শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

আমার বিশ্বাস, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু; তর্কে বহুদূর...”!


আমার বিশ্বাস, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু; তর্কে বহুদূর...”!

November 2, 2013 at 9:34pm
.
ফিডেল ডি সাংমা
.
গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। আমাদের এই সমাজে নারীর মর্যাদা অনস্বীকার্য; অনেক উঁচু মানের এবং তা  উল্লেখযোগ্য। সন্তান-সন্তুতির পদবী হয় মায়ের থেকে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মতো পিতার পদবিথেকে নয়। যেমন ডরথি নকরেকের কন্যা হবে- জাজং নকরেক, চাসং নকরেক, রাসং নকরেক, চিংআ নকরেক। অতএব, একটা পরিবারে, গোষ্ঠ্যিতে মেয়ে সন্তান না হলে চলে না, বংশ রক্ষা হয় না। গারোদের প্রথা অনুসারে, পরিবারের মেয়েরাই সম্পদের মালিক হবেন। কন্যা সন্তানদের জন্য আপন ভাগ্নে অথবা আত্মীয়তার সূত্রে ভাগ্নে সম্পর্কের ছেলেকে জামাতা হিসাবে নিজ বাড়িতে এনে বিয়ে দিবেন এবং জামাতা ঘর সংসারে অভিজ্ঞ হলে তাদের আলাদা ঘর করে দিয়ে আলাদা করে দিবেন। সর্বশেষ কন্যাই হবেন ‘নকনা’; যার বরকে ঘর জামাই মনোনিত করা হয়। এই ঘর জামাইয়ের আসন, দায়িত্ব, মান-মর্যাদা ইত্যাদি অন্যান্য জামাতাদের থেকে ভিন্ন; বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। কেননা, তিনিই শ্বশুর-শাশুড়ির বর্তমানে, অবর্তমানে তার ঘর সংসার, পরিবার আর গোষ্ঠ্যীর সবাইকে দেখভাল করবেন, শ্বশুরের সহায় সম্পত্তি সুরক্ষা করবেন। নিজ পরিবারের সকল সামাজিকতা- বিয়ে, শ্রাদ্ধ, মানসা ইত্যাদি এবং বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সমাজে মান মর্যাদা বজায় রেখে শ্বশুরের মুখ রক্ষা করবেন, উজ্জ্বল করবেন। অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুত্র সন্তানদের পিতামাতা ও পরিবারে দায়িত্ব পালনের মতো এ জামাতাই শ্বশুর শাশুড়ির বৃদ্ধ বয়সে তাদের ছেলে-সন্তানের দায়িত্ব পালন করবেন। এটাই গারো সমাজের প্রচলিত সনাতন প্রথা। যদিও আধুনিককালে গারোদের মধ্যে কোথাও কোথাও এই সমাজ ব্যবস্থাকে মানতে চান না, কিংবা আংশিক মানেন এবং কেউ কেউ পরিবর্তনের, পরিমার্জনের পক্ষে।
.
এবার নিজের গল্প বলি। আমার শাশুড়ি ছিলেন তার মায়ের একমাত্র কন্যা। আর শাশুড়ির ঘরে তিন কন্যা [এবং দুই পুত্র]; এর শেষ কন্যাই হলেন আমার স্ত্রী। প্রথম কন্যার ঘরে আছে দুই কন্যা এবং এক নাতনী। কিন্তু পরের দুই কন্যার ঘরে কন্যাসন্তান নেই। বলে রাখা ভালো- আমি; মানে এ হতভাগাই হচ্ছি সেই ঘরজামাই। আমাদের  নিজ পরিবারে, গোষ্ঠ্যীতে এবং সমাজের লোকজনেরও ন্যুনতম একটি কন্যা সন্তানের প্রয়োজন বোধ করছিলো।
আমরা স্বামী-স্ত্রী এ যুগের মানুষ। আমরা এ সমাজে বাস করি, এ সমাজকে ভালোবাসি, সম্মান করি। তবুও মুক্তমনা হিসাবে, আধুনিককালের মানুষ হিসাবে এ সমাজের প্রথাকে, রীতিনীতির ভালমন্দ বাছ বিচার করে চলতেই ভালোবাসি। এমনকি ধর্মের ক্ষেত্রেও আমি মৌলবাদী নই। এই বিশ্বাসথেকেই সকল ধর্মকেই আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি। বরং একজন আরেকজনের ধর্মের নিন্দা করতে শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়, তার মৌলবাদিতার টুটি টিপে দিতে ইচ্ছে করে। আমার বিশ্বাস, কোন ধর্মই মানুষের অকল্যাণ চাইতে পারে না। পারতপক্ষে, অপ্রয়োজনীয় প্রথা বা রীতিনীতির কাছে জিম্মি হতে চাই না। তাই আমাদের পরিকল্পনা- ছেলে হোক, মেয়ে হোক দুটি সন্তানই নেবো আমরা। সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে ছেলেরাও মেয়েদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, যেমন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের তথা বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে হচ্ছে। দুই পুত্র সন্তানের পর আমরা আর সন্তান না নেবার সিদ্ধান্ত আমাদের, কিন্তু বাঁধ সাধলেন আমার শাশুড়ি। শাশুড়ির নির্দেশ- পরিবারে একটা কন্যা সন্তান চাই; তার নাতনী চাই। নাহলে বংশ রক্ষা হয় না, আর নাতনির মুখ না দেখতে পারলে মরেও তিনি শান্তি পাবেন না ইত্যাদি। শ্বশুর অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন, তিনি থাকলে হয়তোবা আরও কঠিন ফতোয়া জারি করতেন। শ্বশুর উনার জীবিতকালে কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতেন, আমরা এতোগুলো সন্তান লালন-পালন করলাম, আমার বংশধরও তা পারবে। এমনিতে এই দেশে আমাদের জনসংখ্যা কম, তাহলে হিসাব করে সন্তান নিতে হবে কেন ইত্যাদি। এদিকে সন্তানদের মামারাও সুযোগ পেলেই বলতেন, “চিংনাদে আমানি নককো মি’ফাল চটনাজক” অর্থাৎ মায়ের ঘরে আমাদের ভাত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমরাও তাদের খুশি রাখতে চাই, তাই আমি আমার স্ত্রীকে প্রস্তাব দিলাম, মেয়েদের বয়স ৩৫ হলেতো রিস্ক হয়ে যায়, তাছাড়া আমি থাকি (চাকরিসূত্রে) বাড়ির বাইরে, আর তুমি একা সংসার সামলাও। কষ্ট আমার চেয়ে তুমিই বেশি করছ। আবার প্রয়োজনের সময় কারোর সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া বা বেশি মজুরি দিয়েও তেমন কাজের লোক পাওয়া যায় না। সুতরাং চল- আমরা একটা কন্যা সন্তান দত্তক নিই। কিন্তু তিনি রাজী হলেন না। বললেন, তুমি যে আমার কষ্টটা বুঝ, এতেই আমি খুশি, পরেরটা আমি বুঝবো। আমার কষ্ট হোক, তবু আমি আমার মায়ের খুশি মুখ দেখতে চাই।

দ্বিতীয় সন্তানের অনেক বছর পর আবারও একটি ছেলেই হলো। যদিও তাতেও কেউই অখুশি হলেন না; আর পিতামাতা হিসাবে আমরাতো নইই। কিন্তু শাশুড়ি এবং অন্যানদের পুরানো রেকর্ড বাজিয়েই চললো, একটি হলেও আমাদের ঘরে মেয়ে সন্তান তাদের চাই-ই। দুর্ভাগ্য যেখানে ভর করে সেখানে মানুষ কি আর কিইবা করতে পারে? পরের তিন বছরের মাথা আরও একটি সন্তান হলো পুত্র এবং এম্যাচিউরিটির কারণে এই পুত্রের আয়ু ছিলো মাত্র দেড় দিন। এদিকে আমাদের “ঘর সামলাবো না পর সামলাবো” অবস্থা।
.
তারপরের দিনগুলোতে আমরা সিদ্ধান্তহীণতায় কাটিয়ে দিলাম। একদিন আমার স্ত্রী বাইরেথেকে এসে বললেন, চল আমরাও বারমারী তীর্থে যাই।
-       কেন?
-       সবাই যাচ্ছে, গ্রামের লোকেরা বাস রিজার্ভ করছে।
-       তা করুক, তুমি গেলে মাকে (শাশুড়িকে) দেখবে কে? তাছাড়া বাড়িতে রেখে যাওয়ার মতো লোক নাই।
-       না থাক, আমি ধর্মের কাজে যাবো, ঈশ্বরই দেখবেন সবকিছু।
-       তাতো বুঝলাম, ধর্মতো ঘরে বসেও করা যায়, তীর্থে যাবে কিসের জন্য?
-       একটা মেয়ের জন্য?
-       মানে...? (আমি ভাবছিলাম, কাজের জন্য মেয়ে খুঁজতে চাইছে)
-       হ্যাঁ, আমি শুনেছি, সবাই বলাবলি করছে। ওখানে যারা বিশ্বাস নিয়ে যায়, প্রার্থনা করে, মা মারিয়া তাদের প্রার্থনা শুনেন। অনেক রোগী সুস্থ্যও হয়েছেন ইত্যাদি...
-       ঠিক আছে যাও। বাচ্চাদের সাথে নেবে?
-       শুধু বাচ্চাদেরই না, বাচ্চাদের বাবাকেও যেতে হবে। বাচ্চাদের আমি একা সামলাতে পারবো না। তুমিও আমার জন্য একটা মেয়ে চাইবে। (আমি নির্বাক থেকে তার কথায় সমর্থন দিলাম।)

যথারীতি তীর্থের সময় হয়ে এলো। যেখানে আমি চাকরি করি, সেখানকার খ্রিস্টভক্তরাও যাবেন। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আমাদের অফিস তাদের আর্থিকভাবে আংশিক সহযোগিতা দিচ্ছে। তাই তাদেরও আবদার, গাইডের মতো করে অফিসের লোকজন তাদের সাথে থাকলে ভালো হয়, তাই আমাদের অফিস কর্তৃপক্ষ স্টাফদের মধ্যথেকে বেশ কয়কজনকে সেখানে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো। সেসাথে ইচ্ছুক যারা, তারা সপরিবারে যাবার সুযোগটাও পেল এবং যথারীতি ব্যাগ, ছোট খাটো বিছানাপত্র আর কিছু শুকনো খাবারসহ আমরাও গেলাম।
.
তীর্থস্থানে পৌঁছার পর দেখলাম চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। ব্যাগ, বিছানাপত্র রাখারও জায়গা নেই। শেষে কোন এক সিস্টারের পরামর্শে গীর্জাঘরের এক কোণে সেগুলো রেখে প্যান্ডেলে গিয়ে দেখি, দাঁড়াবারও জায়গা নেই। অনুমানিক ২০ হাজার লোক হবে। চারিদিকে মাইক ফিট করা থাকায়, মূল অনুষ্ঠান শোনার, অংশগ্রহণ করার কোন অসুবিধাই রইলো না। প্রথমে পাপস্বীকার অনুষ্ঠান হলো, দ্বিতীয়ভাগে খ্রীস্টযাগ। তারপর আলোক সজ্জার মাধ্যমে প্রায় দেড় কিমি উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে মালা প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করলাম। রাত্রে কিছুক্ষণ বিরতির পর, বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে প্রার্থনানুষ্ঠানের পাশাপাশি যেখানে কুমারী মারিয়ার মূর্তি রাখা হয়েছে, সেখানেও সবাই গিয়ে ভক্তিভরে প্রার্থনা করতে লাগলো। আমার স্ত্রীও আমাকে বললেন, চল আমরাও সেখানে যাই। তখন রাত প্রায় দেড়টা। অনেক ক্লান্তি নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। স্ত্রী বললেন, সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করতেইতো আমরা এসেছি, এমনি এমনি ফিরে যাবো? তার আবদার উপেক্ষা করা গেলো না, তীরে এসে তরী ডুবলে চলে না। অগত্যা পাহাড়ের অনেক উঁচুতে উঠে কাছে গিয়ে খুব মনযোগ ও ভক্তিসহকারে প্রার্থনা করলাম। আমি জানি, আমার স্ত্রী একটি মেয়ে সন্তানের আশায় এতদূর এসেছে, তাই আমিও আমার স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণের জন্য প্রার্থনা করলাম। বললাম, “মাগো, আমাদের সংসারে ঠিক তোমার মত সুন্দর মনের অধিকারী একটি কন্যা সন্তান দাও”।
.
তার ঠিক এক বছর পর আমাদের একটি সন্তানের মুখ দেখলাম, কি অবাক করা ফুটফুটে সুন্দর মুখ। জন্মের পর পরই আমার কোলে চলে এলো। মনে হচ্ছিলো, এই মূহুর্তে আমিই পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভাগ্যবান গারো পিতা। যাই হোক, যাকে ঘিরে এত স্মৃতিচারণ; এত কথা, সেই হচ্ছে আমাদের একমাত্র কন্যা সন্তান ‘চিংআ’। আজ ২ নবেম্বর চিংআর ৪র্থতম জন্মদিন। আপনারা সবাই আমাদের এই মেয়েকে এবং আমার ৩ রত্ন পুত্রদের জন্য আশীর্বাদ করবেন, প্রার্থনা করবেন এবং যাচ্ঞা পূরণকারী মহান সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিবেন।
.
পরিশেষে একটা কথা বলে লেখার ইতি টানতে চাই। তাহলো- এ লেখায় আমি আমার বিশ্বাসের কথা লিখলাম, আমার স্ত্রীর বিশ্বাসের কথা লিখলাম এবং আমাদের পরিবারের কথা লিখলাম। আমরা বিশ্বাস করি, এ আমাদের মেয়ে চিংআ, আমাদের বিশ্বাসপূর্ণ প্রার্থনার ফল। আমার এ লেখার কথার পক্ষে বিপক্ষে অনেক কিছুই ভাবা যায়, যুক্তি দাঁড় করানো যায়। আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, সেটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যার তার ধর্ম এবং বিশ্বাসের ব্যাপার! কথায় বলে, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু; তর্কে বহুদূর...”।