শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

মিতা-  ফিডেল ডি সাংমা
 সোমবার, 29 আগস্ট 2011 15:53

‘যেখানে ভালবাসা আছে, হৃদয়ের টান আছে, সেখানে সুবিধা-অসুবিধা, লাভ-ক্ষতির ব্যপারটা গৌণ...’
 মিতার কথাগুলো শুনে নড়ে-চড়ে বসে অয়ন। মিতাদের মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ। শুনেই আগ্রহ জন্মে মেধাবী ছাত্র অয়নের। পুরো নাম- মোঃ মতিউর রহমান। মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় মিতা, ‘তা আপনি কি আমাদের নিয়ে থিসিস্ লিখতে চাচ্ছেন না-কী?’
- আচ্ছা মিতা, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সারা বিশ্বের সমাজ চলছে সেখানে তোমাদের মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, কেন? তোমাদের সমাজের পুরুষরাই বা এটাকে কি ভাবে নেয়?
- আমাদের আদি-সমাজ ব্যবস্থাই এমন। আমরা আমাদের জাতটাকে, সমাজকে এবং আদিবাসি সংস্কৃতিকে অন্তর দিয়ে ভালবাসি। পৃথিবীতে মঙ্গোলীয়দের অনেক জাতির মধ্যে এখনও মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ প্রচলিত আছে। এখানে আমাদের আলাদা জাতিসত্ত্বা, আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা; আর এজন্যই আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র বলে দাবী করতে পারি, তাই না?
- হয়তবা পার। কিন্তু এমন হাই থটেরর কথা-বার্তা রেখে একটু সহজ করে বল, শুনি-
- যেমন ধরেন, আমাদের সমাজে যেটুকু জাতীয় মূল্যবোধ এখনও টিকে আছে, তা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। যেমন ধরেন...

মিতার কথায় বাঁধা দেয় অয়ন। ‘থামতো, ধরেন-টরেন, লেন-দেন শব্দগুলো বাদ দাও, না হলে আলাপটা ভাল জমবে না। তারপর তোমাদের জাতীয় মূল্যবোধের বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা দাও।’ - এ ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশের ফাঁকে ওদের আড্ডার শুরু...।

রিতা ও মিতা দুই বোন। মিতা বি.এ অনার্সের ছাত্রী। বাবা-মা অনেক কষ্টে-শিষ্টে পড়তে দিয়েছেন। মিতা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের ফ্যাকালটিতে একমাত্র আদিবাসী মেয়ে। তার ওপর দেখতে মোটামুটি সুন্দরী। দেহের গঠন বাঙালী- আদিবাসীর মাঝামাঝি। প্রথম দেখায় মিতাকে বুঝার উপায় নেই যে সে অবাঙ্গালী। একমাত্র কথা বলার জড়তা ছাড়া। তবুও গলায় মিষ্টি স্বরের কারণে পার পেয়ে যায় সে।

হোষ্টেলে মিতার জায়গা হয়নি; তাই ৪/৫ জন ছাত্রী মিলে একটি মেসে থেকে পড়াশুনা করছে। প্রায়ই একই বাসে করে ক্লাশে যাওয়া-আসা করতে হয়। মিতা ছাড়া তার সহপাঠী সবাই শহুরে। তাদের কোন জড়তা নেই, যখন যা ইচ্ছে করতে পারে, চলতে পারে, বলতে পারে, কিন্তু তা মিতা পারে না। অপরিচিত কারোর সাথে মিশতে বা কথা বলতে দ্বিধাবোধ হয় তার। ছাত্র-ছাত্রী মিলে সবাই যখন আড্ডা-গল্প-ঠাট্টা-হই-হুল্লোড় করে, মিতা তখন থাকে চুপচাপ। মাঝে মধ্যে হু-হাঁ জাতীয় শব্দ দিয়েই চালিয়ে দেয় সে।

মিতার বড় বোন রিতা বিয়ে করে সংসার চালাচ্ছে। তার স্বামীটা একটু গোবেচারা টাইপের; এনজিওতে চাকুরী করে। বাবা স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টারী শেষ করে মোটামুটি ধর্ম-কর্মের দিকে মনযোগ দিয়েছেন। মা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় প্রচন্ডভাবে শূচি-বায়ূগ্রস্থ। মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ ও তার পরিবারের পাক্কা গৃহিনী হয়ে সংসারের যাবতীয় বিষয় দেখা-শুনা করেন। স্বামীর অল্প আয়ের কারণে আর্থিক লেন-দেন, লাভ-লোকসানের হিসাবে বড়ই কড়া মনোভাব।

ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা মোঃ মতিউর রহমানদের পরিবার। অয়ন নামেই সে বেশী পরিচিত। বড় লোকের একমাত্র সন্তান। তাই তার চাল-চলন, ভাব-সাব একটু অন্য রকম। আধুনিক যুগের ছেলে বলতে যা বুঝায়! সহপাঠী শেফালী আক্তারের অয়নের গা ঘেষার বেশ আগ্রহ তা বুঝা যায়। বোধ হয় মনে মনে ভালই বাসে, তবে এক তরফা। অয়ন তাকে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। সেই শেফালী আক্তারের সাথে সাজেশান নিতে গিয়ে অয়নের সাথে পরিচয়। বিশ্ব-বিদ্যালয়ের পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতেই কেটে গেল মিতার একটি বছর। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নতুন আর একটি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল মিতাকে।
‘বাহ্-বাহ্ তোমার হাসি তো খুব সুন্দর, আমি তো কোনদিন খেয়াল করিনি...’ অয়নের এমন উক্তি শুনে লজ্জা পায় মিতা। সে কোন রকমে বলে- চলুন, উঠে পড়ি। এই শেফালী, চল্..।
‘আরে না না, তোমাদের জাতীয় মূল্যবোধের বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করে বলবে না?’ আবার আদিবাসি বিষয়েই কথা তোলে অয়ন। ‘এই শেফালী বস তো। আজ খুব সুন্দর বাতাস, বসে আড্ডা দিয়ে তোমার কথা শুনতে ভাল লাগছে...’ শেফালী উঠতে যাচ্ছিল, তাই হাতটা ধরে বসিয়ে দেয় অয়ন। ‘তা হলে একটু পরেই যাই। আমারও তোমার কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছে..।’ অনেক্ষণ পর কথা বলল শেফালী। মিতা শুরু করে...
- আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কোন লিখিত বিধি-বিধান নেই; তবে এর প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। মুখে মুখে প্রচলিত সামাজিক নিয়ম-নীতি এবং সংস্কৃতিতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা চলে। আপনাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে অনেক তফাৎ।
- যেমন...?
- বলছি, আমাদের সমাজে বড়দের সম্মান এবং ছোটদের আদর-স্নেহ- ভালবাসার ধরণ দেখলে আপনারা অবাক হবেন। আপনারা সংখ্যাগুরু মানুষরা আমাদের ক্ষুদ্র জাতীদের সব কিছু অতি ছোট- ক্ষুদ্র বলেই মনে করেন। তুচ্ছ্ব-তাচ্ছিল্য করেন। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার সব কিছু বাঁকা চোখে দেখেন। অনেক সময় আমাদের এ সব বিষয়গুলো আপনাদের কাছে নিন্দনীয়, হাসির পাত্র, করুণার বিষয়। কিন্তু দেখেন, আমাদের এসব কিছুর মূলে আছে আমাদের সারল্য-সততা। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি শোষন-নির্যাতন-যন্ত্রণার করুণ কাহিনী। আমাদের সমাজে যেমন তালাক-যৌতুক নেই, তেমনি প্রতারণা, স্বার্থপরতা, হিংসা-নিন্দা, ঘুষ-শোষন-নির্যাতন, ডাকাত, ধর্ষণ, বলাৎকার, এ জাতীয় শব্দের কোন প্রতিশব্দ নেই; ব্যবহারও নেই। পাশের বাড়ীর কেউ না খেয়ে থাকে না। বৃদ্ধ বাবা-মা, ময়-মুরুব্বী, পঙ্গু- এতিম কাউকেই বোঝা মনে করা হয় না। কারোর বিয়ে-শ্রাদ্ধের খরচে গোষ্ঠি, পাড়া-প্রতিবেশী একে অপরের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমরা কারোর মনে কষ্ট দিতেও জানিনা, পেতেও জানিনা। এ সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের সমাজে এখনও নেই। যেটুকু আছে সব বাঙালীদের চাপিয়ে দেওয়া। আপনাদের কাছে শেখা...
- তুমি কিন্তু আমাদের ডাইরেক্টলি অপবাদ দিচ্ছ; আমার মনে হয় সবাই তা করে না...
- আমি একক কারোর উপর দোষ চাপাচ্ছি না; একদিন গ্রামে যান, সত্যি কি না দেখে আসবেন..
- তোমাদের অভিযোগগুলো কতটুকু সত্যি আমি জানি না। তবে-
- তুমি এত কথা জান মিতা? প্রশড়ব করে শেফালী। এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিল সবাই। অয়নও অবাক হয় মিতার কথা বার্তা শুনে।
- অবাক হওয়ার কি আছে। আমি লেখা পড়া জানা মেয়ে, বাধ্য হয়েই অনেক কিছু শিখে নিতে হয়। চল্- উঠে পড়ি, আজ আর ভাল লাগছে না।’
- ঠিক আছে, চল। বাকী সব পরে শুনবো। অয়নের কথায় তারা যখন উঠতে যাচ্ছে ঠিক তখনই

