শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

আব্দুস সাত্তার বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। লেখককে আমি চিনি প্রাবন্ধিক, কবি, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার প্রথিতযশা সাংবাদিক হিসাবে। তাঁর স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিভা শুধু ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ নিয়ে নয়; বাংলা সাহিত্যকে ঘিরেও। তাঁর মূল্যবান লেখনী আমাদের দেশ ও দেশের মানুষের হাসি- আনন্দ- ভালোবাসার, সুখ-দু:খ-বেদনার কথা বলে।


প্রবন্ধগুলো আমি খুব মনযোগ দিয়ে পড়েছি। গ্রন্থে ১৫টি প্রবন্ধ রয়েছে। পাঠকদের পাঠ করার সুবিধার জন্য প্রবন্ধগুলোকে তিনি প্রধান দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন। তা হচ্ছে- ‘শিশু ও পরিবার’ এবং ‘দেশ ও সমাজ’। তাঁর এ লেখাগুলোতে অনেক গুরুত্ব পূর্ণ কথাগুলো খুব সহজ ও পাঠযোগ্যভাবে উঠে এসেছে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি বলেছেন, শিশু বয়সই হল চরিত্র ও মেধা গঠনের মূল সময়। শিশু বয়স থেকেই তাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সুখময় করে তুলতে, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং ভাতৃত্ববোধ বজায় রাখতে অভিভাবকদের আন্তরিক সাহচর্য্য, প্রচেষ্টা অপরিহার্য। তাঁর সাথে নীতিবোধ, ধর্মীয় জ্ঞান আহরণ করার যে পরামর্শ রেখেছেন তা আমাদের সবারই মেনে চলা খুবই যুক্তিপূর্ন।


সমাজ চিন্তায় ও কর্মে, সাহিত্য চিন্তায় ও চেতনায় কন্যা-জায়া-জননীরা হয়ে উঠতে পারে ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ জাগরণের শ্রেষ্ঠ আলোকবর্তিকা। উক্ত কথাগুলোই মা দিবস নিয়ে মাকে এবং নারী দিবস নিয়ে লেখায় নারীদের যথাপোযুক্ত সম্মান প্রদান খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। “আমার বাবা” এবং "বন্ধুত্ব" প্রবন্ধে আমি খুঁজে পাই আরেক আব্দুস সাত্তারকে। যার আবেগ, অনুভূতি আর সহিষ্ণুতা, নম্রতা খুবই গভীর। তিনি বলেন, জন্মতাদা যে কোনো ব্যক্তিই হতে পারে, কিন্তু স্নেহশীল পিতা হওয়া এক দুর্লভ বিষয়। ধার্মিক, সাহসী, নির্ভীক ও আর্দশ পিতার সন্তান হিসাবে যিনি নিজেকে গর্বিত মনে করেন এবং নিজেও পিতার আদর্শে নিজের পিতৃত্বকে সুখি ও সফল হওয়ার বাসনায় বদ্ধপরিকর।


অপরদিকে “শিক্ষা ও সত্য”, “শিক্ষা ও সত্য অর্থদণ্ড শিক্ষার মেরুদণ্ড, শিক্ষা নয়”, “দুঃখবোধই প্রতিষ্ঠার উপায়” “ঘুষ ও দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি” প্রবন্ধগুলোতে লেখক দেশ ও সমাজের চলমান মন্দ বা ক্ষতিকারক পরিবেশ, পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের পথও দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আগুনে পোড়ালে যেমন খাঁটি সোনার পরিচয় স্পষ্ট হয়, তেমনি দুঃখের দহন মানুষকে খাঁটি মানুষে পরিণত করে। আঘাতে আঘাতে, বেদনায় বেদনায় মানুষের মনুষ্যত্ববোধ, সত্যনিষ্ঠা ও বিবেকবোধ জাগ্রত হয়। দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ-তীতিক্ষা ব্যতীত কোনো মানুষই জীবনের যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন না।” অথচ আমরা ক্ষণিকের সুখের আশায় অন্যায়- দুর্নীতিতে জড়িয়ে নিজের ও পরের জীবনকে নির্মল চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াই। তিনি জীবনের সাময়িক দুখ-কষ্টকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে খাটি মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টাকেই গুরুত্বারোপ করেছেন ।


দেশ ও সমাজের উন্নয়নকল্পে স্বদেশপ্রেম ও শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই লেখক “স্বদেশপ্রেম” প্রবন্ধে বলেছেন, স্বদেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠতর গুণ। দেশপ্রেমের মূলে রয়েছে দেশের ভূখণ্ডকে ভালোবাসা; স্বদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসা; জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে দেশের মানুষকে ভালোবাসা,সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। স্বদেশ ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ঈমানের অংশ। তথ্যবহুল লেখা “১৯৭১সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাত”,  "ওবামার বিজয়: আরেকটি ৯/১১" এবং "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন কথা" প্রবন্ধগুলো না পড়লে পাঠককুল বড় ধরনের মিস করবেন। কঠোর পরিশ্রম করে প্রবন্ধটি লিখে দেশ মাতৃকা এবং সাহিত্যকে ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি।


প্রাবন্ধিক, কবি, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক আব্দুস সাত্তারের সাহিত্যাঙ্গণে উত্তরোত্তর সফল হোক আমি আন্তরিকভাবে কামনা করছি। তাঁর এই বইটির অবতরণিকা লিখতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।


সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়...

ফিডেল ডি সাংমা
মিতা-  ফিডেল ডি সাংমা
 সোমবার, 29 আগস্ট 2011 15:53

‘যেখানে ভালবাসা আছে, হৃদয়ের টান আছে, সেখানে সুবিধা-অসুবিধা, লাভ-ক্ষতির ব্যপারটা গৌণ...’
 মিতার কথাগুলো শুনে নড়ে-চড়ে বসে অয়ন। মিতাদের মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ। শুনেই আগ্রহ জন্মে মেধাবী ছাত্র অয়নের। পুরো নাম- মোঃ মতিউর রহমান। মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় মিতা, ‘তা আপনি কি আমাদের নিয়ে থিসিস্ লিখতে চাচ্ছেন না-কী?’
- আচ্ছা মিতা, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সারা বিশ্বের সমাজ চলছে সেখানে তোমাদের মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, কেন? তোমাদের সমাজের পুরুষরাই বা এটাকে কি ভাবে নেয়?
- আমাদের আদি-সমাজ ব্যবস্থাই এমন। আমরা আমাদের জাতটাকে, সমাজকে এবং আদিবাসি সংস্কৃতিকে অন্তর দিয়ে ভালবাসি। পৃথিবীতে মঙ্গোলীয়দের অনেক জাতির মধ্যে এখনও মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ প্রচলিত আছে। এখানে আমাদের আলাদা জাতিসত্ত্বা, আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা; আর এজন্যই আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র বলে দাবী করতে পারি, তাই না?
- হয়তবা পার। কিন্তু এমন হাই থটেরর কথা-বার্তা রেখে একটু সহজ করে বল, শুনি-
- যেমন ধরেন, আমাদের সমাজে যেটুকু জাতীয় মূল্যবোধ এখনও টিকে আছে, তা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। যেমন ধরেন...

মিতার কথায় বাঁধা দেয় অয়ন। ‘থামতো, ধরেন-টরেন, লেন-দেন শব্দগুলো বাদ দাও, না হলে আলাপটা ভাল জমবে না। তারপর তোমাদের জাতীয় মূল্যবোধের বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা দাও।’ - এ ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশের ফাঁকে ওদের আড্ডার শুরু...।

রিতা ও মিতা দুই বোন। মিতা বি.এ অনার্সের ছাত্রী। বাবা-মা অনেক কষ্টে-শিষ্টে পড়তে দিয়েছেন। মিতা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের ফ্যাকালটিতে একমাত্র আদিবাসী মেয়ে। তার ওপর দেখতে মোটামুটি সুন্দরী। দেহের গঠন বাঙালী- আদিবাসীর মাঝামাঝি। প্রথম দেখায় মিতাকে বুঝার উপায় নেই যে সে অবাঙ্গালী। একমাত্র কথা বলার জড়তা ছাড়া। তবুও গলায় মিষ্টি স্বরের কারণে পার পেয়ে যায় সে।

হোষ্টেলে মিতার জায়গা হয়নি; তাই ৪/৫ জন ছাত্রী মিলে একটি মেসে থেকে পড়াশুনা করছে। প্রায়ই একই বাসে করে ক্লাশে যাওয়া-আসা করতে হয়। মিতা ছাড়া তার সহপাঠী সবাই শহুরে। তাদের কোন জড়তা নেই, যখন যা ইচ্ছে করতে পারে, চলতে পারে, বলতে পারে, কিন্তু তা মিতা পারে না। অপরিচিত কারোর সাথে মিশতে বা কথা বলতে দ্বিধাবোধ হয় তার। ছাত্র-ছাত্রী মিলে সবাই যখন আড্ডা-গল্প-ঠাট্টা-হই-হুল্লোড় করে, মিতা তখন থাকে চুপচাপ। মাঝে মধ্যে হু-হাঁ জাতীয় শব্দ দিয়েই চালিয়ে দেয় সে।

মিতার বড় বোন রিতা বিয়ে করে সংসার চালাচ্ছে। তার স্বামীটা একটু গোবেচারা টাইপের; এনজিওতে চাকুরী করে। বাবা স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টারী শেষ করে মোটামুটি ধর্ম-কর্মের দিকে মনযোগ দিয়েছেন। মা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় প্রচন্ডভাবে শূচি-বায়ূগ্রস্থ। মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ ও তার পরিবারের পাক্কা গৃহিনী হয়ে সংসারের যাবতীয় বিষয় দেখা-শুনা করেন। স্বামীর অল্প আয়ের কারণে আর্থিক লেন-দেন, লাভ-লোকসানের হিসাবে বড়ই কড়া মনোভাব।

ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা মোঃ মতিউর রহমানদের পরিবার। অয়ন নামেই সে বেশী পরিচিত। বড় লোকের একমাত্র সন্তান। তাই তার চাল-চলন, ভাব-সাব একটু অন্য রকম। আধুনিক যুগের ছেলে বলতে যা বুঝায়! সহপাঠী শেফালী আক্তারের অয়নের গা ঘেষার বেশ আগ্রহ তা বুঝা যায়। বোধ হয় মনে মনে ভালই বাসে, তবে এক তরফা। অয়ন তাকে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। সেই শেফালী আক্তারের সাথে সাজেশান নিতে গিয়ে অয়নের সাথে পরিচয়। বিশ্ব-বিদ্যালয়ের পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতেই কেটে গেল মিতার একটি বছর। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নতুন আর একটি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল মিতাকে।
‘বাহ্-বাহ্ তোমার হাসি তো খুব সুন্দর, আমি তো কোনদিন খেয়াল করিনি...’ অয়নের এমন উক্তি শুনে লজ্জা পায় মিতা। সে কোন রকমে বলে- চলুন, উঠে পড়ি। এই শেফালী, চল্..।
‘আরে না না, তোমাদের জাতীয় মূল্যবোধের বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করে বলবে না?’ আবার আদিবাসি বিষয়েই কথা তোলে অয়ন। ‘এই শেফালী বস তো। আজ খুব সুন্দর বাতাস, বসে আড্ডা দিয়ে তোমার কথা শুনতে ভাল লাগছে...’ শেফালী উঠতে যাচ্ছিল, তাই হাতটা ধরে বসিয়ে দেয় অয়ন। ‘তা হলে একটু পরেই যাই। আমারও তোমার কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছে..।’ অনেক্ষণ পর কথা বলল শেফালী। মিতা শুরু করে...
- আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কোন লিখিত বিধি-বিধান নেই; তবে এর প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। মুখে মুখে প্রচলিত সামাজিক নিয়ম-নীতি এবং সংস্কৃতিতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা চলে। আপনাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে অনেক তফাৎ।
- যেমন...?
- বলছি, আমাদের সমাজে বড়দের সম্মান এবং ছোটদের আদর-স্নেহ- ভালবাসার ধরণ দেখলে আপনারা অবাক হবেন। আপনারা সংখ্যাগুরু মানুষরা আমাদের ক্ষুদ্র জাতীদের সব কিছু অতি ছোট- ক্ষুদ্র বলেই মনে করেন। তুচ্ছ্ব-তাচ্ছিল্য করেন। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার সব কিছু বাঁকা চোখে দেখেন। অনেক সময় আমাদের এ সব বিষয়গুলো আপনাদের কাছে নিন্দনীয়, হাসির পাত্র, করুণার বিষয়। কিন্তু দেখেন, আমাদের এসব কিছুর মূলে আছে আমাদের সারল্য-সততা। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি শোষন-নির্যাতন-যন্ত্রণার করুণ কাহিনী। আমাদের সমাজে যেমন তালাক-যৌতুক নেই, তেমনি প্রতারণা, স্বার্থপরতা, হিংসা-নিন্দা, ঘুষ-শোষন-নির্যাতন, ডাকাত, ধর্ষণ, বলাৎকার, এ জাতীয় শব্দের কোন প্রতিশব্দ নেই; ব্যবহারও নেই। পাশের বাড়ীর কেউ না খেয়ে থাকে না। বৃদ্ধ বাবা-মা, ময়-মুরুব্বী, পঙ্গু- এতিম কাউকেই বোঝা মনে করা হয় না। কারোর বিয়ে-শ্রাদ্ধের খরচে গোষ্ঠি, পাড়া-প্রতিবেশী একে অপরের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমরা কারোর মনে কষ্ট দিতেও জানিনা, পেতেও জানিনা। এ সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের সমাজে এখনও নেই। যেটুকু আছে সব বাঙালীদের চাপিয়ে দেওয়া। আপনাদের কাছে শেখা...
- তুমি কিন্তু আমাদের ডাইরেক্টলি অপবাদ দিচ্ছ; আমার মনে হয় সবাই তা করে না...
- আমি একক কারোর উপর দোষ চাপাচ্ছি না; একদিন গ্রামে যান, সত্যি কি না দেখে আসবেন..
- তোমাদের অভিযোগগুলো কতটুকু সত্যি আমি জানি না। তবে-
- তুমি এত কথা জান মিতা? প্রশড়ব করে শেফালী। এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিল সবাই। অয়নও অবাক হয় মিতার কথা বার্তা শুনে।
- অবাক হওয়ার কি আছে। আমি লেখা পড়া জানা মেয়ে, বাধ্য হয়েই অনেক কিছু শিখে নিতে হয়। চল্- উঠে পড়ি, আজ আর ভাল লাগছে না।’
- ঠিক আছে, চল। বাকী সব পরে শুনবো। অয়নের কথায় তারা যখন উঠতে যাচ্ছে ঠিক তখনই

