যে নিজের জাত ধর্মকে ভালবাসে, সম্মান করে; সে কি অন্য কোন জাতি ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করতে পারে! তবু যদি সুখে থাকতিস্..., তোকে তালাক দিয়েছে..., এবার তোর কি হবে...? প্রতারক! তুই নিজের সাথে প্রতারনা করেছিস্..; নিজের জাতটাকে অপমান করেছিস্..., তোর বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে বেঈমানি করেছিস্...; তাদের আজীবন লালিত স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা সব কিছু ধূলিস্যাত করে দিলি..., তোর মত হতভাগীর মরে যাওয়াই ভাল...। তুই মরে যা...। তোর আদিবাসি সমাজ সান্তনা পাবে...’
‘নাহ্-’ আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরায় মিতা। ‘আদিবাসিদের জীবন-সমাজ-সংসার; প্রকৃতির মত কত সুন্দর! অথচ তুই...। তোর জাতির লোকজন নিজেদের পচাঁনব্বই ভাগ শিক্ষিত বলে দাবী করে...। কিন্তু এমন শিক্ষার কি কোন মূল্য আছে...? যে শিক্ষায় নিজেদের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে হবে...। মিতা তুই এত লেখা পড়া করেছিস..., নিজেদের এই ক্ষুদ্র জাতির জন্য কিছু না করে বরং উল্টোটি করলি...? এই ভাবে নিজের হাতে নিজের জাতটাকে গলা টিপে হত্যা করছিস্... এবার তুইও মরে যা, যা-যা...।’

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায় মিতা। মিতার বাচ্চা দু’টো ভয়ে জোরে জোরে ‘মা, মাগো...’ বলে কান্না-কাটি করছে। বাচ্চাদের কান্না শুনে শেফালী আর তার স্বামী ছুটে এসে হাঁপাচ্ছে। দুজনই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তারা কেউ জানে না, মিতার জ্ঞান ফিরবে কি না..