ছাত্রদের মধ্যে কোন্দলে দৌঁড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। হাতে লাঠি সোটা নিয়ে এদিকেই এক দল আরেক দলের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। অয়ন তাড়াতাড়ি করে শেফালী আর মিতাকে টেনে হিঁচড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে তাদের বাসায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে।
-ধন্যবাদ অয়ন ভাই, আজ আপনি না থাকলে আমাদের যে কী হতো.. মিতার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে।
- অনেকদিন পরে এলি, কতদিন থাকবিরে শালি..। ছড়া কাটে মিতার দুলাভাই। ঢাকায় গেলি কাঁদতে কাঁদতে, ফিরে এলি হাসতে হাসতে..। অনেক ফর্সা হয়ে গেছিস্, সিনেমার নায়িকাদের মত তোকে খুব সুন্দর লাগছে, আফসোস্! কেন যে তোর দিদিকে বিয়ে করেছিলাম। তোকে কে গাড়িতে উঠিয়ে দিল রে..


ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করে মিতাও অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। মিতা উত্তর দেয়- আমি এলাম আর অমনি ঝগড়ার তাল শুরু করেছ, কেন আমি থাকলে বুঝি তোমার সমস্যা হয়..। প্রতি উত্তরে কি যেন বলতে যাচ্ছিল দুলাভাই ঠিক তখনই মিতার গলা শুনে তার মা সামনে এগিয়ে এলেন।
- ঘরে আসতে না আসতেই শালী-দুলাভাইয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল, না? হাতের ব্যাগ-ট্যাগ রেখে হাতমুখ ধুয়ে নে..।
- যাচ্ছি মা, কিন্তু তোমরা সবাই মিলে দুলাভাইয়ের স্বভাবটাকে ঠিক করতে পারলে না..।

দুলাভাইয়ের উদ্দেশ্যে ভেংচি কেটে ভেতরে যায় মিতা। রাতে আদিবাসিদের প্রিয় বহু পদের তরকারীর আয়োজন। অনেকদিন পর তৃপ্তি সহকারে খেল মিতা। সারাদিন জার্নি করে খুব ক্লান্ত লাগছে অথচ অনেক্ষণ শুয়ে থেকেও ঘুম আসছে না। চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। শুধু এপাশ-ওপাশ করে। ঘন ঘন হাই ওঠে দু’চোখে জল ভরে উঠছে আর জ্বলছে। মিতার মনে হচ্ছে- এক বছরেই বাবার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। মা অবশ্য আগের মতই; চটপটে স্বভাব। বোধ হয় দুলা-ভাইয়ের বেশ খাটুনি যাচ্ছে অথবা টেনশানে আছেন। বড় বোন সন্তান সম্ভবা। হিসাব ঠিক থাকলে আগামী মাস দেড়েকের মধ্যে একটা মেয়ে হবে।
- মা ঘুমিয়েছিস্..? বাবার চিরাচরিত শান্ত গলা, বারান্দায় থেকে প্রশ্ন করেন।
- না বাবা, ঘুমাইনি, ঘুম আসছে না। এসো..
- আমি তোমার নানীর বাড়ী যেতে চাচ্ছি। তোমার জ্যেঠির মেজো মেয়ের বিয়ে ঠিক হচ্ছে, তাই নিয়ে আলোচনায় বসবো।
- একটু বসে যাও বাবা। দরজা খুলে দেয় মিতা।
- অনেক বড় হয়ে গেলি রে মা ...।
বাবা চেয়ারে বসতে বসতে অনুযোগের সুরে বললেন। কিন্তু কেন, তা হঠাৎ করে মিতা বুঝতে পারছে না। বাবার কথা বলার স্বর আজ অন্য রকম লাগল। থতমত খেয়ে যায় মিতা।
- কেন কী হয়েছে বাবা?
- আজ যে এসে তোর এই বুড়ো ছেলের খোঁজও নিলি না..
- ইয়ে বাবা, মানে- তখনতো তুমি ছিলে না বাবা। মা’ৱ’র কাছে গিয়ে দেখ, তোমার জন্য আজকের পেপার নিয়ে এসেছি; আর সাথে রবি ঠাকুরের উপন্যাস...
- ঠিক আছে মা, তুমি বিশ্রাম নাও, ওরা আবার আমার জন্য রাত জেগে বসে থাকবে।

বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাবা। ঘুম আসে না মিতার। চোখের সামনে ছবির মত ভাসতে থাকে কিছুদিন আগের ঘটনা। বান্ধবীদের নিয়ে বাসে চেপে ক্লাশে যাচ্ছিল মিতা। ভাড়া চাইতে এসে কণ্ট্রাক্টর তাচ্ছিল্যের সুরে বলছিল -ওই গারো আফা, ভারা দ্যান তারাতারি..

কণ্ট্রাক্টরের ধৃষ্টতা দেখে মিতা রাগে ফেটে পড়ছিল। মিতাকে অবাক করে দিয়ে পেছন থেকে অয়ন ঠাস্ করে কণ্ট্রাক্টরের গালে চড় মেরে দিল। বেচারার চোখ দিয়ে দর-দর করে পানি পড়ছে। এমনটি হবে আশা করেনি সে। চড় খাওয়া গালটা টক-টকে লাল হয়ে গেল। উচিত শিক্ষা হয়েছে। মিতার ধারনা, সেদিনের কথায় অয়ন বোধহয় এ কাজটি করে আদিবাসীদের কাছে বাঙালীদের দায় কিছুটা সারল। আদিবাসিদের সাথে যারা এমন আচরণ করে তাদের সবার গালে যদি চড় মারা যেতো...।

ঠিক তার দু’দিন পরের ঘটনা। ক্লাশে যাওয়ার পথে পাতা বাহারের ঝোঁপ থেকে বেড়িয়ে একটা গোখরো সাপ ফণা ধরেছে। মিতা প্রচন্ড ভয় পেয়ে পেছাতে গিয়ে পড়ে অয়নের বুকে। এভাবে সে কতক্ষণ ছিল কে জানে। শেফালী যখন মিতাকে টেনে নিয়ে গেল তখনই সবার হুঁশ এল। সেদিন ভয় আর লজ্জায় ক্লাশ করা সম্ভব হয়নি মিতার। বাসায় গিয়েও ঘুম হল না। পরদিন ক্লাশে গিয়ে সহপাঠীদের এ মুখ দেখাবে কেমন করে। আবার ভাবতে গিয়ে কখনো কখনো শরীরে কেমন যেন শিহরণ লাগছিল। আর যাই হোক শিহরণ-টিহরণ ভুলে যেতে চায় মিতা। আদর্শ শিক্ষক পিতার সন্তান এমন কোন অসম যোয়াল বাঁধতে চায় না সে। মিতা কখন ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ের ডাকে দরজা খুলে দেখে রোদ ঝল্-মলে সকাল...।

দিন গড়িয়ে গড়িয়ে কয়েকটা বছর চলে গেল। মিতার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পড়াশুনায় উন্নতি করছে। পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা, আচার-ব্যবহার সব কিছুতেই স্মার্টনেস্ চলে এসেছে। তবে উন্নয়ন(?) হয়েছে তার প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রেও। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মিতার অনেক কাছাকাছি আসার অয়নের সুযোগ হয়। পরিণতিতে ‘ইসলাম ধর্ম মতে বিবাহ’। মিতার নামও পরিবর্তন হয়েছে, মিনারা বেগম মিতা।

আদিবাসি মেয়ে বিয়ে করায় বিয়েটা মেনে নিতে পারল না অয়নের পরিবার। তাদের ঘর ছাড়া করেই ছাড়ল ওরা। অথচ ভাগ্য বিড়ম্বিতা নারী, সহজ সরল আদিবাসি মিতা বুঝতেই পারল না- চতুর অয়ন রাজকন্যা আর রাজত্বের আশায় তাকে বিয়ে করেছে। সন্তান পেটে আসায় ফাইনাল ইয়ার শেষ করা হল না। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ফাইনালটা শেষ করার আশা ছিল। কিন্তু সে আশায় গুড়ে-বালি। পর পর দুটি সন্তান এলো মিতার কোলে। অয়নের একার আয়ে ঢাকা শহরে বেশীদিন ভাল থাকা যায় না। সংসারে টানা-পোড়েন শুরু হল। কখন, কোথায় যে তাদের কাছথেকে সুখ নামের পাখিটা উড়ে চলে গেল; তা তাদের দুজনের কেউ টের পেল না। চারজনের সংসারে যখন চাহিদা বেড়ে গেল; ঠিক তখনই অয়ন মিতার কাছে তার ভাগের ওয়ারিশের কথা তোলে।