ছাত্রদের মধ্যে কোন্দলে দৌঁড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। হাতে লাঠি সোটা নিয়ে এদিকেই এক দল আরেক দলের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। অয়ন তাড়াতাড়ি করে শেফালী আর মিতাকে টেনে হিঁচড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে তাদের বাসায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে।
-ধন্যবাদ অয়ন ভাই, আজ আপনি না থাকলে আমাদের যে কী হতো.. মিতার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে।
- অনেকদিন পরে এলি, কতদিন থাকবিরে শালি..। ছড়া কাটে মিতার দুলাভাই। ঢাকায় গেলি কাঁদতে কাঁদতে, ফিরে এলি হাসতে হাসতে..। অনেক ফর্সা হয়ে গেছিস্, সিনেমার নায়িকাদের মত তোকে খুব সুন্দর লাগছে, আফসোস্! কেন যে তোর দিদিকে বিয়ে করেছিলাম। তোকে কে গাড়িতে উঠিয়ে দিল রে..


ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করে মিতাও অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। মিতা উত্তর দেয়- আমি এলাম আর অমনি ঝগড়ার তাল শুরু করেছ, কেন আমি থাকলে বুঝি তোমার সমস্যা হয়..। প্রতি উত্তরে কি যেন বলতে যাচ্ছিল দুলাভাই ঠিক তখনই মিতার গলা শুনে তার মা সামনে এগিয়ে এলেন।
- ঘরে আসতে না আসতেই শালী-দুলাভাইয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল, না? হাতের ব্যাগ-ট্যাগ রেখে হাতমুখ ধুয়ে নে..।
- যাচ্ছি মা, কিন্তু তোমরা সবাই মিলে দুলাভাইয়ের স্বভাবটাকে ঠিক করতে পারলে না..।

দুলাভাইয়ের উদ্দেশ্যে ভেংচি কেটে ভেতরে যায় মিতা। রাতে আদিবাসিদের প্রিয় বহু পদের তরকারীর আয়োজন। অনেকদিন পর তৃপ্তি সহকারে খেল মিতা। সারাদিন জার্নি করে খুব ক্লান্ত লাগছে অথচ অনেক্ষণ শুয়ে থেকেও ঘুম আসছে না। চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। শুধু এপাশ-ওপাশ করে। ঘন ঘন হাই ওঠে দু’চোখে জল ভরে উঠছে আর জ্বলছে। মিতার মনে হচ্ছে- এক বছরেই বাবার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। মা অবশ্য আগের মতই; চটপটে স্বভাব। বোধ হয় দুলা-ভাইয়ের বেশ খাটুনি যাচ্ছে অথবা টেনশানে আছেন। বড় বোন সন্তান সম্ভবা। হিসাব ঠিক থাকলে আগামী মাস দেড়েকের মধ্যে একটা মেয়ে হবে।
- মা ঘুমিয়েছিস্..? বাবার চিরাচরিত শান্ত গলা, বারান্দায় থেকে প্রশ্ন করেন।
- না বাবা, ঘুমাইনি, ঘুম আসছে না। এসো..
- আমি তোমার নানীর বাড়ী যেতে চাচ্ছি। তোমার জ্যেঠির মেজো মেয়ের বিয়ে ঠিক হচ্ছে, তাই নিয়ে আলোচনায় বসবো।
- একটু বসে যাও বাবা। দরজা খুলে দেয় মিতা।
- অনেক বড় হয়ে গেলি রে মা ...।
বাবা চেয়ারে বসতে বসতে অনুযোগের সুরে বললেন। কিন্তু কেন, তা হঠাৎ করে মিতা বুঝতে পারছে না। বাবার কথা বলার স্বর আজ অন্য রকম লাগল। থতমত খেয়ে যায় মিতা।
- কেন কী হয়েছে বাবা?
- আজ যে এসে তোর এই বুড়ো ছেলের খোঁজও নিলি না..
- ইয়ে বাবা, মানে- তখনতো তুমি ছিলে না বাবা। মা’ৱ’র কাছে গিয়ে দেখ, তোমার জন্য আজকের পেপার নিয়ে এসেছি; আর সাথে রবি ঠাকুরের উপন্যাস...
- ঠিক আছে মা, তুমি বিশ্রাম নাও, ওরা আবার আমার জন্য রাত জেগে বসে থাকবে।

বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাবা। ঘুম আসে না মিতার। চোখের সামনে ছবির মত ভাসতে থাকে কিছুদিন আগের ঘটনা। বান্ধবীদের নিয়ে বাসে চেপে ক্লাশে যাচ্ছিল মিতা। ভাড়া চাইতে এসে কণ্ট্রাক্টর তাচ্ছিল্যের সুরে বলছিল -ওই গারো আফা, ভারা দ্যান তারাতারি..

কণ্ট্রাক্টরের ধৃষ্টতা দেখে মিতা রাগে ফেটে পড়ছিল। মিতাকে অবাক করে দিয়ে পেছন থেকে অয়ন ঠাস্ করে কণ্ট্রাক্টরের গালে চড় মেরে দিল। বেচারার চোখ দিয়ে দর-দর করে পানি পড়ছে। এমনটি হবে আশা করেনি সে। চড় খাওয়া গালটা টক-টকে লাল হয়ে গেল। উচিত শিক্ষা হয়েছে। মিতার ধারনা, সেদিনের কথায় অয়ন বোধহয় এ কাজটি করে আদিবাসীদের কাছে বাঙালীদের দায় কিছুটা সারল। আদিবাসিদের সাথে যারা এমন আচরণ করে তাদের সবার গালে যদি চড় মারা যেতো...।

ঠিক তার দু’দিন পরের ঘটনা। ক্লাশে যাওয়ার পথে পাতা বাহারের ঝোঁপ থেকে বেড়িয়ে একটা গোখরো সাপ ফণা ধরেছে। মিতা প্রচন্ড ভয় পেয়ে পেছাতে গিয়ে পড়ে অয়নের বুকে। এভাবে সে কতক্ষণ ছিল কে জানে। শেফালী যখন মিতাকে টেনে নিয়ে গেল তখনই সবার হুঁশ এল। সেদিন ভয় আর লজ্জায় ক্লাশ করা সম্ভব হয়নি মিতার। বাসায় গিয়েও ঘুম হল না। পরদিন ক্লাশে গিয়ে সহপাঠীদের এ মুখ দেখাবে কেমন করে। আবার ভাবতে গিয়ে কখনো কখনো শরীরে কেমন যেন শিহরণ লাগছিল। আর যাই হোক শিহরণ-টিহরণ ভুলে যেতে চায় মিতা। আদর্শ শিক্ষক পিতার সন্তান এমন কোন অসম যোয়াল বাঁধতে চায় না সে। মিতা কখন ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ের ডাকে দরজা খুলে দেখে রোদ ঝল্-মলে সকাল...।

দিন গড়িয়ে গড়িয়ে কয়েকটা বছর চলে গেল। মিতার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পড়াশুনায় উন্নতি করছে। পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা, আচার-ব্যবহার সব কিছুতেই স্মার্টনেস্ চলে এসেছে। তবে উন্নয়ন(?) হয়েছে তার প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রেও। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মিতার অনেক কাছাকাছি আসার অয়নের সুযোগ হয়। পরিণতিতে ‘ইসলাম ধর্ম মতে বিবাহ’। মিতার নামও পরিবর্তন হয়েছে, মিনারা বেগম মিতা।

আদিবাসি মেয়ে বিয়ে করায় বিয়েটা মেনে নিতে পারল না অয়নের পরিবার। তাদের ঘর ছাড়া করেই ছাড়ল ওরা। অথচ ভাগ্য বিড়ম্বিতা নারী, সহজ সরল আদিবাসি মিতা বুঝতেই পারল না- চতুর অয়ন রাজকন্যা আর রাজত্বের আশায় তাকে বিয়ে করেছে। সন্তান পেটে আসায় ফাইনাল ইয়ার শেষ করা হল না। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ফাইনালটা শেষ করার আশা ছিল। কিন্তু সে আশায় গুড়ে-বালি। পর পর দুটি সন্তান এলো মিতার কোলে। অয়নের একার আয়ে ঢাকা শহরে বেশীদিন ভাল থাকা যায় না। সংসারে টানা-পোড়েন শুরু হল। কখন, কোথায় যে তাদের কাছথেকে সুখ নামের পাখিটা উড়ে চলে গেল; তা তাদের দুজনের কেউ টের পেল না। চারজনের সংসারে যখন চাহিদা বেড়ে গেল; ঠিক তখনই অয়ন মিতার কাছে তার ভাগের ওয়ারিশের কথা তোলে।

বলে- ‘তোমাদের না মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজ, যাও তোমার বাব-মার কাছথেকে তোমার ভাগের সম্পত্তিটা নিয়ে এসো।’ মিতা উত্তর দেয়, ‘ভুলে গেলে কি করে যে ওরা আমাকে ত্যাজ্য করেছে।’
- তাতে কি হয়েছে, এখনতো আমাদের দুজনের সংসার না, না খেয়ে-পরে, জায়গা-বেজায়গায় পড়ে থাকবো। আমি একা সামাল দিয়ে কুলাতে পারছি না, দেখছ না...?
- কোলের বাচ্চাটা না থাকলে চাকুরী করে আমিওতো তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম...
- মায়ের কাছে গিয়ে মাপ চাপ চেয়ে চেষ্টা করে দেখ না...
- না, আমি সেটা পারব না
- তোমাকে পারতেই হবে, নইলে তোমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রান্তায় পঁচে মরোগে যাও...

মিতা ভাবে, তার ভুলের কারনে ছোট্ট দু’টি শিশুদের মরতে দেওয়া যাবে না। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে রাতের অন্ধকারে মায়ের দারে উপস্থিত হয়। মা রাজি হলেন না, বরং বললেন, ‘তোর বাবা টের পেলে কেটে দু’টুকরো করে ফেলবে তোকে’। শত কষ্ট সত্বেও শুধু গাড়ী ভাড়াটুকু দিয়ে রাতের অন্ধকারেই ফিরিয়ে দিলেন মা। শিক্ষিত আদিবাসীদের অনেকেই এখন মোটামুটি সচেতন। সমাজপতি, গোষ্ঠীর লোকজন প্রতিবাদ করায় এবং দুলাভাই নামকরা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুবাদে তাদের অফিসের আইন বিশেষজ্ঞ-এর সহায়তায় সম্পত্তি রক্ষা হয়ে গেল।

এদিকে ফেরার পর মিতার সাথে অয়নের বিরোধ বাড়ে। একসময় শারিরীক- মানসিক অত্যাচারে রূপ নেয়। শেষে দুজনের মতের মিল না হওয়ায় মিতা হতাশ হয়; অবশেষে চুড়ান্ত তালাকের মাধ্যমে মিতার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
অনুশোচনায়, লজ্জায়, ঘৃণায় আদিবাসী সমাজে ফিরে যায় না মিতা; আর কোনদিন যাবেও না সে। জীবনের সব কিছু ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করে চাকুরীর জন্য অফিসে অফিসে ঘুরে। এক সময় ছোট্ট একটা অস্থায়ী চাকুরী পেয়েও যায় মিতা। তার দুই সন্তানসহ ঢাকা শহরেই ছোট্ট একটি কামরা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে।

কিন্তু বিধি বাম! একসময় তার অফিসেরই বসের কু-নজরে পড়ে। একদিন কোন কুক্ষণে মাতাল বসের দ্বারা লাঞ্চিত হতে হল। লজ্জায়, ঘৃণায়, রাগে, অপমানে চাকুরীটাই ছেড়ে দিতে হল মিতাকে। প্রকৃতির মাঝে আদিবাসি সমাজে থর-থর করে বেড়ে ওঠা, জাতিকে ভালোর দিকে আলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা- তার জীবনে কত বড় অধঃপতন হয়ে গেছে; এখন দুঃখে-কষ্টে থেকে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মিতা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ সংসার সবকিছু ছাড়তে হল; পরিবারের সম্পত্তির মালিকানাও হারাল। মিতা মনে মনে ভাবে, আর কোন আদিবাসী মেয়ে যেন তার মত ভুল না করে। অন্ধকারের পথে মরিচিকার পেছনে যেন আর কেউ না ছুটে...। এই ভুলের কারণে অসহায়ের মত পদে-পদে, ধুকে-ধুকে তাকে মরতে হচ্ছে।

সহপাঠী শেফালীর আশ্রয়ে কয়েক মাস থেকে দ্বিতীয়বার প্রাইভেট ফার্মে টেলিফোন অপারেটরের চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছে। তবে তা অনেক কষ্টে শিষ্টে। ফার্মেরই এক সহকর্মীর সহযোগিতায়। এখানেও খুবই রিস্ক। প্রতি মাসে ঠিক মত বেতন ভাতা দেওয়া হয়না, নানা রকম তাল বাহানা। মিতার চেহারা বেশ সুন্দর আর পরিপাটির কারনে সহকর্মী পুরুষদের চোখগুলো কেমন চক্-চক্ চুক্-চুক্ করে। এটা-সেটার অজুহাতে গা ঘেষার চেষ্টা করে। তবু সমাজ, আত্মীয় স্বজনদের ধিক্কার, সহকর্মীদের রক্তচক্ষু, প্রতিহিংসা, বান্ধবী শেফালীর করুণা আর সন্তানদের করুণ মুখ, ক্ষুধার আহাজারী সবকিছু উপেক্ষা করে কোন রকম ভাবে দিন পার করে নিচ্ছিল মিতা।

ফার্মের বর্ষ পূর্তিতে জমকালো পার্টি দেন বস। পার্টির পর মাসের বেতনটা দেওয়া হবে। মিতার ছেলে মেয়ে দু’টোই অসুস্থ্। ফেরার পথে ঔষধ কিনতে হবে। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে পার্টি শেষ হল। প্রধান ও বিশেষ অতিথিদের আপ্যায়নে মিতাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। অফিসের বস অত্যন্ত খুশী হলেন মিতার দায়িত্ব পালনে। মিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিথিদের সাথে বস বেড়িয়ে গেলেন। কিন্তু মিতার যে আজ টাকার খুবই প্রয়োজন ছিল তা বসকে কোনভাবেই বলার সুযোগ হল না।

পাশের রুমে সহকর্মীদের কথাবার্তা আর হাসা-হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মদ-টদ খেয়ে ওরা মাতাল হয়েছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। মিতা ভাবে, কোন ভাবে যদি কারোর কাছে কিছু টাকা ধার পাওয়া যায়। অন্ততঃ ছেলের জন্য ঔষধের ব্যবস্থা করতে পারবে। ‘মিনহাজ ভাই, আমি মিনারা মিতা, আপনি দয়া করে একটু বাইরে আসবেন?’ ভেতর থেকে কিছুক্ষণ নীরব। কিছুক্ষণ পর অন্য একজনের কন্ঠ, ‘মিতা ভেতরে এসো।’ কিছুটা ইতস্তত করে দরজা খুলে মিতা ভেতরে আসে। ভেতরে আলো- আঁধারী। বাইরের আলো থেকে এসে স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনেকগুলো লোমশ হাত মিতাকে আকড়ে ধরে। কোন ভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না মিতা। ছেলের জন্য যে করেই হোক আজ ঔষধ নিতে হবে। নিজেকে কোন রকম গুছিয়ে এই নরকপুরীথেকে বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে মিতা।

ছেলের জন্য ঔষধ কেনার পর রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে মিতা। রিক্সাগুলো যা আসে সব কটাতেই যাত্রী; কোনটাই খালি আসে না। মিতার শরীর ও মন কোনটাই ভাল লাগছে না। সব কিছুতেই বিরক্তি, অরুচি ধরে যাচ্ছে। সে তন্ময় হয়ে ভাবছিল আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অতীতের সব দূর্ঘটনাগুলোর কথা। হঠাৎ দেখে সামনে মাঝ বয়সী এক রিক্সা-ওয়ালা কলিং বেল বাজাতে বাজাতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। ‘এই রিক্সা...’ বলে ডাকে মিতা। সাথে সাথে পেছনথেকে প্রায় পরিচিত পুরুষ কণ্ঠও ডেকে ওঠে, ‘এই খালি...। ছ্যাৎ করে ওঠে মিতার বুকটা। রিক্সার কথা ভুলে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে- সামনের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে অয়ন। মিতার চোখের সামনে স্পষ্ট রঙিন হয়ে ভাসতে থাকে ফেলে আসা সব সুখময় স্মৃতিগুলো। মূহুর্তের জন্য পৃথিবীর সব দুঃখ-বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিন্তু পাশের সুন্দরী এই মহিলাটি কে! অয়নও কাছে এসে চম্কে ওঠে, ‘তুমি.. মানে...আপনি...। সম্বিৎ ফিরে পায় মিতা। ভেতরে ভেতরে অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে খুব সাবধানে সামলে নিয়ে দু’জনের উদ্দেশ্যে সালাম দিতে ভুল করল না সে। মহিলাটি সন্তান সম্ভবা। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে উত্তরে তিনিও সালাম দিলেন। কিছুটা ইতস্তত করে পাশের মহিলাটিকে দেখিয়ে অয়ন বলে-
- আমি পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি হচ্ছেন আমার স্ত্রী, আর উনি হচ্ছেন মিতা। আর-
- থাক, আমার আর কোন পরিচয় দিতে হবে না...’

হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিল মিতা। অয়ন তাড়াতারী করে মিতাকে ধরে ফেলে; সাথে সাথে অয়নের স্ত্রীও এগিয়ে আসে। বিরম্বনা আর অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন সুন্দরী মহিলাটি। স্বামীর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
- আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উনি অসুস্থ্। এই রিক্সায় উনাকেই উঠিয়ে দাও...
- কিন্তু এভাবে, এ অবস্থায়, রিক্সায় করে তাকে একা পাঠানো কি ঠিক হবে...?
- তাহলে কি করতে চাও তুমি, ঝামেলা বয়ে বাসায় নিয়ে যাবে...
‘আমি একাই যেতে পারব...’ বলেই অবশ শরীরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়ে মিতা। মনে মনে বলে ‘শোন অহঙ্কারিনী, তুমি যে বাসার কথা বললে, সেখানেতো আমারই থাকার কথা ছিল...’।

মহিলাটি কোন কিছু আঁচ করতে পেরেছেন কি-না বুঝা গেল না। ‘তা হলে যান, আমরা যাচ্ছি...’ বলেই অয়নের হাত ধরে টানতে টানতে ভীরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।

রিক্সা-ওয়ালাটা আগেই কেটে পড়েছে। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করে আর কোন লাভ নেই। পায়ে হেঁটেই ফিরতে হবে। কখন যে মেঘ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল; মিতা বুঝতে পারেনি। অবিরাম ঝম্-ঝম্ বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে উচ্চ স্বরে হর্ণ বাজিয়ে নীল রঙের একটা জীপ ছুটে আসছে। আসুক। আজ মিতার রাস্তা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। গাড়ীটা সামনে আসলে ঝাঁপিয়ে সে পড়বে কি না বুঝতে পারছে না। তার তল পেটটা ভীষনভাবে কামড়াচ্ছে। যেন পৃথিবীর সমস্ত ময়লা আবর্জনা ওখানে জমা হয়ে আছে। হাজার মানুষের ক্লান্তি মিতাকে পেয়ে বসেছে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও আজ তার নেই; তবুও শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে হাঁটতে থাকে মিতা।

আধুনিক শহুরে এই পরিবেশের সাথে তাল দিয়ে চলা অনেক কঠিন, অনেক কষ্টের। তার উপর মিতার মত অসহায় অবলা নারীদের পদে-পদে তিলে-তিলে অপমান-অপবাদ সহ্য করতে হয়। এই যুগে ভাল চাকুরী পাওয়াও দুস্কর। কিন্তু এভাবে আর কতদিন, এখন কোথায় কি করবে ভেবে কোন কূল পায় না মিতা। আদিবাসি সমাজে ফিরে যাওয়াও আর সম্ভব নয়। ওই সমাজে আর কেউ তাকে গ্রহণ করবে না। নিজের জাত-ধর্ম সব কিছু ছেড়ে অ-আদিবাসির সাথে চলে আসায় বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার মান-সম্মান খেয়েছে।

মিতা শুনেছে, তারই কারনে আদর্শবাদী শিক্ষক পিতা আত্ম-হত্যা করতে গিয়েছিলেন। অল্পের জন্য বেঁচে থাকলেও আজ তিনি অন্যরকম মানুষ হয়ে গেছেন। দ্বিতীয়বার সেরকম বিড়ম্বনায় ফেলতে চায় না সে। কিন্তু তার অবুঝ সন্তানদের কিভাবে মানুষ করবে সে। সমাজ যা বলার বলেছে, তার ছেলে-মেয়ে দু’টো বড় হলে মাকে কি বলবে। তাদের কছে ‘জন্মদাত্রী মায়ের’ স্থান কোথায় থাকবে। যে মায়ের ভুলের কারণে তাদের করুণ পরিণতি! সন্তানরা কি তাকে ক্ষমা করবে; কিংবা বিধাতা!

এখন সে কোন পথে যাবে, কোন সমাজে যাবে! মাঝে মাঝে আত্ম-হত্যা করতে ইচ্ছে করে। পরের কাছে আর কতই হাত পাতা যায়! হাতে কাজ নেই- বেকার। হাতে যা কিছু সম্বল ছিল, তা দিয়ে সন্তানদের ঔষধ আর খাবার কিনে সব শেষ করেছে। মিতা আজ সারাদিন পায়ে হেঁটে একটা চাকুরী খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে; এবং খুবই ক্লান্ত। বাধ্য হয়ে একটা বাসায় কাজের আশায় ঢুকেছিল। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া আর বাচ্চা দেখার জন্য আয়া নিবে। বাসার মালকিন না থাকার সুযোগে মালিক মিতাকে টেস্ট করে ছাড়লেন।

মিতা ওই বাসাথেকে কিছু টাকা আর তার সাথে ময়লা নিয়ে এসেছে, বাসায় এক ঘন্টা ধরে শাওয়ার ছেড়ে শরীরটা ধুয়েছে, মুছেছে, তবু- ওইসব ময়লা পরিষ্কার হল না। মিতার মনে হচ্ছে- শেফালী বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছে। আজই বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়ে বসবে কি-না বুঝা যাচ্ছে না। মিতার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে, কিন্তু বাচ্চাদের সামনে কাঁদতে পারে না, দুই ঠোঁট চেপে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে সে।

বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে; যেন সে নেশা করেছে- হঠাৎ অদূরে নিজের ছায়া দেখতে পায় মিতা। ছায়াটা বলছে ‘তোর জীবনের সব কিছুই ভুলে ভরা মিতা, ভুলে ভরা তোর জীবন...। সারাটা জীবন এই ভুলের মাশুল তোকে দিতে হবে; ভুলের মাশুল দিতে দিতে তুই শেষ হয়ে যাবি..., তোর মরে যাওয়াই ভাল...। তোর দেখাদেখি আরো অনেক মেয়েই নষ্ট হবে..., তুই মরে যা...।’
- নাহ্- আমি মরে গেলে আমার সন্তানদের কি হবে!
- কেন, না খেয়ে-পরে ওরাও একদিন মরে যাবে, নয়তো বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষা করবে, টোকাই হবে; বড় হলে চোর-গুন্ডা-মাস্তান-বদমাশ হবে...। আর তোর মেয়েটা বেশ্যা...’

‘নাহ্’ - যেন তার গলাটা কেউ চেঁপে ধরেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দর-দর করে সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে মিতার। অনেক কষ্টে অন্যদিকে মুখ ঘুরায় সে। ওদিকেও আর একটা ছায়া; তারই, ‘ভাল-সৎ কোন আদিবাসী মেয়ে যে নিজের জাত ধর্মকে ভালবাসে, সম্মান করে; সে কি অন্য কোন জাতি ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করতে পারে! তবু যদি সুখে থাকতিস্..., তোকে তালাক দিয়েছে..., এবার তোর কি হবে...? প্রতারক! তুই নিজের সাথে প্রতারনা করেছিস্..; নিজের জাতটাকে অপমান করেছিস্..., তোর বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে বেঈমানি করেছিস্...; তাদের আজীবন লালিত স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা সব কিছু ধূলিস্যাত করে দিলি..., তোর মত হতভাগীর মরে যাওয়াই ভাল...। তুই মরে যা...। তোর আদিবাসি সমাজ সান্তনা পাবে...’
‘নাহ্-’ আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরায় মিতা। ‘আদিবাসিদের জীবন-সমাজ-সংসার; প্রকৃতির মত কত সুন্দর! অথচ তুই...। তোর জাতির লোকজন নিজেদের পচাঁনব্বই ভাগ শিক্ষিত বলে দাবী করে...। কিন্তু এমন শিক্ষার কি কোন মূল্য আছে...? যে শিক্ষায় নিজেদের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে হবে...। মিতা তুই এত লেখা পড়া করেছিস..., নিজেদের এই ক্ষুদ্র জাতির জন্য কিছু না করে বরং উল্টোটি করলি...? এই ভাবে নিজের হাতে নিজের জাতটাকে গলা টিপে হত্যা করছিস্... এবার তুইও মরে যা, যা-যা...।’

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায় মিতা। মিতার বাচ্চা দু’টো ভয়ে জোরে জোরে ‘মা, মাগো...’ বলে কান্না-কাটি করছে। বাচ্চাদের কান্না শুনে শেফালী আর তার স্বামী ছুটে এসে হাঁপাচ্ছে। দুজনই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তারা কেউ জানে না, মিতার জ্ঞান ফিরবে কি না..