বলে- ‘তোমাদের না মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ, যাও তোমার বাব-মার কাছথেকে তোমার ভাগের সম্পত্তিটা নিয়ে এসো।’ মিতা উত্তর দেয়, ‘ভুলে গেলে কি করে যে ওরা আমাকে ত্যাজ্য করেছে।’
- তাতে কি হয়েছে, এখনতো আমাদের দুজনের সংসার না, না খেয়ে-পরে, জায়গা-বেজায়গায় পড়ে থাকবো। আমি একা সামাল দিয়ে কুলাতে পারছি না, দেখছ না...?
- কোলের বাচ্চাটা না থাকলে চাকুরী করে আমিওতো তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম...
- মায়ের কাছে গিয়ে মাপ চাপ চেয়ে চেষ্টা করে দেখ না...
- না, আমি সেটা পারব না
- তোমাকে পারতেই হবে, নইলে তোমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রান্তায় পঁচে মরোগে যাও...

মিতা ভাবে, তার ভুলের কারনে ছোট্ট দু’টি শিশুদের মরতে দেওয়া যাবে না। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে রাতের অন্ধকারে মায়ের দারে উপস্থিত হয়। মা রাজি হলেন না, বরং বললেন, ‘তোর বাবা টের পেলে কেটে দু’টুকরো করে ফেলবে তোকে’। শত কষ্ট সত্বেও শুধু গাড়ী ভাড়াটুকু দিয়ে রাতের অন্ধকারেই ফিরিয়ে দিলেন মা। শিক্ষিত আদিবাসীদের অনেকেই এখন মোটামুটি সচেতন। সমাজপতি, গোষ্ঠীর লোকজন প্রতিবাদ করায় এবং দুলাভাই নামকরা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুবাদে তাদের অফিসের আইন বিশেষজ্ঞ-এর সহায়তায় সম্পত্তি রক্ষা হয়ে গেল।

এদিকে ফেরার পর মিতার সাথে অয়নের বিরোধ বাড়ে। একসময় শারিরীক- মানসিক অত্যাচারে রূপ নেয়। শেষে দুজনের মতের মিল না হওয়ায় মিতা হতাশ হয়; অবশেষে চুড়ান্ত তালাকের মাধ্যমে মিতার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
অনুশোচনায়, লজ্জায়, ঘৃণায় আদিবাসী সমাজে ফিরে যায় না মিতা; আর কোনদিন যাবেও না সে। জীবনের সব কিছু ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করে চাকুরীর জন্য অফিসে অফিসে ঘুরে। এক সময় ছোট্ট একটা অস্থায়ী চাকুরী পেয়েও যায় মিতা। তার দুই সন্তানসহ ঢাকা শহরেই ছোট্ট একটি কামরা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে।

কিন্তু বিধি বাম! একসময় তার অফিসেরই বসের কু-নজরে পড়ে। একদিন কোন কুক্ষণে মাতাল বসের দ্বারা লাঞ্চিত হতে হল। লজ্জায়, ঘৃণায়, রাগে, অপমানে চাকুরীটাই ছেড়ে দিতে হল মিতাকে। প্রকৃতির মাঝে আদিবাসি সমাজে থর-থর করে বেড়ে ওঠা, জাতিকে ভালোর দিকে আলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা- তার জীবনে কত বড় অধঃপতন হয়ে গেছে; এখন দুঃখে-কষ্টে থেকে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মিতা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ সংসার সবকিছু ছাড়তে হল; পরিবারের সম্পত্তির মালিকানাও হারাল। মিতা মনে মনে ভাবে, আর কোন আদিবাসী মেয়ে যেন তার মত ভুল না করে। অন্ধকারের পথে মরিচিকার পেছনে যেন আর কেউ না ছুটে...। এই ভুলের কারণে অসহায়ের মত পদে-পদে, ধুকে-ধুকে তাকে মরতে হচ্ছে।

সহপাঠী শেফালীর আশ্রয়ে কয়েক মাস থেকে দ্বিতীয়বার প্রাইভেট ফার্মে টেলিফোন অপারেটরের চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছে। তবে তা অনেক কষ্টে শিষ্টে। ফার্মেরই এক সহকর্মীর সহযোগিতায়। এখানেও খুবই রিস্ক। প্রতি মাসে ঠিক মত বেতন ভাতা দেওয়া হয়না, নানা রকম তাল বাহানা। মিতার চেহারা বেশ সুন্দর আর পরিপাটির কারনে সহকর্মী পুরুষদের চোখগুলো কেমন চক্-চক্ চুক্-চুক্ করে। এটা-সেটার অজুহাতে গা ঘেষার চেষ্টা করে। তবু সমাজ, আত্মীয় স্বজনদের ধিক্কার, সহকর্মীদের রক্তচক্ষু, প্রতিহিংসা, বান্ধবী শেফালীর করুণা আর সন্তানদের করুণ মুখ, ক্ষুধার আহাজারী সবকিছু উপেক্ষা করে কোন রকম ভাবে দিন পার করে নিচ্ছিল মিতা।

ফার্মের বর্ষ পূর্তিতে জমকালো পার্টি দেন বস। পার্টির পর মাসের বেতনটা দেওয়া হবে। মিতার ছেলে মেয়ে দু’টোই অসুস্থ্। ফেরার পথে ঔষধ কিনতে হবে। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে পার্টি শেষ হল। প্রধান ও বিশেষ অতিথিদের আপ্যায়নে মিতাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। অফিসের বস অত্যন্ত খুশী হলেন মিতার দায়িত্ব পালনে। মিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিথিদের সাথে বস বেড়িয়ে গেলেন। কিন্তু মিতার যে আজ টাকার খুবই প্রয়োজন ছিল তা বসকে কোনভাবেই বলার সুযোগ হল না।

পাশের রুমে সহকর্মীদের কথাবার্তা আর হাসা-হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মদ-টদ খেয়ে ওরা মাতাল হয়েছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। মিতা ভাবে, কোন ভাবে যদি কারোর কাছে কিছু টাকা ধার পাওয়া যায়। অন্ততঃ ছেলের জন্য ঔষধের ব্যবস্থা করতে পারবে। ‘মিনহাজ ভাই, আমি মিনারা মিতা, আপনি দয়া করে একটু বাইরে আসবেন?’ ভেতর থেকে কিছুক্ষণ নীরব। কিছুক্ষণ পর অন্য একজনের কন্ঠ, ‘মিতা ভেতরে এসো।’ কিছুটা ইতস্তত করে দরজা খুলে মিতা ভেতরে আসে। ভেতরে আলো- আঁধারী। বাইরের আলো থেকে এসে স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনেকগুলো লোমশ হাত মিতাকে আকড়ে ধরে। কোন ভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না মিতা। ছেলের জন্য যে করেই হোক আজ ঔষধ নিতে হবে। নিজেকে কোন রকম গুছিয়ে এই নরকপুরীথেকে বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে মিতা।

ছেলের জন্য ঔষধ কেনার পর রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে মিতা। রিক্সাগুলো যা আসে সব কটাতেই যাত্রী; কোনটাই খালি আসে না। মিতার শরীর ও মন কোনটাই ভাল লাগছে না। সব কিছুতেই বিরক্তি, অরুচি ধরে যাচ্ছে। সে তন্ময় হয়ে ভাবছিল আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অতীতের সব দূর্ঘটনাগুলোর কথা। হঠাৎ দেখে সামনে মাঝ বয়সী এক রিক্সা-ওয়ালা কলিং বেল বাজাতে বাজাতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। ‘এই রিক্সা...’ বলে ডাকে মিতা। সাথে সাথে পেছনথেকে প্রায় পরিচিত পুরুষ কণ্ঠও ডেকে ওঠে, ‘এই খালি...। ছ্যাৎ করে ওঠে মিতার বুকটা। রিক্সার কথা ভুলে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে- সামনের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে অয়ন। মিতার চোখের সামনে স্পষ্ট রঙিন হয়ে ভাসতে থাকে ফেলে আসা সব সুখময় স্মৃতিগুলো। মূহুর্তের জন্য পৃথিবীর সব দুঃখ-বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিন্তু পাশের সুন্দরী এই মহিলাটি কে! অয়নও কাছে এসে চম্কে ওঠে, ‘তুমি.. মানে...আপনি...। সম্বিৎ ফিরে পায় মিতা। ভেতরে ভেতরে অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে খুব সাবধানে সামলে নিয়ে দু’জনের উদ্দেশ্যে সালাম দিতে ভুল করল না সে। মহিলাটি সন্তান সম্ভবা। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে উত্তরে তিনিও সালাম দিলেন। কিছুটা ইতস্তত করে পাশের মহিলাটিকে দেখিয়ে অয়ন বলে-
- আমি পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি হচ্ছেন আমার স্ত্রী, আর উনি হচ্ছেন মিতা। আর-
- থাক, আমার আর কোন পরিচয় দিতে হবে না...’

হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিল মিতা। অয়ন তাড়াতারী করে মিতাকে ধরে ফেলে; সাথে সাথে অয়নের স্ত্রীও এগিয়ে আসে। বিরম্বনা আর অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন সুন্দরী মহিলাটি। স্বামীর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
- আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উনি অসুস্থ্। এই রিক্সায় উনাকেই উঠিয়ে দাও...
- কিন্তু এভাবে, এ অবস্থায়, রিক্সায় করে তাকে একা পাঠানো কি ঠিক হবে...?
- তাহলে কি করতে চাও তুমি, ঝামেলা বয়ে বাসায় নিয়ে যাবে...
‘আমি একাই যেতে পারব...’ বলেই অবশ শরীরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়ে মিতা। মনে মনে বলে ‘শোন অহঙ্কারিনী, তুমি যে বাসার কথা বললে, সেখানেতো আমারই থাকার কথা ছিল...’।

মহিলাটি কোন কিছু আঁচ করতে পেরেছেন কি-না বুঝা গেল না। ‘তা হলে যান, আমরা যাচ্ছি...’ বলেই অয়নের হাত ধরে টানতে টানতে ভীরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।

রিক্সা-ওয়ালাটা আগেই কেটে পড়েছে। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করে আর কোন লাভ নেই। পায়ে হেঁটেই ফিরতে হবে। কখন যে মেঘ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল; মিতা বুঝতে পারেনি। অবিরাম ঝম্-ঝম্ বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে উচ্চ স্বরে হর্ণ বাজিয়ে নীল রঙের একটা জীপ ছুটে আসছে। আসুক। আজ মিতার রাস্তা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। গাড়ীটা সামনে আসলে ঝাঁপিয়ে সে পড়বে কি না বুঝতে পারছে না। তার তল পেটটা ভীষনভাবে কামড়াচ্ছে। যেন পৃথিবীর সমস্ত ময়লা আবর্জনা ওখানে জমা হয়ে আছে। হাজার মানুষের ক্লান্তি মিতাকে পেয়ে বসেছে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও আজ তার নেই; তবুও শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে হাঁটতে থাকে মিতা।

আধুনিক শহুরে এই পরিবেশের সাথে তাল দিয়ে চলা অনেক কঠিন, অনেক কষ্টের। তার উপর মিতার মত অসহায় অবলা নারীদের পদে-পদে তিলে-তিলে অপমান-অপবাদ সহ্য করতে হয়। এই যুগে ভাল চাকুরী পাওয়াও দুস্কর। কিন্তু এভাবে আর কতদিন, এখন কোথায় কি করবে ভেবে কোন কূল পায় না মিতা। আদিবাসি সমাজে ফিরে যাওয়াও আর সম্ভব নয়। ওই সমাজে আর কেউ তাকে গ্রহণ করবে না। নিজের জাত-ধর্ম সব কিছু ছেড়ে অ-আদিবাসির সাথে চলে আসায় বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার মান-সম্মান খেয়েছে।

মিতা শুনেছে, তারই কারনে আদর্শবাদী শিক্ষক পিতা আত্ম-হত্যা করতে গিয়েছিলেন। অল্পের জন্য বেঁচে থাকলেও আজ তিনি অন্যরকম মানুষ হয়ে গেছেন। দ্বিতীয়বার সেরকম বিড়ম্বনায় ফেলতে চায় না সে। কিন্তু তার অবুঝ সন্তানদের কিভাবে মানুষ করবে সে। সমাজ যা বলার বলেছে, তার ছেলে-মেয়ে দু’টো বড় হলে মাকে কি বলবে। তাদের কছে ‘জন্মদাত্রী মায়ের’ স্থান কোথায় থাকবে। যে মায়ের ভুলের কারণে তাদের করুণ পরিণতি! সন্তানরা কি তাকে ক্ষমা করবে; কিংবা বিধাতা!