উপজাতির আধুনিকীকরণ নাম "ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী"

উপজাতির আধুনিকীকরণ নাম "ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী"
                                                                  ফিডেল ডি সাংমা

 সব পাখির মতো কোকিলও পাখি। অথচ সব পাখির গুণ ওদের মধ্যে নেই; যেমন-
 ওরা নিজেরা বাসা তৈরী করতে পারে না। অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে। বলাই বাহুল্য-
 ডিমে তা দেওয়া, বাচ্চা ফুটিয়ে মমতা দিয়ে সন্তান লালনপালন করা ওদের ভাগ্যে
 জোটে না। অন্যান্য পাখির মতো তাদেরও জন্ম, মৃত্যু, আবেগ আছে; ভাষা, সুর
 আছে। অদ্ভুত মাতাল করা সুর; কিন্তু ওদের এই সুর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য
 দারুনভাবে, রোমান্টিকতায় ভরা। প্রকৃতির মাঝে বসন্তকে জাগিয়ে তোলে, মানুষের
 হৃদয়কে আন্দোলিত করে, প্রেমকে বাঙ্মময় করে তোলে, কোকিলের সুর ।

 আদিবাসিরাও মানুষ। একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট জীব; সবার মতোই রক্ত-মাংসে গড়া।
 নিজস্ব পরিবার-পরিজন, সমাজ-সংস্কৃতি, জন্ম-মৃত্যু, ভাষা-ধর্ম-কর্ম তাদেরও আছে;
 আছে আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য আনন্দ, হাসি কান্না, মান অভিমান সব।
 তবে এরা মানুষ প্রজাতির হলেও আলাদা কোন জাতি নয়; উপজাতি ( জাতির আবার
 উপ হয় কি করে; এই নাম দেনেওয়ালারাই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন)। ইদানিং
 আবার উপজাতি নামটাকে আধুনিকীকরণ করে নাম দিয়েছেন- ক্ষদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’।
 এ জনগোষ্ঠীর লোকেরা আবার নিজেদের আদিবাসী বললে খুশি হন। বাহ! নামের কি
 বাহার! আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো- এই সব মানুষ মঙ্গোলীয়ান,
 নিগ্রোয়েট, ককেশিয়েট এবং অষ্ট্রালয়েড জাতির অন্তর্ভূক্ত (বাঙ্গালীর মতো ৪টি জাতির
 সংমিশ্রণে তৈরী সংকর/ পাঁচমিশালী। হাইব্রিড জাতি নয়।) এদের নাক খাটো, বোঁচা এবং
 চোখ ছোট। তাই বলে খাটো, বোঁচা নাক দিয়ে নিশ্বাস কম নিতে পারেন এবং ছোট চোখ
 দিয়ে কম দেখেন বলে কোন চিকিৎসক বা বিজ্ঞানী প্রমান দিতে পারেন নি। বরং জনশ্রুতি
 আছে- বাঙ্গালীদের তুলনায় এদের শরীরে নাকি রোগ প্রতিরোধ মতা বেশী।

 বেশ কয়েকদিন আগে আমার ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে স্কুলথেকে শুনে এসে আমাকে জিজ্ঞেস
 করলো, ‘ বাবা আমরা নাকি বাঙ্গালী জাতির মতো কোন জাতি না, ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’র
 লোক; আমরা গারো কি জাতি না? তাহলে ওদের কেন ‘বৃহৎ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ জাতি বলা
 হয় না, কেন ওদের বাঙ্গালী জাতি বলা হয়?’
 - এর উত্তর সহজ না বাবা, এর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন এসময়ের আওয়ামী
 বুদ্ধিজীবি আর আমাদের নেতানেত্রীরা...’।
 সন্তানকে এইটুকু প্রশ্নের সমাধান (বা জাতি বর্ণবিভেদমূলক মনোভাবের কারণ বর্ণনা) করতে
 না পারার লজ্জা আমাকে এখনও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। হিন্দু অধ্যুসিত দেশ ভারতে মুসলমানদের
 ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ বলা হয় কি না এদেশের বাঙ্গালী জাতির লোক
 ভালো বলতে পারবেন।

 বাংলাদেশে বাঙ্গালী ছাড়াও আরোও ৪৫টি জাতি (আদিবাসি) আছে। আবার সব আদিবাসিদের
 মধ্যেই গ্রামে, এলাকায় ছোট বড় অনেক সংগঠনের নেতানেত্রী আছেন। এমনকি আদিবাসিদের
 মধ্যথেকে বড় বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যেও নেতা-নেত্রী, এমপি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর আসনে
 আছেন। জনসংখ্যা গরিষ্ঠ্য হলেও বাঙ্গালী জাতি কিন্তু একটাই। এই একটা (বাঙ্গালী) জাতি
 আমাদের ৪৫টি জাতিকে দাবিয়ে রাখার জন্য, অবমূল্যায়ণ করার জন্য ১৭ কোটি যুক্তি/ধারা
 চাপিয়ে দেন নি। এমন কি আমাদের ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ বলার জন্য ৪৫টি যুক্তি/ ধারাও
 নেই। লাম-সাম-যদু-মদু ধরণের হালকা খোঁড়া যুক্তি দেখিয়েই আমাদের ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র
 নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ নামটা চাপিয়ে দিল। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, লোকজ-সংস্কৃতির
 বৈচিত্র আনয়নে কি আমাদের কোনই অবদান নেই? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের
 অংশগ্রহণের কি কোন মূল্য নেই? দেশের ১৭ কোটি জনগন এবং ১৩ কোটি ভোটার কি
 আমাদের বাদ দিয়ে..? তাহলে আমাদের প্রতি এমন শ্রেণী বৈষম্যমূলক আচরণ কেন? আমাদের
 এই দেশেই পশুপাখি রার জন্য বিজ্ঞাপন, শ্লোগান, পোষ্টার, লিফলেট, ব্যানার, সাইনবোর্ড,
 বিলবোর্ড হয়, বিশেষ দিবস উদযাপিত হয়; তবু আদিবাসিদের জন্য কিছুই হয় না, কোন দিবসও
 উদ্যাপন হয় না। এটাই পরিতাপের বিষয়। আমাদের আলাদাভাবে পূর্ণ জাতির স্বীকৃতি
 মর্যাদা দিলে কার কি তি হবে?
 রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আদিবাসি নেতৃবৃন্দ আপনারা জবাব দেবেন কি- আপনা কেন,
 কাদের জন্য নেতা নেত্রী হয়েছেন? আমাদের মতো নাদান সাধারণ জনগনকে কি করে
 ভুলে যান? জনগণ অনেক প্রত্যাশা করে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের ভাত-কাপড়ের পয়সা খরচ
 করে কি  আপনাদের ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন নি? তার প্রতিদান কি এই?
 আদিবাসি নেতৃবৃন্দদের কেউ কি ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’র জন্য নীতিমালা/ধারা প্রনয়ণে
 জড়িত ছিলেন? .. আগে বা পরে প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রি বা স্বরাস্ত্র মন্ত্রনালয়ের সাথে কথা
 বলেছেন? নাকি আপনাদের ব্যাক্তিগতভাবে পদমর্যাদা, দানসামগ্রী অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা
 দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছেন? পরেরবার নিশ্চয়ই নির্বাচনে দাঁড়াবেন? তখন আমরাও
 কিন্তু জবাব চাইবো; আপনাদের মূল্যায়ণ করবো। অতএব এই কথাগুলো সেদিনের জন্য
 তোলা রইলো...। আপনারা দয়া করে প্রস্তুত থাকবেন.

চিতায় পোড়ে- স্বপ্নবাসর

চিতায় পোড়ে- স্বপ্নবাসর

ফিডেল ডি সাংমা

জানি, কৈশোরের তুলতুলে কিশোরী নও আর
ছলছলাৎ পূর্ণ যৌবনা; স্বপ্নে স্বপ্নে ছুটে চলার
গায়ের মেঘে গড়েছে আমার শহুরে বেলা
স্বপ্ন নিয়েই তোমার সাথে করছি বসবাস।
আজ অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম
একি দেখলাম, শুনলাম, কেন জানলাম !
উদাস চোখ; এলো চুল, পরনে সাদা শাড়ী
উচ্ছ্বল হরিণী; চঞ্চলতাহীণ অবলা নারী।
কেমন করে- চিতায় পোড়ে- স্বপ্নবাসর
শুধুই আমার- প্রিয়তমার- স্বপ্নে আগুণ,
কেন কাটে না- স্বপ্ন কন্যার- দুঃখ ফাগুণ

অবতরণিকা- Edited (FinaL)

আব্দুস সাত্তার বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। লেখককে আমি চিনি প্রাবন্ধিক, কবি, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার প্রথিতযশা সাংবাদিক হিসাবে। তাঁর স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিভা শুধু ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ নিয়ে নয়; বাংলা সাহিত্যকে ঘিরেও। তাঁর মূল্যবান লেখনী আমাদের দেশ ও দেশের মানুষের হাসি- আনন্দ- ভালোবাসার, সুখ-দু:খ-বেদনার কথা বলে।

প্রবন্ধগুলো আমি খুব মনযোগ দিয়ে পড়েছি। গ্রন্থে ১৫টি প্রবন্ধ রয়েছে। পাঠকদের পাঠ করার সুবিধার জন্য প্রবন্ধগুলোকে তিনি প্রধান দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন। তা হচ্ছে- ‘শিশু ও পরিবার’ এবং ‘দেশ ও সমাজ’। তাঁর এ লেখাগুলোতে অনেক গুরুত্ব পূর্ণ কথাগুলো খুব সহজ ও পাঠযোগ্যভাবে উঠে এসেছে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি বলেছেন, শিশু বয়সই হল চরিত্র ও মেধা গঠনের মূল সময়। শিশু বয়স থেকেই তাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সুখময় করে তুলতে, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং ভাতৃত্ববোধ বজায় রাখতে অভিভাবকদের আন্তরিক সাহচর্য্য, প্রচেষ্টা অপরিহার্য। তাঁর সাথে নীতিবোধ, ধর্মীয় জ্ঞান আহরণ করার যে পরামর্শ রেখেছেন তা আমাদের সবারই মেনে চলা খুবই যুক্তিপূর্ন।

সমাজ চিন্তায় ও কর্মে, সাহিত্য চিন্তায় ও চেতনায় কন্যা-জায়া-জননীরা হয়ে উঠতে পারে ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ জাগরণের শ্রেষ্ঠ আলোকবর্তিকা। উক্ত কথাগুলোই মা দিবস নিয়ে মাকে এবং নারী দিবস নিয়ে লেখায় নারীদের যথাপোযুক্ত সম্মান প্রদান খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। “আমার বাবা” এবং "বন্ধুত্ব" প্রবন্ধে আমি খুঁজে পাই আরেক আব্দুস সাত্তারকে। যার আবেগ, অনুভূতি আর সহিষ্ণুতা, নম্রতা খুবই গভীর। তিনি বলেন, জন্মতাদা যে কোনো ব্যক্তিই হতে পারে, কিন্তু স্নেহশীল পিতা হওয়া এক দুর্লভ বিষয়। ধার্মিক, সাহসী, নির্ভীক ও আর্দশ পিতার সন্তান হিসাবে যিনি নিজেকে গর্বিত মনে করেন এবং নিজেও পিতার আদর্শে নিজের পিতৃত্বকে সুখি ও সফল হওয়ার বাসনায় বদ্ধপরিকর।

অপরদিকে “শিক্ষা ও সত্য”, “শিক্ষা ও সত্য অর্থদণ্ড শিক্ষার মেরুদণ্ড, শিক্ষা নয়”, “দুঃখবোধই প্রতিষ্ঠার উপায়” “ঘুষ ও দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি” প্রবন্ধগুলোতে লেখক দেশ ও সমাজের চলমান মন্দ বা ক্ষতিকারক পরিবেশ, পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের পথও দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আগুনে পোড়ালে যেমন খাঁটি সোনার পরিচয় স্পষ্ট হয়, তেমনি দুঃখের দহন মানুষকে খাঁটি মানুষে পরিণত করে। আঘাতে আঘাতে, বেদনায় বেদনায় মানুষের মনুষ্যত্ববোধ, সত্যনিষ্ঠা ও বিবেকবোধ জাগ্রত হয়। দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ-তীতিক্ষা ব্যতীত কোনো মানুষই জীবনের যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন না।” অথচ আমরা ক্ষণিকের সুখের আশায় অন্যায়- দুর্নীতিতে জড়িয়ে নিজের ও পরের জীবনকে নির্মল চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াই। তিনি জীবনের সাময়িক দুখ-কষ্টকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে খাটি মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টাকেই গুরুত্বারোপ করেছেন ।

দেশ ও সমাজের উন্নয়নকল্পে স্বদেশপ্রেম ও শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই লেখক “স্বদেশপ্রেম” প্রবন্ধে বলেছেন, স্বদেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠতর গুণ। দেশপ্রেমের মূলে রয়েছে দেশের ভূখণ্ডকে ভালোবাসা; স্বদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসা; জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে দেশের মানুষকে ভালোবাসা,সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। স্বদেশ ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ঈমানের অংশ। তথ্যবহুল লেখা “১৯৭১সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাত”,  "ওবামার বিজয়: আরেকটি ৯/১১" এবং "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন কথা" প্রবন্ধগুলো না পড়লে পাঠককুল বড় ধরনের মিস করবেন। কঠোর পরিশ্রম করে প্রবন্ধটি লিখে দেশ মাতৃকা এবং সাহিত্যকে ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি।

প্রাবন্ধিক, কবি, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক আব্দুস সাত্তারের সাহিত্যাঙ্গণে উত্তরোত্তর সফল হোক আমি আন্তরিকভাবে কামনা করছি। তাঁর এই বইটির অবতরণিকা লিখতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।

সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়...
ফিডেল ডি সাংমা

কষ্ট আড়াল কষ্টগুলো

মানুষ মৃত্যুর কয়েক মূহুর্ত দূরে; তবু কেউ ভাবি না
শুধুই এক পা, দুই পা করে সম্মুখ পদক্ষেপ,
অপ্রতিরোধ্য দূরদৃষ্টি; হাওয়া ভেদ করে
সামনের দিকে; এগিয়ে চলাই কাজ।

জন্মান্ধ নই কেউ- তবু কেউ দেখে না,
হাসির প্রলেপে মনের ভেতর কতটা কষ্টের স্তুপ;
আর ক্ষণিক আনন্দের বলিরেখায় অশ্রু- বাঁধ।
ভেতর বাইরে; দৃষ্টিতে শুধুই চাপা-চাপি, ধাপাধাপি!

কষ্ট বিরহের পরেও কষ্ট থাকে? নাকি শুধুই বিরহিনীর?
বিরহিনীর ভেতর নিভৃত আবাস আমার
কেউ জন্মান্ধ নই -
তবু কষ্ট আড়াল কষ্টগুলো কেউ দেখি না

দৃষ্টিহীণ চোখেও ঝিলিক স্বপ্ন থাকে, জানো?

জন্মান্ধের চোখে জল ঝরতে দ্যাখেছো, কখনো?
স্বচ্ছ, প্রখর দৃষ্টিবানের মতো; নোনটা ঝিলিক।
গভীর ক্ষত হতে ঝরে, অবিরাম, পাথর বোঝা কষ্ট
ভারি বৃষ্টির মতো, নদী-ঝরণার মতো; দ্যাখো নি-
বুকের ভেতর লেপ্টে থাকা, ভারি কষ্টদায়ক কষ্ট।

দৃষ্টিহীণ চোখেও ঝিলিক স্বপ্ন থাকে, জানো?
স্বপ্ন দ্যাখতে দৃষ্টি লাগে? না; শুধু অনুভবের।
অনুভবেই সাদাকালো স্বপ্নগুলো হয়ে ওঠে রত্ন
হাত বাড়াও, ছুঁয়ে দ্যাখো শিশির-শিশির মসৃণ;
দীর্ঘশ্বাসে, নিখুঁত ভাঁজে- স্বপ্নের ভেতর নতুন স্বপ্ন

আবির্ভাব ম্যাগাজিন এবং আমার অনুভূতিঃ

আবির্ভাব ম্যাগাজিন এবং আমার অনুভূতিঃ
 ফিডেল ডি সাংমা

আবির্ভাব; একটি ম্যাগাজিনের নাম। আবির্ভাব; একটি ম্যাগাজিনের আবির্ভাব। সাহিত্য-জগতে শত সহস্র ম্যাগাজিনের ভিরে আরও একটি নতুন ম্যাগাজিন। যে পত্রিকাটির বাহ্যিক অবয়ব প্রচ্ছদ দেখেই পাঠকদের মন ভরে উঠবে, পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আমাকে এই সুন্দর ম্যাগাজিনটি পড়ে অনুভূতি লিখার জন্য আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে। লেখার এ দায় মুক্তির জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

‘আবির্ভাব’ সদ্য ভূমিষ্ঠ গারো সাংকৃতিক সংগঠন ‘অভ্যুদয়’-এর প্রথম সাহিত্য পত্রিকা। এই সাহিত্য পত্রিকাটি খুললেই প্রথম যে লেখাটি চোখে পড়বে তা হচ্ছে প্রকৌশলী, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ত্ব ও লেখক দিগন্ত সরকার রচিত ‘সৃষ্টি তত্ত্বের অসারতা বনাম বিবর্তন তত্ত্বের সাফল্য’ প্রবন্ধটি। প্রাচীন পৃথিবীর লোকগাঁথায় এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণথেকে পৃথিবী ও প্রকৃতির সৃষ্টিতত্ত্বগুলো সুখ-পাঠযোগ্য হয়েছে।  ইহুদী, ইসলাম ও খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ থেকে উদৃতি দিয়ে ৬দিনে পৃথিবী, স্বর্গ, নরক সৃষ্টিতত্ত্বটি আধুনিক বিজ্ঞানের সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে যৌতিকতায় সাংঘর্ষিক বলে লেখক অনেক গুলো উদাহারন উপমার উল্লেখ করেছেন। যে লেখা বা আলোচনাগুলো পড়লে ধর্ম মৌলবাদীদের বিশ্বাসে এবং মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। ঠিক তেমনই বৈজ্ঞানিক যুক্তিগুলোর বিপরিতেও বিস্তর আলোচনাগুলো পাঠকদের কাছে পাঠযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কোন ব্যাখ্যা বা যুক্তিগুলো কে কি ভাবে গ্রহণ বর্জন করবেন তা পাঠকদের উপর নির্ভর করবে। বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা আমার কাছে বরাবরই কেমন করকরে, নিরস মনে হতো; কিন্তু এই লেখায় আমার মত অনেকেই সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কিত সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে পারবেন।

ক্ষুরধার লেখক ও প্রাবন্ধিক সরোজ ম্রং গারোদের খাদ্যাভ্যাস, মিথ সম্পর্কে অত্যন্ত চমৎকার প্রবন্ধ পাঠকদের উপহার দিয়েছেন তাঁর ‘গাইকা মাংস কেজি ৫০ রূপিয়া লেকিন কুত্তাকা মাংস ১৫০ রুপিয়া’ নামক প্রবন্ধে। তিনি এই প্রবন্ধের শুরুতে আক্ষেপ করে বলেছেন, “এ পর্যন্ত যে সকল তথাকথিত লেখক,গবেষক ও ঐতিহসিকগণ গারোদের জীবন ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে তথ্য উপস্থাপন করেছেন সে সব তথ্যের সিংহ ভাগই ভিত্তিহীণ, ভুল ও বিভ্রান্তিকর। তাঁরা গারোদের (এমনকি অন্যান্য আদিবাসীদের) খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ, নোংরা  ও বিকৃত তথ্যের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন, মনে হয় যেন এই গারোরা অজানা কোন ভিন গ্রহথেকে নেমে আসা দৈত্য- দানব, ভয়ংকর রাক্ষুসে প্রজাতির বা স্বভাবের”। বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্য সংস্কৃতির প্রামান্য দলিল বাংলাপিডিয়া সহ বিভিন্ন লেখক, গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণালব্ধ পুস্তক, ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য-পুস্তক এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকার এই সমস্ত বিভান্তিকর তথ্য দিয়ে রেখেছেন। এ লেখক এসব ভূয়া তত্ত্ব ও তথ্যের সংশোধনের গুরুত্বারোপ করেছেন। আমার মনে হয় ‘আদিবাসী ফোরাম’ উদ্যোগ নিতে পারে। তাঁরাই দেশ বিদেশের বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ের মাধ্যমে সংশোধন, পরিমার্জনের উদ্যোগ নিতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আদিবাসী মুক্তিযওদ্ধারা এখনোও অনেকটা ইতিহাসের অন্তরালেই রয়ে গেছেন। কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলেজ শিক্ষক জনাব শফিউদ্দিন তালুকদার তাঁর ‘আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা’ প্রবন্ধে এমন অনেক গারো মুক্তিযোদ্ধাদের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মাত্র মোট পাঁচজন আদিবাসী গারো মুক্তিযোদ্ধা মাতিয়াস সাংমা, নিকোলাশ মারাক, শিমন সাংমা, দিপার্শন ঘাগ্রা, ধীরাজ মারাক এবং প্রদীপ তজু; উনাদের স্বাধীণতার যুদ্ধে দুঃসাহসিক অংশগ্রহনের কাহিনী এবং এই স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করেও তাদের পরিবারের চরম দূর্দিনের পরিনতির কথা প্রাঞ্জলভাবে ভাবে উপস্থাপন করছেন। আরো অনেক গারো মুক্তিযোদ্ধা আছেন তাদের বর্তমান অবস্থাও তদ্রুপ। সরকারী বেসরকারীভাবে এই মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসাধ্য সম্মান-মর্যাদা প্রদানের দাবী রাখেন। তাদের পরিবারের চরম দূর্দিনের সাহায্য সুবিধা প্রদানের জন্য লেখক জোড় সুপারিশ করেছেন।

মধুপুর শালবনবাসী গারোদের কাছে খুবই পরিচিত একটি নাম, পাভেল পার্থ। যিনি প্রবন্ধকার, সাংবাদিক ও গবেষক। তিনি বহুবার গারো অঞ্চলে এসেছেন, তাদের সাথে থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং দেশ বিদেশের দরবারে আন্তরিকতার সাথে বন ও মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। এমনিই আরেকটি অধিক মূল্যবান, গবেষনাধর্মী, বলিষ্ঠ লেখা উপহার দিয়েছেন ‘গারোদের বন নির্ভর অভিজ্ঞতায় প্রাকৃতিক শালবনের উদ্ভিদ বৈচিত্র্য মূল্যায়ন ও রাষ্ট্রের বিরোধী উদ্যোগ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। এটিই আবির্ভাব ম্যাগাজিনের লেখাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক পৃষ্ঠা সম্বলিত নিরিক্ষা ও গবেষনাধর্মী লেখা প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠ্যী ও আদিবাসীদের সাথে স্থানীয় উদ্ভিদ প্রজাতির বৈচিত্রময় ব্যবহার বা সম্পর্কের কথা গুরুত্ত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন লেখক মহোদয়। তিনি লিখেছেন, মধুপুর শালবনের বৈচিত্রময় উদ্ভিদ প্রজাতি স্থানীয় আদিবাসিদের জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করছে, কোন কোন উদ্ভিদ কি কি কাজে ব্যাবহৃত হয় ইত্যাদি।

জেমস জর্নেশ চিরান রচিত ‘হাজং ও গারো জাতিসত্ত্বাঃ রাষ্ট্রসৃষ্ট এথনিক দূর্যোগ’; শুভাশিস সিনহা রচিত ‘লোক সংস্কৃতিঃ প্রেক্ষিত মণিপুরী সমাজ’ এবং কুঙ্গ থাঙ্গ রচিত ‘বাংলাদেশের মণিপুরি সমাজঃ তাদের আদিধর্ম ও ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি’ প্রবন্ধগুলো আবির্ভাব ম্যাগাজিনের মূল্যবান নিরিক্ষাধর্মী ও আনন্দদায়ক লেখা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয় ভাবে উপেক্ষিত। তার উপর আবার প্রাকৃতিক ও পারপার্শিক সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠ্যীর দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নির্যাতন ও চাপের মধ্যেই বসবাস করতে হয়, সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। এমনই পিছিয়ে পরা আদিবাসীদের অতীত, বর্তমান অবস্থা এবং এদের ব্যাক্তি, পরিবার, জাতি ও সামাজিক ভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা এবং এথেকে পরিত্রাণের গুরুত্ত্বারোপ ও সমূহ সুপারিশসম্পর্কিত  লেখা প্রবন্ধগুলোতে সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত হয়ছে। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উক্ত লেখক তিনজনই উপস্থাপনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন; যা পাঠ করে পাঠকগণ ভালো ধারনা লাভ করবেন এবং আনন্দও পাবেন। তাঁর সাথে ক্রাউন ম্রং এর রসাত্মকবোধের ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’ লেখাও পাঠকদের আনন্দ দিয়েছে আশা করি।

আধুনিক যুগের যুবক যুবতির প্রেম-বিরহকে উপজীব্য করে লেখা হিমেল রিছিলের ‘উত্তীর্ণ অতীত’; তিতির এবং একটি ছোট্ট ছেলের মধ্যে মায়া-মমতা, বিশ্বাস- অবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সুপর্ণা পলি দ্রং-এর ‘ছাতা’; প্রত্যাশিত গারো যুবক (আদিত্য)-কে না পেয়ে অগারো যুবক মার্ককে বিয়ে করেও স্বজাতির প্রতি টান, মমত্ববোধ, পরিবার, মা, বাবা, ভাই-বোনের প্রতি ভালবাসাকে উপজীব্য করে গ্লোরি রুরাম-এর ‘দ্বিধা’; অবৈধ প্রেম, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার অক্ষমতা বা আবেগকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয়ার কুফলকে উপজীব্য করে সাইনী চেক্সী ম্রং-এর ‘ভালবাসি যারে’ এবং মদোমাতাল, উদাসীন গারো যুবক (প্রেনিশন দালবত)-এর ব্যাক্তি ও পারবারিক দৈন্য জীবন, সামাজিক কুসংস্কার এবং সাংসারিক টানাপোড়েনের কাহিনীকে উপজীব্য করে বচন নকরেক-এর ‘জাগর স্বপ্ন’ ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর গল্পগুলো স্থান পেয়েছে এই ম্যাগাজিনে।

কবিতাগুচ্ছে স্থান পেয়েছে অনেক নবীন প্রবীণ কবিদের কাব্য। এর মধ্যে মতেন্দ্র মানকিন’এর ‘গারো মানুষের পঙক্তিমালা’; সুপর্ণা  পলি দ্রং-এর বৃষ্টি; ফিডেল ডি সাংমা’র ‘চেতনা’; প্রাঞ্জল এম, সাংমা’র ‘যে দুঃখ বুঝে না সবাই’; অরণ্য ই চিরান-এর ‘বিষাক্ত ঢেউ তোমার বুকে’ সরোজ ম্রং-এর ‘স্বপ্ন ও শেকড়ের ফুসফুসে ক্যানসার’; সমিক চিসিম (শমী)-এর যৌবনের আহবান’; ইকবাল মাহমুদ’এর সাঁওতালি মেয়ের গান’; তুই মৃ’র ‘আদিবাসী’; সাগর ডিব্রা’র ‘চিন্তা’; সুবির জে’ নকরেক’এর ‘এসো যুদ্ধ করি’; টাইটাস দফো’র ‘জয়ানন্দের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে চন্দ্রআবতী’; অন্বেষা ম্রং-এর ‘তোমাকে ভালবাসি’; হিমেল রিছিলের ‘দৃশ্য কাব্য’ ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর কবিতাগুলো কম-বেশি সুন্দর ও পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছে এই ‘আবির্ভাব’ ম্যাগাজিনটিতে।

আবির্ভাব ম্যাগাজিনে আরও কয়েকটি লেখা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। যেমন- প্রথমত, ‘প্রধান শিক্ষকের কাছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের চিঠি’। এই চিঠিটি পড়লে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের শিক্ষা প্রদানে উৎসাহিত করবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর দ্বিতীয়ত, ‘বাঙ্গালীভিন্ন অন্য জাতিরা উপজাতি বা আদিবাসী কেন? কেন ভেন্ন জাতি নয়?’ শীর্ষক ফেইসবুকীয় সংলাপটি। এই লেখায় ফেইসবুকের অনেক বাঙালি, অবাঙ্গালি ব্যাক্তিবর্গ উপজাতি বা আদিবাসী নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন।

আরো একটি মূল্যবান লেখা এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। তা হোল- কবি ও প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পি জেমস জর্নেশ চিরানের সাক্ষাতকার পর্বটি। যিনি গারোদের মধ্যে দ্বিতীয় কবি যিনি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য গারোদের মধ্যে কবি প্রশান্ত কুমার জ্যাম্বল সঞ্চয়ন ১, ২, ৩ নামে যথাক্রমে ১লা অক্টোবর, ১৯৯০; জানুয়ারী ১৯৯২ এবং ১৯৯৩ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। জেমস জর্নেশ চিরান তাঁর সাক্ষাতকার প্রদানের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারক, লেখক, গবেষক, প্রকাশকদের উদ্দেশ্যে সুন্দর প্রস্তাবনা এবং উদ্যমী হওয়ার পরামর্শ রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘উদ্যোগ আশা ব্যঞ্জক হলেও লেখা সংগ্রহ ও প্রকাশনার খুব একটা যত্ন আছে বলে মনে হয় না। সাময়িকী সমূহের আঙ্গিক ও পরিধিতে আধুনিকতার স্পর্শের অভাব। অনেকের লেখায় রাতারাতি কবি ও লেখক বনে যাওয়ার অপচেষ্টা বিরক্তিকর। লেখার চেষ্টা অব্যাহত থাকলে প্রতিভার সাক্ষর রাখতে পারবেন”। উনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রাপ্তি নবীন লেখকদেরও প্রেরণা যোগাবে বলেই আমার বিশ্বাস। আসুন আমরা এই সুন্দর পরামর্শ কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।
আরো একটা লেখার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ না করলেই নয়। ‘অনলাইন’ বিভাগ; হিমেল রিছিলের লেখা অথবা সম্পাদনা “তৈরী করুন আকর্ষনীয় ফ্ল্যাশ ওয়েবসাইট”-টি। লেখার বর্ণ্না চমৎকার। যারা ওয়েবসাইট তৈরী করতে চান, তাদের জন্য লেখা কাজে আসবে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমিও জানতাম না; আমারও কাজে লাগবে। কিন্তু আবার মনে হলো, অনিয়মিত বা বাৎসরিক পত্রিকায় এই লেখা কেনো? আমি অনেকবার ভেবেছি, আমরা কতজন ওয়েবসাইট তৈরী করবো কিংবা ব্যবহার করবো। এই ম্যাগাজিনের পাঠকদের শতকরা দুইজনেরও তেমন কাজে লাগবে কি?

সব মিলিয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে এই ‘আবির্ভাব’ ম্যাগাজিনটি। তারপরোও পরবর্তি প্রকাশনার জন্য আমার পক্ষথেকে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখার জন্য প্রস্তাবনা থাকবে। তা হোল-
  • যদি এই ম্যাগাজিনটি শুধুমাত্র আদিবাসী গারোদের জন্য; তবে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হবে, এমন লেখা আরোও বাছাই করা হোক
  • লেখক লেখিকাদের অভিজ্ঞতা(বয়সভিত্তিকও হতে পারে), লেখার বিষয়বস্তু ও মান অনুসারে লেখাগুলো সাজানো হোক
  • প্রবীণ লেখকদের লেখা সংগ্রহ ( যদিও প্রবীণরা লেখা দিতে উৎসাহ বোধ করেন না) এবং ছাপানো হোক
  • গারোদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক লেখা হোক
  • অতীব প্রয়োজন না হলে একই লেখকের একাধিক লেখা না ছাপানো হোক
  • অন্যান্য পত্র পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের মত বিজ্ঞাপন এবং শুভেচ্ছাবানী বই জুড়ে না দেওয়া (এই ম্যাগাজিন আমি সাচ্ছ্বন্দে পড়েছি, কারণ এতে প্রায় সব বিজ্ঞাপন ও শুভেচ্ছাবানী শেষের দিকে দেওয়া হয়েছে।) ইত্যাদি।
  • সর্বোপরি আবির্ভাব ম্যাগাজিনটি আমার খুবই ভালো লেগেছে। এই ম্যাগাজিনটি আমাদের গারোদের জন্য উৎকৃষ্ট, উদাহারন ও অনুকরণীয় ম্যাগাজিন হোক এটাই আমার চাওয়া। আসুন আমরা একযোগে এগিয়ে চলে আগামী সুন্দরের দিকে।
  • সবাই ভালো থাকবেন ধন্যবাদ পাঠক সবাইকে এবং ধন্যবাদ সম্পাদকমন্ডলী ও কলাকুশলীবৃন্দ..

মধুপুর, আমার জন্ম-ভূমি; মধুপুর

মধুপুর, আমার জন্ম-ভূমি; মধুপুর
ফিডেল ডি সাংমা

মধুপুর, আমার জন্ম-ভূমি; মধুপুর-
আনন্দ-হাসি আর উচ্ছাসে ভরপুর।

যার শ্যামল শালপাতার সবুজ স্পর্শে
মায়া মমতা জাগে অন্তহীণ
যার বংশাই জলের শীতল স্পর্শে
হৃদয়ে জাগে সুখের বীণ।

যেখানে বাঙ্গালী-গারো; থাকি গলাগলি
মা, মাটির উন্নয়ন, একতার কথা বলি
মধুপুর, আমার জন্ম-ভূমি; মধুপুর-
 কষ্ট ঘুচানোর সবার বজ্রকন্ঠ; একই সুর।

যেখানে মনের মত নেতা চাই
নেট চাই, গ্যাস চাই, জেলা চাই,
মধুপুর, আমার জন্ম-ভূমি; মধুপুর-
সবার চাওয়া মধুপুরবাসীর কষ্ট দূর।

মধুপুর, আমার জন্ম-ভূমি; মধুপুর-
মধুপুর হোক আনন্দে সুখে ভরপুর

দাঁড়াও পথিক

দাঁড়াও পথিক!
*ফিডেল ডি সাংমা*

হে লক্ষ্যহীণ পথভ্রষ্ট পথিক, সুদূর চীন- তিব্বত- আসাম হয়ে
বুকে একসাগর আশার বোঝা নিয়ে- চলেছো কোথায় তুমি; দাড়াও।
খ্রীষ্টপূর্ব দুই হাজার হতে; ততধিক কালে এসেও, তবুও ছুটে চলা-
লাগামহীণ অশ্বের মতো, উর্ধ্বমূখী কিসের মায়ায়; কোন মরিচিকায়।
তাতারা-রাবুগা, কালকমে, নাওয়াং তোমায় কি দেয় নি শান্তির আকাশ
দেবী সুসমী, আসিমা দিংসিমা হাসছে না কি মুখ টিপে রঙ্গ দেখে,
সালজং কি দেখছে না তার প্রেরিতের হাতে গড়া কৃত্রিম সংস্কৃতিকে।
ছিঃ দবুক দকা ভালো ছিলো না, লিভ টুগেদার ভালো কি?
ওয়ানগালা, রংচু’গালা ভালো ছিলো না, কমিউনিটি সেন্টার ভালো কি
খারি, কাপ্পা, উয়িতেপা ভালো ছিলো না চাইনিজ পোলাও ভালো কি
ভালো না দকমান্দা-দকসারি; ধাঁধানো ফিনফিনে জামদানী ভালো কি
মসলিন আর দামী গহনায় প্রসাধনীমাখা দেহখানা জড়িয়ে,
দাঁড়ালে দামী আয়নায়; তবু দেখো নি নিজেকে, নিজের চেতনাকে।
পথভ্রষ্ট পথিক! চলো ফিরে যাই ফেলে আসা সবুজ অরণ্যে,
মায়ের কাছে, ভাষার কাছে, আজিয়া রেরের সমাজ-সংস্কৃতির কাছে।
চলো ছুঁড়ে ফেলে দেই দূরে; মেকি সভ্যতা, হিংসা-বিদ্বেষ,
হাতে হাত ধরে, আত্ম-অহঙ্কার ছেড়ে এসো গড়ি মহামিলনের ঘর
সকলে মিলে প্রতিটি হৃদয়ে রেনেসাঁর বীজ বুনি, স্বপ্নের, চেতনার

আমার নানান রঙের দিনগুলি

আমার নানান রঙের দিনগুলি 
ফিডেল ডি সাংমা


আমি জন্মগতভাবে জলছত্র গ্রামের (মধুপুর, টাঙ্গাইল)। কিন্তু আমার শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলো কেটেছে সাইনামারী গ্রামে। আর বাকী দিনগুলো কেটেছে বয়জ হোষ্টল নামক বন্দিশালায়। আমি যখন ক্লাশ টুতে পড়ি, তখন বাবা পরিবারসহ চলে আসেন তাঁর বাবার বাড়ি সাইনামারী গ্রামে। পরিবারের বড় নাতির মহাআদর পেয়ে আমি রয়ে গেলাম আমার নানীর কাছে। ক্লাশ থ্রী পর্যন্ত পড়ার পর আমাকেও বাবা-মা নিয়ে আসলেন সাইনামারীতে। ওখানে ক্লাশ ফোরে ভর্তী হলাম। ঘুমথেকে উঠার পর থেকে আবার ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত যার সাথে থাকা, মেলামেশা, স্কুল, খেলা-ধূলা, এক থালাতে করে ভাত খাওয়া; এমন কি মাঝে মাঝে ঘুমাতামও যার সাথে; তিনি আমার পাজং (জ্যাঠা)-এর ছেলে পল; আমার নানা রঙের দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে আসলে আমার এই ভাই পলের সাথে আমার এমন কিছু স্মৃতি আছে, তাই শেয়ার করতে চাইছি...
ঘটনা- ০১
তো একদিন স্কুল ছুটির পর আমরা খিরু (নদী)-তে মাছ ধরতে যাবো সেখানে অনেক পানি, ডুব দিয়ে  মাছ ধরা (রিমছিবা) ছাড়া উপায় নেই। আমিতো সবসময় প্যান্ট পরতেই অভ্যাস্ত। কিন্তু এই গ্রামে তখনও লেংটি পরার চল ছিল। কারণ আজ প্যান্ট ভিজালে পরের দিন স্কুলে যেতে পারবে না, তাই সে লেংটি পরে নিল। আমরা খুব কায়দা করে কলা গাছের খোলটাকে ভাজ করে খকসি (খালয়/ মাছ রাখার পাত্র) বানালাম। এটার সুবিধা মানুষ পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরার সময় খোল-খকসিটা পানির উপর ভাসতে থাকে, আর মাছও পালাতে পারে না। তো আমরা দুজন মহানন্দে মাছ ধরছি আর মজার মজার গল্প করছি। কখন যে বেলা পড়ে গেলো, টের পেলাম না। সারাদিন কড়া রোদের কারনে আমরা মাছও অনেক পেয়েছি। সামনে নদীর জলের উপর একটু ছায়া পড়েছে, সেখান থেকে মাছ ধরেই আমরা উঠে পড়বো। মাছ ধরতে ধরতে আমরা এমনই মজে গিয়েছিলাম যে, কখন তার লেংটিটা পানির স্রোতে ভেসে গেছে, সে নিজেও টের পায় নি। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এবার বাড়ি ফেরার পালা। তার পরনের লেংটি হারিয়ে গেছে বলে তো আর নদীতে থাকা যায় না। উপরে উঠতে হবে, কিন্তু উপায় কি!
লেংটির বিকল্প হিসাবে একটা সঠি (দিগগী) পাতা দিয়ে তাঁকে কোন রকমে ঢেকে ঢুকে রওনা হলাম। উফ! এবার আরো একটা উটকো ঝামেলা দেখা দিলো। নদী থেকে উঠে এসে যে রাস্তা ধরে ফিরবো; ঠিক ওই রাস্তা ধরে আমাদের হেডমাষ্টার বেনেডিক্ট সিমসাং এগিয়ে আসছেন। আমরা অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকলাম, মনে মনে স্যারের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছি কিন্তু তিনি যান না। তিনি পথের ধারেই সমিতির পুকুরের মাছ দেখছেন কিংবা মাছের খাবার দিচ্ছেন। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমরা ভয়ও পাচ্ছি। ফেরার পথে বিরাট বড় বাঁশ বাগান। আর সেখানে আচ্ছু চিদাং-এর মহাশশ্মাণ ঘাট। কদিন আগেই সেখানে মড়া পুড়েছে। আবার মিমাং (ভুত-পেত্নী) নাকি সন্ধ্যায় বেড়োয় আর মাছ তাদের খুবই পছন্দের। ভাবতে ভাবতে আমাদের গলা শুকিয়ে আসছিলো।
ঘটনা- ০২
জাতিগতভাবে গারোরা ভীষণ সংস্কৃতিমনা। তার উপর সাইনামারী গ্রামের লোকজন আরো বেশী। আমাদের গ্রামের বার্ষিক পরীক্ষা সামনে। এদিকে বড়দিনের জন্য গ্রামে নাটকের রিহার্সেল চলছে। আমি আর ওই ভাই মিলে সন্ধ্যায় যুক্তি করলাম। চাঁদনী রাত। আমরা যাবো নাটকের রিহার্সেল দেখতে। আমাদের গতিবিধি দেখে পাজং (জ্যাঠা) আমাদের ধরার জন্য লুকিয়ে ছিলেন। আমাদের পরীক্ষার ব্যাপারে তিনি খুবই শংকিত। অথচ আমরা দুজনই ফার্স্ট, সেকেন্ড বয়। যে পাজং আমাকে তাঁর নিজের ছেলের চেয়েও বেশীই ভালবাসতেন; আজ তিনিই ভাবছেন, আমরা দুই ভাই বুঝি উচ্ছন্নে যাচ্ছি। আমিতো জানতাম না; পাজং আমাদের ধরার জন্য লুকিয়ে আছেন।
গ্রামের রাত! শয়তানের ভয়ে আমি গান গাইতে গাইতে আমি তাদের বাড়ির কাছে পৌঁছলাম। তাদের বাড়ির কাছে পৌঁছতেই “আমার সাথে চালাকি, নাং’গিতা অং জাজক ইন্নেহা চানচিংআমিংনি...” বলেই আমার পিঠে বড় একটা লাঠি দিয়ে বেদম মাইর লাগালেন। পাজং-এর বয়স হয়েছে, চোখেও যেমন কম দেখতেন; কানেও তেমন কম শুনতেন। উল্লেখ্য- আমার ঐ ভাইটা লুকিয়ে আগেই রিহার্সেল দেখতে চলে গিয়েছিলো। পরে পাজং  যখন দেখলেন, আমি উনার ছেলে না; বাড়ি গিয়ে আজং (জয়াঠীমা)-র সাথে আলাপ করে অনুশোচনায় পাজং কেঁদে ফেলেছিলেন। আজং-এর কাছে গল্পটা শুনে আমিও আর একবার কাঁদলাম। সেদিন আজং আমাকে খুব আদর করলেন। পরেরবার যখন তাদের বাড়িতে আসলাম; আমি দেখলাম, আমার পাজং-এর মুখটা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। আমার দিকে তাকাতেও পারছেন না। এই আজং আর পাজং দুজনই এখন স্বর্গবাসী।
ঘটনা- ০৩
আমার আম্বি (দিদিমা)-র গানের গলা ছিলো অসম্ভব মিষ্টি, সুন্দর। আশ্চর্য তার প্রতিভা। আচ্চু (দাদু)-র মৃত্যুর পর তার গানের গলা যেন আরও খুলে গিয়েছিলো। স্কুল কি জিনিশ না জানা সত্ত্বেও নিত্য নতুন গান রচনা করে তিনি গাইতেন। আমি, আম্বি আর এক পাগলা কাকা ঘুমাতাম একই ঘরে। আম্বি খুব ভোরে জেগে উঠতেন আর কাঁদতেন। তিনি কাঁদতেন তো বটেই তবে রেরে, আজিয়া, গ্রাপা জাতীয় গানের মাধ্যমে। রাতকে ভোর সকাল করে তুলতেন। আমিই আম্বির এই বিচ্ছেদ বেদনামাখা কান্নার নিয়মিত একমাত্র শ্রোতা এবং ভক্ত ছিলাম । দিনের বেলা প্রায়ই আম্বি আমাকে তার কাজের জায়গায় নিয়ে যেতেন আর সেই সমস্ত গান শেখাতেন। আমার সাথে থেকে পল, আমার ভাইটির বোধয় অর্ধেক গান শেখা হয়ে গিয়েছিলো।
মাঝে মাঝে আমি আর পল একসাথে ঘুমাতাম; এটা তো আগেই বলেছি। ঘুমানোর সময় তার পাশের জনের উপর হাত তুলে ঘুমানো একটা বদ-অভ্যাস ছিলোই; বিশেষ করে শীতের সময় পেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তার ঠান্ডা হাত গরম করে নিতো। আমি প্রায়ই বিরক্ত হতাম, কিন্তু কোনদিনও শুনতো না। সেদিনও রাতে পল আমার সাথে শুলো। তার ঠান্ডা হাতথেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় চালাকি করে আলাপ জমাতেই আমি বললাম, “চল, কাল দিনের বেলা আমাদের সাথে থেকে কাজ করবে এবং গানও শিখতে পারবে”। সে কোনদিন আমার কথা ফেলতো না, তার উপর গান শেখার সুযোগ। রাজী হয়ে সে গেলো। সকাল হলে আম্বির কাছে বলে আমি তাঁকে নিয়ে নিয়ে সরিষা তুলতে নিয়ে গেলাম।
কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। অনেক বড় সরিষা ক্ষেতে আমরা দুজনই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সরিষা উঠাচ্ছি আর উচ্চস্বরে গান গাইছি। দুপুরে আম্বি আমাদের দুজনের জন্য খাবারটা রেখে আবার পানি আনতে গেলেন। কিন্তু পলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে পেছন ফিরে একমনে সরিষা উঠাচ্ছে আর উচ্চস্বরে গান গেয়েই চলেছে। এদিকে ক্ষিধের চোটে পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাবার যোগার। আমার দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেলো। তাঁকে ডাকতে আর চমকে দেওয়ার জন্য একটা মাঝারি সাইজের মাটির ঢেলা নিয়ে তার দিকে ছুঁড়লাম; লক্ষ্য ছিলো ঢিলটা পরবে তার পেছনে বা কাছাকাছি। কিন্তু না! কি সাংঘাতিক দুর্ঘটনা! ঢিলটা সোজা গিয়ে পড়লো তার গালে। তাঁকে চমকে দিতে গিয়ে আমিই হতবম্ব হয়ে গেলাম। কি করতে গিয়ে কি হয়ে গেলো। অপরাধবোধ আমাকে এমন ভাবে পেয়ে বসলো যা বলে আমি বুঝাতে পারবো না। মূহুর্তের মধ্যে তার গালটা ফুলে নীল হয়ে গেলো। সে শব্দ করে কাঁদছে না তবে চোখ দিয়ে দর দর করে জল ঝরছে। আমি খুবই অসহায় বোধ করছি। আমি কিছু বলার আগেই উল্টো পলের স্বরে সান্ত্বনার বানী ঝরতে লাগলো, ‘দেখো, তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছো, আমি জানি, তুমি ইচ্ছা করে ঢিলটা আমার দিকে ছুড়ো নি’। সে যতই কথাগুলো বলে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে, ততই আমার কান্নার বেগ বাড়ছে। আমি উচ্চস্বরে হাও হাও করে কাঁদছি। তাকে ব্যাথা দেওয়া আর উল্টো আমাকেই সান্ত্বনা; মেনে নিতে পারছিলাম না কোনভাবেই। ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলাম। আমি অনুভব করলাম, এতো কিছুর পরও তার পক্ষথেকে আমার প্রতি বিন্দু মাত্র ভালোবাসা, মায়া-মমতা কমে নি বরং বেড়েছে! এই ঘটনাই বোধয় আমাদের দুজনের ভাতৃত্ববোধ, ভালোবাসা, বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করেছে। আপন মায়ের পেটের সন্তানেরা কজনইবা পারে এমন আপন ভাই কিংবা বোন হতে...?
ঘটনা- ০৪
ঘটনার সময়কাল ১৯৯৯ এর। আমি ওয়ার্ল্ড ভিশন সংস্থায় কাজ করছি। সংস্থার কর্মসূচীর বিরাট পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। নতুন করে কর্মী নিয়োগ, যাচাই বাছাই হবে। এতোদিন বাড়ীথেকে যাতায়াত করে কাজটি করার সুবিধা ছিলো; এখন তাও শেষ হতে চলেছে। কারণ চাকরীটা টিকে গেলেও অনেক দূরে বা অন্য জেলায় গিয়ে জব করতে হবে; এরকমই বলাবলি হচ্ছে।
এদিকে আমাদের বাড়ীতে বড় একটা সাংসারিক বিষয় নিয়ে ঝামেলা চলছে। সংসার শুরুর আগেথেকেই আর্থিক দৈন্যতা আমার জীবনের সাথে ল্যাপ্টে ছিলো। পরিবারে শশুর স্ত্রোকের পর নড়তেও পারেন না। শাশুড়ীর বয়স হয়ছে, সংসার দেখা তো দূরের কথা নিজে এক জগ পানি এনেও খেতে পারেন না। এখন আমি যদি চাকরী করতে দূরে চলে যাই; তাহলে স্ত্রী একা ছোট্ট দুটি ছেলে নিয়ে কিভাবে পুরো একটা সংসার সামলাবে, কি ভাবে তার চাকুরীটা করবে; আমি কিছুতেই ভেবে পাই না। তাই আমি আমার গিন্নীকে বললাম তার চাকরীটা ছেড়ে দিতে, কিন্তু তাতেও রাজী হচ্ছে না। সব কিছু ভেবে আমিই এই চাকরীটা করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতিমধ্যে অফিসে খবর পেলাম, যাদের চাকরী থাকবে না বা করবে না, সংস্থা সে কর্মীদের জন্য চাকরীর বয়স হিসাব করে সেভারেন্স পে (এককালীন টাকা) দেওয়া হবে। ভাবছি, ভালই হলো। যেটুকু টাকা পাবো সেটা দিয়েই আমি কোন রকমে সংসার ম্যানেজ করে চলবো; চালিয়ে নেবো। এদিকে আমার স্ত্রী আমাকেও চাকরী ছাড়তে দেবে না। আমার স্ত্রীও দমার পাত্রী নন; তিনি আমার স্ট্যাটাস এবং সংসারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাকে বুঝাতে বসলেন, বললেন, “আমি নিজের প্রতি প্রচন্ড আত্মবিস্বাসী। তুমি আমার জন্য, বাচ্চাদের জন্য, এই সংসারের জন্য ভেবো না। অভাবকে আমি ভয় পাই না। আমি একাই সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা সামলাতে পারবো; তাছাড়া সংসারে যা আছে আর আমার চাকরীর বেতন দিয়েই আমরা কোন রকমে চালিয়ে নিতে পারবো; সে আত্মবিশ্বাস আমার আছে। কিন্তু চাকরী ছেড়ে তোমারই ভালো লাগবে না। দেখো”। আমি বরাবরই একরোখা মানুষ। আমাকে বুঝানো সহজ সাধ্য ছিলো না। আমার স্ত্রী জানতেন, আমাকে বুঝাতে একজনই পারে; সে পল। ঢাকায় চাকুরি করে। ঠিক এই সময় এই ভাইও ঢাকাথেকে বাড়ী এসেছে। তাঁকে স্ত্রী ডেকে পাঠালেন এবং সব ঘটনা খুলে বললেন। এইবার যাই কোথায়, আমার পালাবার উপায় নাই। পল আমাকে রাজী করাতে আদাজল খেয়ে লাগলো। মন সায় দিচ্ছিলো না তবুও আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে কিছুটা সড়ে আসলাম। কায়মনোবাক্যে আমি চাইছি, ইন্টারভিউতে না যাওয়ার জন্য আমি যেন নতুন বাহানা, অজুহাত খুঁজে পাই।
ক্রমেই আমার ইন্টারভিউর দিন ঘনিয়ে এলো। আমি যদি ইন্টারভিউতে না যাই সেই ভয়ে পল তার ছুটি বাড়িয়ে নিলো যেন আমাকে নিয়েই ঢাকায় যেতে পারে। পলের বাড়ি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তাই সে আগের দিন এসে নিজে ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসলো। কিন্তু সন্ধাথেকে মেরাথন বৃষ্টি পড়ে আমার ইন্টারভিউতে না যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে লাগলো। মনে মনে আমি খুশি। প্রার্থনা করছি, এই বৃষ্টি যেনো না থামে। না ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেন নি। আমি বললাম, ‘ছাতাও তো আনি নি; পরিবেশ আর আবহাওয়ার অবস্থা দেখে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না’। পল শুনলো না; বললো, ‘ঢাকা শহরে ছাতা লাগে না, ওখানে ছাতা ব্যাবহার করলে গেরাম্যা গেরাম্যা লাগে; আনস্মার্ট লাগে...’ বলেই বাচ্চা ছেলেকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে তোলার মত করে আমাকে দোখলা (পিকনিক স্পট) বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসলো। কিন্তু বাজার প্রায় ফাঁকা। ভ্যান রিক্সা কিছুই নেই। বৃষ্টির কারনে ভ্যান ওয়ালারা বাড়ীথেকে বেড় হয় নি। এখন উপায়! দোখলাথেকে রসুলপুর পর্যন্ত ভ্যান নিয়ে পুর ৫ মাইল (প্রায় ৮কিমি) বন পেরোতে হবে। বাড়ীর লোকজন এনে একটা ভ্যানগাড়ি আনালো। আবারও প্রায় টেনে হিঁচড়ে আমাকে ভ্যানে উঠালো। ভ্যান চলা শুরু করে দিয়েছে আর আমার মনটাও আরও  খারাপ হচ্ছে। আমি আবারও পার্থনা করছি, হে ঈশ্বর, বনের ভেতর যেনো আমাদের সব কিছু ভিজে যায়, যেনো ফিরে আসতে পারি...’। সত্যি সত্যি মেঘ আর বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়ে গেলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুষল ধারে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে পল তার ব্যাগথেকে একটা লুঙ্গি বেড় করে এনে মাথার উপর মেলে ধরলো। তারপরও আমরা ভিজে চুপসে যাচ্ছি। আমি বললাম, এখন কি করে যাবো, সব তো ভিজে শেষ...। সে আমার কোন কথাই কর্ণপাত করল না। বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই আমার আমাকে ভ্যানে উঠালো। তারপর রসুলপুর...
ঢাকায় অনেকদিন পর আসলাম। হোটেল ফার্মগেইটে উঠেছি। তারপর খানিক ফ্রেস হয়ে আবার এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে ঘুড়ছি। আমার ভাইটা আমাকে ইন্টারভিউর জন্য প্রিপারেশন নিতে তাগিদ দিতে লাগলো। আমি বললাম, তোমার ভাইটা কি এতই অকাজের? প্রায় ১১ বছর যে কাজ করছি, প্রশ্নতো সেখান থেকেই হবে। আমার কলিগরাও বলল, তুই কি ইন্টারভিউতে এসেছো না কি বেড়াতে? পল নিশ্চয় বুঝে গেছে, আমি ইন্টারভিউ দিতে চাইছি না। তাই সে জোড় করে হোটেলে ফেরত নিয়ে, খাইয়ে বললো, ‘এবার পড়’। বললাম, ‘আমি টায়ার্ড, পড়তে ইচ্ছে করছে না’।  সে বললো, তাহলে এক কাজ কর, তোমার নোটগুলো আমাকে দে। তুই শুয়ে পড়, আমি তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি...’ এই বলেই সে পড়া শুরু করে দিলো। সে কঠিন কঠিন ইংলিশ পড়ছে, আর এদিকে আমি ভাবছি, ভাইটা আমাকে কতো ভালোবাসে...। আমার ভিষণ ঘুম পাচ্ছিলো, কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, সেই জানে।
পরদিন যথারীতি ঘুমথেকে জাগিয়ে, নাস্তাপানি খাইয়ে তাড়াতারী প্রস্তুত হতে বললো। আমি যেন উল্টাপাল্টা না করি, জিজ্ঞেস করলে ঠিক মত যেন উত্তর দেই এমন আরো কত কি সাজেশন দিয়েই চললো অফিস পর্যন্ত। ইন্টারভিউতে দুই ঘন্টা ধরে শুধু ভাইভা নেওয়া হলো। ইন্টারভিউর পরিবেশ দেখে আমি মনে মনে খুব খুশি। আমার ভাইটাকে বললাম, ‘এত সহজ প্রশ্ন আর আলাপচারিতায় আমার চাকরি হতেই পারে না’। কথাগুলো শুনে আমার এই ভাইটা খুবই হতাশ হলো।
প্রায় মাস খানেক পর যখন রেজাল্ট দিলো। লিষ্টে আমার নাম থাকবে না, এতো আমি জানি। প্রায় সবাই এ নিয়ে লাফালাফি করলেও উদাস। এক সময় আমার এক কলিগ সবার উদ্দেশ্য বললেন, ‘দেখেন সবাই, ফিডেল’দা কি চালাক! মিষ্টি খাওয়ানোর ভয়ে কিচ্ছু বলছে না’। তখনও আমার নির্বাক উত্তর। ‘ধুর মিয়া, বাজে বকবা না...’। আমি যে সত্যি সত্যি দেখি নি তা কেউ বিশ্বাস করলো না। আমি বললাম, ‘যাও মিষ্টি খাইতে চাইলে, লিষ্টের কাগজটা ফটোকপি করে নিয়ে এসো’। কাগজ দেখার পর আমাকেও সবার জন্য মিষ্টি খাওয়াতে হলো। ভাই পলকে জানিয়ে চিঠি লিখলাম। ১৫ দিনের মধ্যে উত্তর এলো, লাল হৃদয়ে ফুলের মালা দিয়ে ঘেরা লেটার প্যাড। তাতে লেখা- ‘বাহে, জানিস, আজ আমার আকাশ বাতাস জুড়ে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। এ তোমার সাফল্য নয়; আমার সাফল্য; হিমালয় চুড়ার চেয়েও। এ আনন্দে আমি আত্মহারা... অনেক ক্ষণ আনন্দে কাঁদলাম...’। আমি চিঠি পড়ছি আর ভাইটার আনন্দ-অশ্রু ঝরা চোখ, মুখ ভেসে উঠছে। কখন গিন্নী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, টের পাই নি। আমার চোখের জল মুছে দিলো। আমার চোখথেকে আঁচল সড়াতেই দেখি, আমার গিন্নির চোখেও টপ টপ  করে ক’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো..

অদৃশ্য ব্যবধান

* অদৃশ্য ব্যবধান *
ফিডেল ডি সাংমা
------------------------------

জীবন-ভেলা ভাসানো তার- স্বপ্ন আর কবিতায়
হৃদ মাঝারে- যার প্রেমের পরশ; রঙ ছবিটায়।
 
সিক্ত কাব্য-ভূবন; ঝর্ণাধারার শব্দে ও ছন্দে,
জীবন বিভোর, স্বপ্ন রঙ্গিন, হাসি ও আনন্দে।
 
আহা- আকাশ মেঘে কাজলা কালো, ঐ অশ্রুমুখী
এখন, পাহাড় পাথর- জনম নিথর; জনম দুঃখী।
 

না, কখনো কবিতা কেউ ছাড়ি নি; সেও না
দুজনে এত কাছাকাছি; তবু কেনো কেউ কাছে না

আমরা কেমন বাবা মা?

আমরা কেমন বাবা মা?
ফিডেল ডি সাংমা
-------------------------
বেশ কিছুদিন ধরে সোনার বাংলাদেশের পরিবেশ থমথমে ভাব। বাংলার গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর, পথ-ঘাট সবই নিথর; নিস্তব্ধ। ফুল ফোঁটা এবং পাখিরাও যেনো সুর, গাইতে ভুলে গেছে। মুছে গেছে লক্ষ-কোটি মানুষের মুখের আনন্দ, হাসি। মানুষের চোখের জল যেনো মেঘ-শিশির হয়ে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা পূরো দেশবাসির জন্য কতখানি মর্মান্তিক কতখানি হৃদয়বিদারক অভাবনীয়। কারণ একটাই-  আমাদের প্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ আজ আমাদের সাথে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর পরিবারে এবং অগণিত ভক্তের হৃদয়ে অসীম শুণ্যতা।

হুমায়ুন আহমেদের অবধানের পর তাঁর ভক্তকুলের আহাজারি এবং লেখা লেখি বহুগুণে বেড়ে গেছে। কত সহস্র লোক কত কী যে লিখলেন, এখনও লিখে চলেছেন সেসব নির্দিষ্ট করে বলা সত্যিই কষ্টকর। তার মধ্যথেকে বেশ ক’দিন ধরে এই লেখকের লেখাথেকে একটা উদৃতি নিয়ে পত্রিকা এবং ফেইসবুকে বেশ হৈ-চৈ, আলোচনা, সমালোচনা চলছে। সবার জ্ঞাতার্থে উদৃতিটা আমি উল্লেখ করতে চাই। ছোট মেয়ে শিলার অতীতে “বাবা তুমি একজন ভালো মানুষ” বলার কাহিনী স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছিলেন, “আমি বললাম, আম্মা! পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই’। ... এখন মনে হয় শিলাও বুঝে গেছে, পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে, যেমন আমি’। (উল্লেখ্য- লেখকের পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন-এর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক চুকে যাওয়ার পরে মেয়ে শিলার বান্ধবী ও অভিনেত্রী শাওনের সাথে বিবাহ হয়। সেসাথে তিন মেয়ে নোভা, শিলা বিপাশা এবং ছেলে- নুহাশের সাথেও দূরত্ব বেড়ে যায়।) লেখক সম্ভবত নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেই উক্তিটা করেছিলেন। উদৃতিটা পড়তে পড়তে আমার ভেতরও প্রশ্ন জাগছে, আমার সন্তানদের কাছে কি ভালো বাবা হতে পেরেছি, কিংবা মা...? কারণ আমার বিশ্বাস, আমরা কেউ খারাপ বাবা-মা হতে চাই না; অনুশোচনা করতে চাই না...

কোন মানব শিশু জন্ম হওয়ার পর সর্ব প্রথম যে দুটি শব্দের সাথে পরিচিত হয়; তা হলো বাবা এবং মা। বাবা এবং মা এই দুটি শব্দ প্রতিটি সন্তানের কাছে শুধু শব্দই নয় ...ওদের পৃথিবী ৷ শব্দ দুটোর সাথে আমরা সবাই এত বেশি পরিচিত যে অন্য কোন শব্দের সাথে তুলনা চলে না। এ শব্দ দ'টোর সাথে আমাদের প্রত্যেকের জীবন নিবিড়ভাবে জড়িত। বাবা মা হওয়া যেমন সৌভাগ্যের; তেমনি সন্তানকে তার চাহিদা অনুসারে স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাদি দিয়ে লালন-পালন করার মহান দায়বদ্ধতাও রয়েছে। যারা এই দায়িত্ব সুন্দর সুশৃংখল ভাবে পালন করেন, তাদেরকেই আমরা বলি আদর্শ বাবা-মা। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘সন্তান জন্ম দিলে জন্মদাতা হওয়া যায় কিন্তু বাবা বা মা হওয়া যায় না’। উক্তিটার পক্ষে বিপক্ষে হাজার হাজার যুক্তি, উদাহারন দেওয়া যায়। কিন্তু আমার মতো নগন্য ব্যাক্তি সে যুদ্ধে যেতে চাই না, পারবোও না।

ইদানিং খবরের কাগজ খুললেই লোমহর্ষক নির্যাতন, গুম, হত্যা ইত্যাদির সব খবর চোখে পড়ে। এর মধ্যে ভ্রুণ হত্যার কথা নাইবা বললাম; পিতা বা মাতা কতৃক সন্তানদের খোঁজ খবর না নেওয়া, নির্যাতন, গুম, হত্যা, বনে-জঙ্গলে বা রাস্তায়-ড্রেনে ফেলে দেওয়া, পতিতা পল্লীতে, দালালদের কাছে বা শহরে- বাসায় বিক্রি করা কিংবা শিশু শ্রমে বাধ্য করার মত অজস্র ঘটনার কাহিনী শুনি। যে কোন সমাজ, রাষ্ট্র, আইন-আদালত কিংবা সুস্থ্য মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ সকলেই বলবেন, এটা অবশ্যই খারাপ, জঘন্যতম একটা কাজ। পক্ষান্তরে সন্তানদের কাছে কি ওই কাজগুলো ভালো হতে পারে...? যারা এই জঘন্যতম কাজগুলো করেন না; তাঁরা অবশ্যই ভালো বাবা এবং মা। কিন্তু যারা করেন? ওই কাজগুলোর কারণে কোন বাবা-মা কি সন্তানদের কাছে বাবা-মা ভালো হতে পারে...? কখনই না। যারা এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে এই সব লোকেরাও কিন্তু তাদের অথবা কারোর না কারোর বাবা এবং মা । আমরা যারা বাবা-মা, আসুন গভীর ভাবে ভেবে দেখি, আমরা কেমন বাবা মা? আজকের যুবক যুবতি কিংবা হবু বাবা মায়েরা আসুন ভেবে দেখি, আমরা কেমন বাবা মা হতে চাই...?