এখন সে কোন পথে যাবে, কোন সমাজে যাবে! মাঝে মাঝে আত্ম-হত্যা করতে ইচ্ছে করে। পরের কাছে আর কতই হাত পাতা যায়! হাতে কাজ নেই- বেকার। হাতে যা কিছু সম্বল ছিল, তা দিয়ে সন্তানদের ঔষধ আর খাবার কিনে সব শেষ করেছে। মিতা আজ সারাদিন পায়ে হেঁটে একটা চাকুরী খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে; এবং খুবই ক্লান্ত। বাধ্য হয়ে একটা বাসায় কাজের আশায় ঢুকেছিল। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া আর বাচ্চা দেখার জন্য আয়া নিবে। বাসার মালকিন না থাকার সুযোগে মালিক মিতাকে টেস্ট করে ছাড়লেন।

মিতা ওই বাসাথেকে কিছু টাকা আর তার সাথে ময়লা নিয়ে এসেছে, বাসায় এক ঘন্টা ধরে শাওয়ার ছেড়ে শরীরটা ধুয়েছে, মুছেছে, তবু- ওইসব ময়লা পরিষ্কার হল না। মিতার মনে হচ্ছে- শেফালী বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছে। আজই বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়ে বসবে কি-না বুঝা যাচ্ছে না। মিতার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে, কিন্তু বাচ্চাদের সামনে কাঁদতে পারে না, দুই ঠোঁট চেপে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে সে।

বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে; যেন সে নেশা করেছে- হঠাৎ অদূরে নিজের ছায়া দেখতে পায় মিতা। ছায়াটা বলছে ‘তোর জীবনের সব কিছুই ভুলে ভরা মিতা, ভুলে ভরা তোর জীবন...। সারাটা জীবন এই ভুলের মাশুল তোকে দিতে হবে; ভুলের মাশুল দিতে দিতে তুই শেষ হয়ে যাবি..., তোর মরে যাওয়াই ভাল...। তোর দেখাদেখি আরো অনেক মেয়েই নষ্ট হবে..., তুই মরে যা...।’
- নাহ্- আমি মরে গেলে আমার সন্তানদের কি হবে!
- কেন, না খেয়ে-পরে ওরাও একদিন মরে যাবে, নয়তো বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষা করবে, টোকাই হবে; বড় হলে চোর-গুন্ডা-মাস্তান-বদমাশ হবে...। আর তোর মেয়েটা বেশ্যা...’

‘নাহ্’ - যেন তার গলাটা কেউ চেঁপে ধরেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দর-দর করে সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে মিতার। অনেক কষ্টে অন্যদিকে মুখ ঘুরায় সে। ওদিকেও আর একটা ছায়া; তারই, ‘ভাল-সৎ কোন আদিবাসী মেয়ে যে নিজের জাত ধর্মকে ভালবাসে, সম্মান করে; সে কি অন্য কোন জাতি ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করতে পারে! তবু যদি সুখে থাকতিস্..., তোকে তালাক দিয়েছে..., এবার তোর কি হবে...? প্রতারক! তুই নিজের সাথে প্রতারনা করেছিস্..; নিজের জাতটাকে অপমান করেছিস্..., তোর বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে বেঈমানি করেছিস্...; তাদের আজীবন লালিত স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা সব কিছু ধূলিস্যাত করে দিলি..., তোর মত হতভাগীর মরে যাওয়াই ভাল...। তুই মরে যা...। তোর আদিবাসি সমাজ সান্তনা পাবে...’
‘নাহ্-’ আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরায় মিতা। ‘আদিবাসিদের জীবন-সমাজ-সংসার; প্রকৃতির মত কত সুন্দর! অথচ তুই...। তোর জাতির লোকজন নিজেদের পচাঁনব্বই ভাগ শিক্ষিত বলে দাবী করে...। কিন্তু এমন শিক্ষার কি কোন মূল্য আছে...? যে শিক্ষায় নিজেদের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে হবে...। মিতা তুই এত লেখা পড়া করেছিস..., নিজেদের এই ক্ষুদ্র জাতির জন্য কিছু না করে বরং উল্টোটি করলি...? এই ভাবে নিজের হাতে নিজের জাতটাকে গলা টিপে হত্যা করছিস্... এবার তুইও মরে যা, যা-যা...।’

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায় মিতা। মিতার বাচ্চা দু’টো ভয়ে জোরে জোরে ‘মা, মাগো...’ বলে কান্না-কাটি করছে। বাচ্চাদের কান্না শুনে শেফালী আর তার স্বামী ছুটে এসে হাঁপাচ্ছে। দুজনই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তারা কেউ জানে না, মিতার জ্ঞান ফিরবে কি না..

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন