ঘটনা ১.
আগন্তুক একজন আদিবাসী; এলাকায় নতুন। লুঙ্গি কেনা দরকার তাই খুঁজতে খুঁজতে একটা মার্কেটে ঢুকলেন। ক্রেতা কাছে আসতেই বিক্রেতা অভ্যাসবশত ডাকলেন, ‘মামা- কি লাগব? বহ।’ ক্রেতা আগন্তুক অবাক! বিক্রেতার আচরণে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। তবুও আগন্তুক নীরবে সয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। ‘কও মামা, কি দিমু...’ বিক্রেতার কথায় নেন-দেনের কোন বালাই নেই।
বিক্রেতার এমন কথা-বার্তা শুনে ভেতরে ভেতরে আগন্তুক খ্যাঁপে যাচ্ছেন এবং ভাবলেন, নূন্যতম ক্রেতা হিসাবে তার মূল্যায়ণ করা এবং ব্যবহারে ভদ্রতা দেখানো উচিত ছিল- যা যে কোন বিক্রেতার প্রধান শর্ত। তারপরও যথা সম্ভব নিজেকে সম্বরণ করে আগন্তুক বললেন, লাগবেনা...। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিথেকে মুক্তি পাওয়াই এখন বড় কথা।
ঘটনা ২.
একটি দোকানে অনেক্ষণ কথা বলার পর কৌতুহলী হয়ে আগন্তুক প্রশ্ন করলেন - কিছু মনে করবেন না, আপনি কোন ধর্মের লোক?
বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। এখানে সকল ধর্মের লোক নিজ নিজ বিশ্বাস অনুসারে ধর্ম পালন করবে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশকে স্বাধীন করার জন্য একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হল। আশা করি কোন ইসলামপন্থি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যে, দেশ স্বাধীনতায় বাংলাদেশে বসবাসকারী আর অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর কোন অবদান নেই।
দেশ স্বাধীনতার সংগ্রামে এই ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকলেও বাংলাদেশ সংবিধানের ভাষায় এরা উপজাতি, আদিবাসী নয়। জাতিসংঘ ১৯৯৩ খ্রীষ্টাব্দকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনও আদিবাসী বর্ষ পালন করেনি। বাঙ্গালিদের কাছে কারোর চেহারা বা বৈশিষ্ট দেখে কথিত উপজাতিদের চেনা যত না সহজ, তার চেয়ে অনেক কঠিন বাংলা অভিধান পড়ে তার যথপোযোগী কোন অর্থ খুজেঁ পাওয়া বা মর্মার্থ বুঝে নেওয়া। কোন গাছের শাখার অংশকে যদি বলা হয় প্রশাখা বা উপশাখা, নেতার অধীন বা ছোট হবেন উপনেতা। আর জেলার অধীন হয় উপজেলা, মন্ত্রীর অধীন হলে উপমন্ত্রী। তাহলে উপজাতি কোন বৃহত্তর জাতির অংশ বা অধীন...?
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের বিশেষ সভায় যখন ঐ বছরকে ‘আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি বক্তব্যে বলেছিলেন- বাংলাদেশে নাকি আদিবাসী নেই; যারা আছে তারা সংখ্যালঘু, যাযাবর-উপজাতি। মানব জাতির আদি পিতামাতা আদম হাওয়া জান্নাতুল ফেরদৌস বেহেস্ত কিংবা খ্রিষ্টানদের মতে এদেন বাগানথেকে কি বাংলাদেশে বিতাড়িত হয়েছিলেন? তা না হলে তো বাংলাদেশে আদিবাসী কেউ ছিল না। বাইরে বা অন্য জায়গাথেকে এসে থাকলে এদেশের মানুষ সকলেই বহিরাগত; আদিবাসী নয়।
সংখ্যালঘূ এ জাতিদের বাঙ্গালী জাতি যে সমস্ত উপাধিতে আখ্যায়িত করেন, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলা অভিধান কি বলে তা দেখা যাক- উপ শব্দ হচ্ছে একটি অব্যয়। তৎসম উপসর্গ বিশেষ। যার অর্থ দাঁড়ায়- সাদৃশ্য, নৈকট্য, উৎকর্ষ, স্বল্পতা, উদ্যোগ ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে সূচক উপসর্গ যেমন- উপক্রম, উপহার, উপবন।
আর উপজাতি শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে, প্রধান জাতির অন্তর্ভূক্ত ক্ষুদ্র জাতি হিসাবে। আদিবাসী সম্প্রদায়। ইদানিং পাঠ্য বইগুলোতে (সমাজ বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, নৃ-তত্ত্ব) এদের নৃগোষ্ঠী বলেও আখ্যা দেওয়া হয়। বাংলা অভিধানে নৃ অর্থ হচ্ছে- নর, পুরুষ, মনুষ্য। আর গোষ্ঠীর অর্থ পরিবার, জ্ঞাতি, আত্মীয়গণ, বংশ, গোত্র, কূল ইত্যাদি।
এবার আসা যাক সমাজ বিজ্ঞান এবং নৃ-বিজ্ঞান কি বলে। সমাজ বিজ্ঞান এবং নৃ-বিজ্ঞানে এথ্নিক-এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘এথ্নিক সম্প্রদায় বা ট্রাইব বলতে এমন এক সমাজকে বুঝায়, যাদের একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, যারা কোন বৃহৎ সমাজের একটি ক্ষুদ্রাংশ হিসেবে বসবাস করে; যার সদস্যরা একটি স্বতন্ত্র পরিচয় সম্পর্কে সচেতন এবং যাদের মধ্যে একটা ঐক্যের অনুভূতি বিদ্যমান।’
সমাজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম পি স্কট তার গ্রন্থে বলেন,“এথ্নিক সম্প্রদায় এমন এক সম্প্রদায়কে বুঝায় যাদের একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং যারা একটি নিজস্ব পরিচিতিসহ বৃহৎ কোন সমাজের উপগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করে।”
অর্থাৎ এথ্নিক সম্প্রদায় বলতে নিজস্ব পরিচিতি, সাধারণ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট, ও বৃহৎ কোন সমাজের উপগোষ্ঠী হিসেবে ভূমিকা পালনকারী গোষ্ঠীকে বুঝায়।
সমাজ বিজ্ঞানী John. M. Shepard, (জন. এম শেফার্ড) তাঁর Sociology - গ্রন্থে বলেছেন, Race is distinct category of people who share certain biologically inherited physical characteristics. আবার তিনি বলেছেন, Race is a group which is set apart from others because of obvious physical difference. অর্থাৎ ‘নৃগোষ্ঠী বা নরবংশ বলতে এমন একটি নৃগোষ্ঠীকে বুঝায়, যারা দৈহিক পার্থক্যের কারণে অন্যদের থেকে পৃথক।’ বিএ,এএসএস- এর সমাজ তত্ত্ব বই-এ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে,“জাতি হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঐতিহাসিকভাবে সংগঠিত একটি বর্গ।” এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশের তথাকথিত সংখ্যালঘু বা উপজাতিদের সত্যিই কি কোন ইতিহাস নেই? যদি না-ই থাকে তবে বাংলাদেশ বা বিশ্বের সমাজ গবেষকগণ বসে আছেন কেন? সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যিকারের ইতিহাস উদ্ধার করলে তাঁদের ডিগ্রি/সম্মান যেমন বাড়বে; তেমনি উপজাতিরাও জাতিরূপে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
বিভিন্ন দৈহিক বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নৃগোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ করা হয়। দৈহিক বৈশিষ্টগুলো হল- মাথা, মুখাকৃতি, ঠোঁট, নাকের গড়ন, দেহের উচ্চতা, চুলের রং, চামড়ার রং, কান ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা সমগ্র মানবজাতিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- (১) মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠী, (২) নিগ্রোয়েড নৃগোষ্ঠী এবং (৩) ককেশয়েড নৃগোষ্ঠী। উল্লেখ্য যে উপরোক্ত তিনটি নৃগোষ্ঠী ছাড়াও নৃবিজ্ঞানীরা আরও একটি জাতির কথা বলেন আর সেটি হচ্ছে (৪) অষ্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠী।
বাংলাদেশে বাঙ্গালীর পাশাপাশি গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ঢালু, চাকমা, মারমা, খাসিয়া, বম, খুমি, তনচংগা ইত্যাদি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস; যারা মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। নিগ্রোয়েড নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আছে সানতাল, খারিয়া, উরাও ইত্যাদি।
উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রী পর্যায়ের পাঠ্যবই সামাজিক বিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান পরিচিতি এবং নৃতত্ত্ব বইসমূহে লেখা আছে এভাবে, “বাংলাদেশের মানুষের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কারণ এ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তেমন সুস্পষ্ট নয়। এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানের গবেষণায় এমন কোন মানবজীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়নি; যাকে বর্তমান জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ বলা যায়”। অর্থাৎ সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী জাতিও বহিরাগত- আদিবাসী নয়। ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, “এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বহিরাগত জনগোষ্ঠী এসে বসবাস করেছে। তাই বলা যায়, বাঙ্গালীদের ওপর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। যেমন, আদি অষ্ট্রেলীয় প্রভাব, মঙ্গোল-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর প্রভাব, আর্য ভাষাভাষীর প্রভাব, বহিরাগত মুসলমানদের প্রভাব, হিন্দু নৃগোষ্ঠীতে অষ্ট্রেলীয়- দ্রাবিড় প্রভাব, আলপাইন নরগোষ্ঠীর প্রভাব এবং নিগ্রোবটু ও আলপোদিনারিদের প্রভাব ইত্যাদি। সুতরাং সমাজবিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে একমত হয়েছেন যে, বৈচিত্রময় পরিবেশে মেলামেশার ফলে পাঁচমিশালী জাত হলেও বাঙ্গালী জাতি একটা নিজস্ব দেহাকৃতির রূপ নিয়েছে। এরা নানা গোত্রভূক্ত মানবের রক্ত মিশ্রণজাত এবং জনগোষ্ঠী। এসব কারণেই বাঙ্গালী জাতিকে বলা হয় একটি মিশ্র বা সংকর জাতি।” তদুপরি বহু জাতি বা গোষ্ঠীর মিশ্রণে যে জাতির আত্মপ্রকাশ- মিশ্র জাতি অথচ তারাই কিনা উপজাতি না হয়ে একটি পূর্ণ জাতিতে পরিণত হল, যাকে আমরা বলি-‘বাঙ্গালী জাতি’।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়াথেকে উপজেলা সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক প্রকাশনা ‘উদ্ভব’ ম্যাগাজিনে মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন (কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক, কবি) এর লেখা ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক নীলিমা ইব্রাহিমের ‘বঙ্গসংস্কৃতি ’প্রবন্ধ অনুসরণে বলা যায়- গৌড়, হরিকেল, সমতট, চন্দ্রদীপ, বাঙালা, বঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ়, দক্ষিণ-রাঢ়, উত্তর-রাঢ়মন্ডল, তাম্রলিপ্তি ইত্যাদির ইতস্তত: বিপ্তি ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক উপাদানকে জোড়া লাগিয়ে যা পাওয়া যায় তা হল- বাঙালী একটি সঙ্কর জাতি। এদিক থেকে ল্য করলে যা পাওয়া যায় তাতে বুঝা যায় বাঙালী জাতির একান্ত কোন নিজস্বতা নেই। তারপরও এরা জ্ঞানার্জনে খুবই আগ্রহী বলে জানা যায়। তবে এরা খুবই ‘কলহপরায়ণ’...।”
এখন আমার কথা হল যে, বহু নৃগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে সৃষ্ট যে জাতি, তারাই আজ পূর্ণ জাতিররূপে পরিগণিত হচ্ছে, যেমন- বাঙ্গালি জাতি। অথচ মান্দি/গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ঢালু, চাকমা, মারমা, খাসিয়া, বম, তনচংগা- এরা আদিজাতি মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত যাদের গোষ্ঠীতে আজবোধি কোন মিশ্রণ ঘটেনি, তারা কিন্তু পূর্ণ জাতির মর্যাদা পেলো না। অথচ আজ এরাই হল উপজাতি (অর্থাৎ শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় কোন জাতির অংশ বা শাখা, সাদৃশ্য অথবা মিশ্রিত)।
আমি যেহেতু জাতিতে মান্দি বা গারো তাই শুধুমাত্র গারোদের নিয়েই আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি এবং বিভিন্ন তথ্যপঞ্জি, গ্রন্থ ঘাটিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের বসবাস সম্পর্কে যেটুকু পেয়েছি, তার কিছু অংশ আমি এখানে উল্লেখ করছি-
ক) ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত সুভাষ জেংচাম রচিত ‘বাংলাদেশের গারো আদিবাসী’ নামক বইটির ৯ম পৃষ্ঠায় গারোদের জনসংখ্যা সম্পর্কে লিখেছেন- ‘গারোরা ভাষা অনুযায়ী বোডো মঙ্গোলীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বিগত আদম শুমারীসমূহে দেশের আদিবাসীদেরকে আলাদাভাবে গনণা করা হয়নি বা দেখানো হয়নি। তাই বাংলাদেশের খ্রীষ্টিয়ান মিশনারী কিংবা এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থাসমূহের তথ্য ছাড়া গত্যন্তর নেই। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সোয়া লাখের মত গারো রয়েছে।
অপরদিকে ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু সম্পাদিত ২১শে বইমেলা- ২০০৯-এ প্রকাশিত ‘গারো সম্প্রদায়ঃ সমাজ ও সংস্কৃতি’ বই-এর ভূমিকায় লিখেছেন- ‘১৯৯১ সালের আদম শুমারী অনুসারে বাংলাদেশে গারো জনসংখ্যা ৬৮ হাজার ২ শত ১০ জন উল্লেখ করা আছে। আর বেসরকারী হিসাবে গারোদের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার।’
খ) বৃটিশ শাসনামলে শুরুতে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের গারোদেরকে নাটোরের রানী ভবানীর প্রজা হিসাবে চিহ্নিত হতে দেখা যায় এবং সে মর্মে তাদে ভূমিস্বত্বের কাগজপত্রাদিও পাওয়া যায়।(সুভাষ জেংচাম)
গ) সুসং দূর্গাপুর এলাকায় গারোরা সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দির শেষ ভাগ পর্যন্ত অত্যন্ত প্রতাবশালী ছিল। ঐ সময়কালে তারা বিভিন্ন দলনেতার নেতৃত্বে সুসং দূর্গাপুরে রাজত্ব করে। অবশেষে শেষ গারো রাজা বাইস্যা মান্দা তার বিশ্বাসঘাতক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মন্ত্রী সমেশ্বর পাঠকের হাতে ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন।
ঘ) আলী আহাম্মদ খান আইয়োব- গারো সম্প্রদায় প্রবন্ধে লিখেছেন- ৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে চীন পর্যটক হিউয়েন সাঙ কামরূপ ভ্রমণে এসে সাদামাটা প্রকৃতির ছোটখাটো চেহারার ঘন হলুদ ঘেঁসা এক গুয়ে ও বুনো ধরনের প্রখর স্মরণ-শক্তিসম্পন্ন যে মানুষ দেখতে পান বলে তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করেছেন, সেই জনগোষ্ঠীই এ অঞ্চলের গারো সম্প্রদায়ের বলে অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন।
ঙ) ঐতিহাসিক প্রমান পাওয়া যায়, নেত্রকোনার মদনপুরে এবং সুসং দূর্গাপুরে গারোরাজ্য প্রতিষ্ঠার বিবরণে। জানা যায়- নেত্রকোনার মদনপুরে নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গারোদের চিরান পদবীর এক সমৃদ্ধ সামন্ত রাজ্য ছিল, যে রাজ্যে গারো মদন চিরান (মদন গারো) ১০৬০ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম ধর্ম প্রচারক হযরত শাহ সুলতান রুমীর হাতে পরাজয় বরণ করেন এবং রাজ্য ত্যাগে বাধ্য হন।
চ) এ অঞ্চলে আর্যদের প্রবেশের পর গারোদের একাংশ হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে চতুর্থবর্ণ শূদ্রের সৃষ্টি হয়। ফলে গারোদের একাংশ সেই শূদ্র বর্ণে প্রবেশ করে। আবার যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে সেই গারো সমাজের লোকজন ক্ষত্রিয় বর্ণের দাবীদার হয়ে পড়ে। (আলী আহাম্মদ খান আইয়োব- গারো সম্প্রদায়)
ছ) 'হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে নাম আছে গারুদাস। মহা ভারতে বলা আছে গারুদা। এই হচ্ছে গারো বা আচ্ছিক্ মান্দিদের নামের ইতিহাস'। (গারো সম্প্রদায়: সমাজ ও সংস্কৃতি- ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু)
জ) ভগদত্তের কামরূপ রাজত্যকালেই উত্তর ভারতের কুরুক্ষেত্রে কুরু-পান্ডবদের মধ্যে আত্মক্ষয়ী মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই মহাযুদ্ধে রাজা ভগদত্ত তার পরম মিত্র কুরু রাজা দূর্যোধনের পাবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। তার সৈন্যদলে বহু গারো(কিরাত সৈন্য) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিরত্ব সহকারে অংশগ্রহন করে মৃত্যু বরণ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা। পন্ডিতদের মতে উহার সংঘটিত কাল তিন হাজার একশত আত্রিশ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে অর্থাৎ আজথেকে প্রায় পাঁচ হাজার একশত পঞ্চাশ বছর আগে। কাজেই ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের আগমনকালকে আজথেকে আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে ধরে নেওয়া যায়। (ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু)
ঝ) ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু আরও লিখেছেন- গারোদের বিশ্বাস ২৫০০ খ্রষ্টপূর্বাব্দ থেকেই উল্লিখিত (বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও থানা) অঞ্চলসমূহে বসবাস করে আসছে। নৃ-তত্ত্ববিদ Edward Dalton, Robbins Burling প্রমূখ অনুরূপে অভিমত পোষণ করেন।
ঞ) উইকিপিডিয়ায় বলা আছে- "উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। ধারণা করা হয় দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল"। (বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাংলার ইতিহাস - উইকিপিডিয়া)
ট) নৃতাত্ত্বিকদের মতে, গারোরা তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী (সুভাষ জেংচাম- গারোদের সমাজ ও সংস্কৃতি)
একদিন অফিস লাইব্রেরীতে ডঃ মোহাম্মদ হান্নান রচিত ‘হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম’ নামক বইটি দেখে পড়ে দেখার শখ হল। বই-এর ভেতরের বিষয়বস্তুগুলো আমি বেশ উপভোগ করেছি। তাই একটি বিষয় সবার সাথে শেয়ার করতে চাই। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর নাম আমরা কমবেশী শুনেছি। তাঁর সম্পর্কে ‘হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম’ বই-তে লেখা আছে’ যেভাবে লেখা আছে, তার কিছু অংশ হুবহু তুলে ধরছি- ‘‘খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলে গ্রিক-রোমান সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে প্রাচীন বঙ্গ ও ভারতীয় সংস্কৃতি বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়। অনেকে মনে করেন, লোককাহিনীর সেকান্দর বাদশা এই আলেজান্ডার ছাড়া আর কেউ নন। আলেকজান্ডার > ইস্কান্দার > সেকান্দর- এমন একটা বুৎপত্তিকে সমাজবিদরা উড়িয়ে দেন নি।’’ ঠিক এমন সময় আমারও নানী-দাদীর কাছে শোনা কল্পকাহিনীর নায়ক বোঙ্গিপা (গারোদের পূর্বপুরুষ)-এর কথা মনে পড়ে গেল। ঐ বোঙ্গিপা-এর নামেই আমার সোনার বাংলাদেশ নামটা আসলে কেমন হত? “ আলেকজান্ডার > ইস্কান্দার > সেকান্দর” যেমন করে হয়েছে; ঠিক তেমন করে বোঙ্গিপা থেকে ‘বোঙ্গি> বঙ্গ> বঙ্গাল> বাঙ্গালা> বাংলা> বাংলাদেশ। হতেও তো পারে ! হাস্যকর মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, ইতিহাস, প্রবন্ধ পড়ে অনেকেরই বিস্বাদ, ক্লান্তি লাগে, তাই একটু ফান করলাম। তবে আরও একটু হাসার সুযোগ করে দিচ্ছি...
উপমহাদেশের ইতিহাস বলে, সিন্ধু সভ্যতা মিসরীয়, ব্যাবিলনীয় এবং আসিরীয় সভ্যতার সমসাময়ীককালের খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে সিন্ধু নদের তীরে এ সভ্যতা গড়ে উঠে। পাকিস্তানের লারকানা জেলায় অবস্থীত মহেঞ্জোদারো এবং মন্টোগোমারি জেলার হরপ্পা অঞ্চলসমুহ নিয়ে এ সভ্যতা গড়ে উঠে ছিল। মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা প্রমূখের নামানুসারে অঞ্চলসমূহের নামাকরণ হয়েছে। (হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম)।
অপরদিকে গারোদের ইতিহাস বলে, গারোদের পূর্বপুরুষ জাপ্পা, বোঙ্গিপা, জালিন্পা, সুখ্পা, আসানপা প্রমুখের পথ নির্দেশনা ও পরিচালনায় গারোরা এ উপমহাদেশে এসেছে। উপমহাদেশের ইতিহাসের হরপ্পা আর গারো ইতিহাসের জাপ্পা, জালিন্পা, বোঙ্গিপা প্রমূখ একসাথে এসেছেলেন কি না বা তারা জ্ঞাতি কি না তা দেখার তো কেউ নেই। গারোদের টাইটেল দারু/ দারোর সাথে উপমহাদেশের ইতিহাসের মহেঞ্জোদারোর কোন সম্পর্ক আছে কিনা তাই বা দেখবে কে? কারণ হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে কোন গারোর নাম মহেন বা মহেন্দ্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়, হয়েছিলও তাই। এখনও অনেক মহেন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্র, পরেশ চন্দ্র, সীতা, গীতা, অঞ্জলী ইত্যাদি নাম আছে। শেঠ বংশের কোন গন্যমান্য ব্যক্তিকে সম্মান করে যেমন শেঠজি, অথবা স্বামী বিবেকানন্দকে স্বামীজি ডাকা হয়। সে ভাবে মহেন্দ্র দারু থেকে মহেনজি এবং মহেনজি দারো থেকে মহেঞ্জোদারো। অর্থাৎ মহেন দারু> মহেনজি> মহেনজি দারো> মহেঞ্জোদারো; হতেও তো পারে। এখন কথা হচ্ছে- সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্যবশত উপমহাদেশের ইতিহাসখ্যাত হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর সাথে গারোদের সম্পর্ক থাকলেও এর কোন তথ্য প্রমাণ নেই। কিংবা তথ্য প্রমাণ থাকুক বা না থাকুক, এদেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বলেই আমাকে আজীবন ‘উপজাতি’ আখ্যাটি কাঁধে বয়ে বেড়াতে হবে; তা বলাই বাহুল্য।
একটা জাতি এলাকায় কত শত বছর বসবাস করলে আদিবাসী হবে- এ কথা কেউ কোথাও বলেননি বা লিখেননি। বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত যে কাউকেই উপজাতি বললে তাদের কেউই খুশি হন না; তা হয়ত সবাই জানেন। উপরোক্ত ক থেকে ঝ নং আলোচনায় উল্লেখিত ঐতিহাসিকদের গবেষণা অনুযায়ী গারোরা এ উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে খ্রীষ্টের জন্মের ২৫০০ বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ বছর যাবত বাস করে আসছে। কত বছর আদিথেকে বাস করলে আদিবাসী হওয়া যায়; গারো কিংবা বিভিন্ন কারণে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া লোকেরা তা জানে না। জাতির আবার 'উপ' হয় কি করে? জাতির কোন 'উপ' হতে পারে না। ভিন্ন জাতি হতে পারে কিন্তু উপজাতি নয়। আদিবাসীদের মনে এমনই ধারণা।
অন্যদিকে বাঙ্গালিরা বলেন, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বলেই নাকি এদের উপজাতি বলা হয়। আর যদি তা-ই হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক স্ববাসী বা প্রবাসি সুশিক্ষিত, খ্যাতিমান ব্যক্তি বিদেশে গিয়ে জাতিতে বাঙ্গালী নয় এমন জাতি এবং ভিন্ন ধর্মের ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে করেছেন, আজ উনারা যদি বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন, তাদের সন্তান সন্ততি হলে- তারা কোন জাতিতে আখ্যায়িত হবেন, উপজাতি কি? অথবা আমেরিকান কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি, মিনিস্টার কিংবা প্রেসিডেন্টের পুত্র বা কন্যা এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে তাদের বাঙ্গালী বলা যাবে কি? আমার অনুমান, তারপরও তাদের উপজাতি বলা যাবে না।
তবে যে যাই ভাবুন এক কথায় বা বিশ্বাসে সকলকেই ফিরে আসতে হবে তা হচ্ছে ‘আশরাফুল মাখ্লুকাত’। বিশ্বের জনসংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা খ্রীষ্টান এবং ইসলাম ধর্মানুসারীগণ বিশ্বাস করেন তাদের আদি পিতা মাতা আদম ও হাওয়া। অর্থাৎ ধর্মের দিক দিয়ে একই মায়ের সন্তান। অর্থাৎ একই মায়ের সন্তান হয়ে একভাই জাতি আরেক ভাই উপজাতি হয় কি করে, আমি বুঝি না। পবিত্র বাইবেল এবং কোরআন যেমন পবিত্র এবং সত্য, তেমনি তার বাণীর সার্থকতা আর পূর্ণতা আসুক- সকলের একতা আর ভালবাসায়, এটাই আমার কামনা। আসুন আমরা সবাই সমস্বরে বলি, ‘ আশরাফুল মাখ্লুকাত।’
সহায়ক গ্রন্থসমূহ-
# বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাংলার ইতিহাস - উইকিপিডিয়া
# দ্য গারো’স- মেজর এ. প্লেফেয়ার ( ভারত)।
# দ্য স্ট্রং ওমেন অব মধুপুর- ডঃ রবিনস্ বার্লিন।
# বাংলাদেশের গারো আদিবাসী- সুভাষ জেংচাম।
# গারো সম্প্রদায়: সমাজ ও সংস্কৃতি- ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু।
# হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম- ডঃ মোহাম্মদ হান্নান।
# সমকালীন বাংলাদেশ: সমাজ ও সংস্কৃতি- ড: নাসিম আখতার হোসাইন
# বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী- সঞ্জিব দ্রং।
# ধর্ম ও সংস্কৃতি- মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন।
আগন্তুক একজন আদিবাসী; এলাকায় নতুন। লুঙ্গি কেনা দরকার তাই খুঁজতে খুঁজতে একটা মার্কেটে ঢুকলেন। ক্রেতা কাছে আসতেই বিক্রেতা অভ্যাসবশত ডাকলেন, ‘মামা- কি লাগব? বহ।’ ক্রেতা আগন্তুক অবাক! বিক্রেতার আচরণে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। তবুও আগন্তুক নীরবে সয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। ‘কও মামা, কি দিমু...’ বিক্রেতার কথায় নেন-দেনের কোন বালাই নেই।
বিক্রেতার এমন কথা-বার্তা শুনে ভেতরে ভেতরে আগন্তুক খ্যাঁপে যাচ্ছেন এবং ভাবলেন, নূন্যতম ক্রেতা হিসাবে তার মূল্যায়ণ করা এবং ব্যবহারে ভদ্রতা দেখানো উচিত ছিল- যা যে কোন বিক্রেতার প্রধান শর্ত। তারপরও যথা সম্ভব নিজেকে সম্বরণ করে আগন্তুক বললেন, লাগবেনা...। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিথেকে মুক্তি পাওয়াই এখন বড় কথা।
- তুমি কি রাঙ্গামাইট্টা? তাচ্ছ্বিল্য ভাবটা আরও পরিষ্কার হল
- না। আগন্তুক চরম অপমানবোধ করছেন। ধৈর্যের সীমা যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
- মামা কি দিমু?
- না কিছু লাগবেনা
ঘটনা ২.
একটি দোকানে অনেক্ষণ কথা বলার পর কৌতুহলী হয়ে আগন্তুক প্রশ্ন করলেন - কিছু মনে করবেন না, আপনি কোন ধর্মের লোক?
- কেন, কি হয়েছে? আমি মুসলমান
- না মানে, এলাকায় অনেক ধরণের লোক আছে তো... আপনাকে চেহারায় আমাদের মতই লাগছে...
- এতে দোকানী চরম অপমানবোধ করলেন এবং খ্যাঁপেই গেলেন। মহা বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বললেন, যাকে তাকে এভাবে বলবেন না। এটা ঠিক না।
- আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। তবে আপনার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে অন্য জাতি বা ধর্মের লোকজনদের মানুষ মনে করেন না।
বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। এখানে সকল ধর্মের লোক নিজ নিজ বিশ্বাস অনুসারে ধর্ম পালন করবে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশকে স্বাধীন করার জন্য একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হল। আশা করি কোন ইসলামপন্থি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যে, দেশ স্বাধীনতায় বাংলাদেশে বসবাসকারী আর অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর কোন অবদান নেই।
দেশ স্বাধীনতার সংগ্রামে এই ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকলেও বাংলাদেশ সংবিধানের ভাষায় এরা উপজাতি, আদিবাসী নয়। জাতিসংঘ ১৯৯৩ খ্রীষ্টাব্দকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনও আদিবাসী বর্ষ পালন করেনি। বাঙ্গালিদের কাছে কারোর চেহারা বা বৈশিষ্ট দেখে কথিত উপজাতিদের চেনা যত না সহজ, তার চেয়ে অনেক কঠিন বাংলা অভিধান পড়ে তার যথপোযোগী কোন অর্থ খুজেঁ পাওয়া বা মর্মার্থ বুঝে নেওয়া। কোন গাছের শাখার অংশকে যদি বলা হয় প্রশাখা বা উপশাখা, নেতার অধীন বা ছোট হবেন উপনেতা। আর জেলার অধীন হয় উপজেলা, মন্ত্রীর অধীন হলে উপমন্ত্রী। তাহলে উপজাতি কোন বৃহত্তর জাতির অংশ বা অধীন...?
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের বিশেষ সভায় যখন ঐ বছরকে ‘আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি বক্তব্যে বলেছিলেন- বাংলাদেশে নাকি আদিবাসী নেই; যারা আছে তারা সংখ্যালঘু, যাযাবর-উপজাতি। মানব জাতির আদি পিতামাতা আদম হাওয়া জান্নাতুল ফেরদৌস বেহেস্ত কিংবা খ্রিষ্টানদের মতে এদেন বাগানথেকে কি বাংলাদেশে বিতাড়িত হয়েছিলেন? তা না হলে তো বাংলাদেশে আদিবাসী কেউ ছিল না। বাইরে বা অন্য জায়গাথেকে এসে থাকলে এদেশের মানুষ সকলেই বহিরাগত; আদিবাসী নয়।
সংখ্যালঘূ এ জাতিদের বাঙ্গালী জাতি যে সমস্ত উপাধিতে আখ্যায়িত করেন, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলা অভিধান কি বলে তা দেখা যাক- উপ শব্দ হচ্ছে একটি অব্যয়। তৎসম উপসর্গ বিশেষ। যার অর্থ দাঁড়ায়- সাদৃশ্য, নৈকট্য, উৎকর্ষ, স্বল্পতা, উদ্যোগ ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে সূচক উপসর্গ যেমন- উপক্রম, উপহার, উপবন।
আর উপজাতি শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে, প্রধান জাতির অন্তর্ভূক্ত ক্ষুদ্র জাতি হিসাবে। আদিবাসী সম্প্রদায়। ইদানিং পাঠ্য বইগুলোতে (সমাজ বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, নৃ-তত্ত্ব) এদের নৃগোষ্ঠী বলেও আখ্যা দেওয়া হয়। বাংলা অভিধানে নৃ অর্থ হচ্ছে- নর, পুরুষ, মনুষ্য। আর গোষ্ঠীর অর্থ পরিবার, জ্ঞাতি, আত্মীয়গণ, বংশ, গোত্র, কূল ইত্যাদি।
এবার আসা যাক সমাজ বিজ্ঞান এবং নৃ-বিজ্ঞান কি বলে। সমাজ বিজ্ঞান এবং নৃ-বিজ্ঞানে এথ্নিক-এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘এথ্নিক সম্প্রদায় বা ট্রাইব বলতে এমন এক সমাজকে বুঝায়, যাদের একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, যারা কোন বৃহৎ সমাজের একটি ক্ষুদ্রাংশ হিসেবে বসবাস করে; যার সদস্যরা একটি স্বতন্ত্র পরিচয় সম্পর্কে সচেতন এবং যাদের মধ্যে একটা ঐক্যের অনুভূতি বিদ্যমান।’
সমাজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম পি স্কট তার গ্রন্থে বলেন,“এথ্নিক সম্প্রদায় এমন এক সম্প্রদায়কে বুঝায় যাদের একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং যারা একটি নিজস্ব পরিচিতিসহ বৃহৎ কোন সমাজের উপগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করে।”
অর্থাৎ এথ্নিক সম্প্রদায় বলতে নিজস্ব পরিচিতি, সাধারণ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট, ও বৃহৎ কোন সমাজের উপগোষ্ঠী হিসেবে ভূমিকা পালনকারী গোষ্ঠীকে বুঝায়।
সমাজ বিজ্ঞানী John. M. Shepard, (জন. এম শেফার্ড) তাঁর Sociology - গ্রন্থে বলেছেন, Race is distinct category of people who share certain biologically inherited physical characteristics. আবার তিনি বলেছেন, Race is a group which is set apart from others because of obvious physical difference. অর্থাৎ ‘নৃগোষ্ঠী বা নরবংশ বলতে এমন একটি নৃগোষ্ঠীকে বুঝায়, যারা দৈহিক পার্থক্যের কারণে অন্যদের থেকে পৃথক।’ বিএ,এএসএস- এর সমাজ তত্ত্ব বই-এ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে,“জাতি হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঐতিহাসিকভাবে সংগঠিত একটি বর্গ।” এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশের তথাকথিত সংখ্যালঘু বা উপজাতিদের সত্যিই কি কোন ইতিহাস নেই? যদি না-ই থাকে তবে বাংলাদেশ বা বিশ্বের সমাজ গবেষকগণ বসে আছেন কেন? সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যিকারের ইতিহাস উদ্ধার করলে তাঁদের ডিগ্রি/সম্মান যেমন বাড়বে; তেমনি উপজাতিরাও জাতিরূপে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
বিভিন্ন দৈহিক বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নৃগোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ করা হয়। দৈহিক বৈশিষ্টগুলো হল- মাথা, মুখাকৃতি, ঠোঁট, নাকের গড়ন, দেহের উচ্চতা, চুলের রং, চামড়ার রং, কান ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা সমগ্র মানবজাতিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- (১) মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠী, (২) নিগ্রোয়েড নৃগোষ্ঠী এবং (৩) ককেশয়েড নৃগোষ্ঠী। উল্লেখ্য যে উপরোক্ত তিনটি নৃগোষ্ঠী ছাড়াও নৃবিজ্ঞানীরা আরও একটি জাতির কথা বলেন আর সেটি হচ্ছে (৪) অষ্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠী।
বাংলাদেশে বাঙ্গালীর পাশাপাশি গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ঢালু, চাকমা, মারমা, খাসিয়া, বম, খুমি, তনচংগা ইত্যাদি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস; যারা মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। নিগ্রোয়েড নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আছে সানতাল, খারিয়া, উরাও ইত্যাদি।
উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রী পর্যায়ের পাঠ্যবই সামাজিক বিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান পরিচিতি এবং নৃতত্ত্ব বইসমূহে লেখা আছে এভাবে, “বাংলাদেশের মানুষের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কারণ এ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তেমন সুস্পষ্ট নয়। এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানের গবেষণায় এমন কোন মানবজীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়নি; যাকে বর্তমান জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ বলা যায়”। অর্থাৎ সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী জাতিও বহিরাগত- আদিবাসী নয়। ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, “এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বহিরাগত জনগোষ্ঠী এসে বসবাস করেছে। তাই বলা যায়, বাঙ্গালীদের ওপর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। যেমন, আদি অষ্ট্রেলীয় প্রভাব, মঙ্গোল-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর প্রভাব, আর্য ভাষাভাষীর প্রভাব, বহিরাগত মুসলমানদের প্রভাব, হিন্দু নৃগোষ্ঠীতে অষ্ট্রেলীয়- দ্রাবিড় প্রভাব, আলপাইন নরগোষ্ঠীর প্রভাব এবং নিগ্রোবটু ও আলপোদিনারিদের প্রভাব ইত্যাদি। সুতরাং সমাজবিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে একমত হয়েছেন যে, বৈচিত্রময় পরিবেশে মেলামেশার ফলে পাঁচমিশালী জাত হলেও বাঙ্গালী জাতি একটা নিজস্ব দেহাকৃতির রূপ নিয়েছে। এরা নানা গোত্রভূক্ত মানবের রক্ত মিশ্রণজাত এবং জনগোষ্ঠী। এসব কারণেই বাঙ্গালী জাতিকে বলা হয় একটি মিশ্র বা সংকর জাতি।” তদুপরি বহু জাতি বা গোষ্ঠীর মিশ্রণে যে জাতির আত্মপ্রকাশ- মিশ্র জাতি অথচ তারাই কিনা উপজাতি না হয়ে একটি পূর্ণ জাতিতে পরিণত হল, যাকে আমরা বলি-‘বাঙ্গালী জাতি’।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়াথেকে উপজেলা সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক প্রকাশনা ‘উদ্ভব’ ম্যাগাজিনে মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন (কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক, কবি) এর লেখা ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক নীলিমা ইব্রাহিমের ‘বঙ্গসংস্কৃতি ’প্রবন্ধ অনুসরণে বলা যায়- গৌড়, হরিকেল, সমতট, চন্দ্রদীপ, বাঙালা, বঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ়, দক্ষিণ-রাঢ়, উত্তর-রাঢ়মন্ডল, তাম্রলিপ্তি ইত্যাদির ইতস্তত: বিপ্তি ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক উপাদানকে জোড়া লাগিয়ে যা পাওয়া যায় তা হল- বাঙালী একটি সঙ্কর জাতি। এদিক থেকে ল্য করলে যা পাওয়া যায় তাতে বুঝা যায় বাঙালী জাতির একান্ত কোন নিজস্বতা নেই। তারপরও এরা জ্ঞানার্জনে খুবই আগ্রহী বলে জানা যায়। তবে এরা খুবই ‘কলহপরায়ণ’...।”
এখন আমার কথা হল যে, বহু নৃগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে সৃষ্ট যে জাতি, তারাই আজ পূর্ণ জাতিররূপে পরিগণিত হচ্ছে, যেমন- বাঙ্গালি জাতি। অথচ মান্দি/গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ঢালু, চাকমা, মারমা, খাসিয়া, বম, তনচংগা- এরা আদিজাতি মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত যাদের গোষ্ঠীতে আজবোধি কোন মিশ্রণ ঘটেনি, তারা কিন্তু পূর্ণ জাতির মর্যাদা পেলো না। অথচ আজ এরাই হল উপজাতি (অর্থাৎ শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় কোন জাতির অংশ বা শাখা, সাদৃশ্য অথবা মিশ্রিত)।
আমি যেহেতু জাতিতে মান্দি বা গারো তাই শুধুমাত্র গারোদের নিয়েই আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি এবং বিভিন্ন তথ্যপঞ্জি, গ্রন্থ ঘাটিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের বসবাস সম্পর্কে যেটুকু পেয়েছি, তার কিছু অংশ আমি এখানে উল্লেখ করছি-
ক) ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত সুভাষ জেংচাম রচিত ‘বাংলাদেশের গারো আদিবাসী’ নামক বইটির ৯ম পৃষ্ঠায় গারোদের জনসংখ্যা সম্পর্কে লিখেছেন- ‘গারোরা ভাষা অনুযায়ী বোডো মঙ্গোলীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বিগত আদম শুমারীসমূহে দেশের আদিবাসীদেরকে আলাদাভাবে গনণা করা হয়নি বা দেখানো হয়নি। তাই বাংলাদেশের খ্রীষ্টিয়ান মিশনারী কিংবা এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থাসমূহের তথ্য ছাড়া গত্যন্তর নেই। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সোয়া লাখের মত গারো রয়েছে।
অপরদিকে ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু সম্পাদিত ২১শে বইমেলা- ২০০৯-এ প্রকাশিত ‘গারো সম্প্রদায়ঃ সমাজ ও সংস্কৃতি’ বই-এর ভূমিকায় লিখেছেন- ‘১৯৯১ সালের আদম শুমারী অনুসারে বাংলাদেশে গারো জনসংখ্যা ৬৮ হাজার ২ শত ১০ জন উল্লেখ করা আছে। আর বেসরকারী হিসাবে গারোদের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার।’
খ) বৃটিশ শাসনামলে শুরুতে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের গারোদেরকে নাটোরের রানী ভবানীর প্রজা হিসাবে চিহ্নিত হতে দেখা যায় এবং সে মর্মে তাদে ভূমিস্বত্বের কাগজপত্রাদিও পাওয়া যায়।(সুভাষ জেংচাম)
গ) সুসং দূর্গাপুর এলাকায় গারোরা সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দির শেষ ভাগ পর্যন্ত অত্যন্ত প্রতাবশালী ছিল। ঐ সময়কালে তারা বিভিন্ন দলনেতার নেতৃত্বে সুসং দূর্গাপুরে রাজত্ব করে। অবশেষে শেষ গারো রাজা বাইস্যা মান্দা তার বিশ্বাসঘাতক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মন্ত্রী সমেশ্বর পাঠকের হাতে ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন।
ঘ) আলী আহাম্মদ খান আইয়োব- গারো সম্প্রদায় প্রবন্ধে লিখেছেন- ৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে চীন পর্যটক হিউয়েন সাঙ কামরূপ ভ্রমণে এসে সাদামাটা প্রকৃতির ছোটখাটো চেহারার ঘন হলুদ ঘেঁসা এক গুয়ে ও বুনো ধরনের প্রখর স্মরণ-শক্তিসম্পন্ন যে মানুষ দেখতে পান বলে তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করেছেন, সেই জনগোষ্ঠীই এ অঞ্চলের গারো সম্প্রদায়ের বলে অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন।
ঙ) ঐতিহাসিক প্রমান পাওয়া যায়, নেত্রকোনার মদনপুরে এবং সুসং দূর্গাপুরে গারোরাজ্য প্রতিষ্ঠার বিবরণে। জানা যায়- নেত্রকোনার মদনপুরে নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গারোদের চিরান পদবীর এক সমৃদ্ধ সামন্ত রাজ্য ছিল, যে রাজ্যে গারো মদন চিরান (মদন গারো) ১০৬০ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম ধর্ম প্রচারক হযরত শাহ সুলতান রুমীর হাতে পরাজয় বরণ করেন এবং রাজ্য ত্যাগে বাধ্য হন।
চ) এ অঞ্চলে আর্যদের প্রবেশের পর গারোদের একাংশ হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে চতুর্থবর্ণ শূদ্রের সৃষ্টি হয়। ফলে গারোদের একাংশ সেই শূদ্র বর্ণে প্রবেশ করে। আবার যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে সেই গারো সমাজের লোকজন ক্ষত্রিয় বর্ণের দাবীদার হয়ে পড়ে। (আলী আহাম্মদ খান আইয়োব- গারো সম্প্রদায়)
ছ) 'হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে নাম আছে গারুদাস। মহা ভারতে বলা আছে গারুদা। এই হচ্ছে গারো বা আচ্ছিক্ মান্দিদের নামের ইতিহাস'। (গারো সম্প্রদায়: সমাজ ও সংস্কৃতি- ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু)
জ) ভগদত্তের কামরূপ রাজত্যকালেই উত্তর ভারতের কুরুক্ষেত্রে কুরু-পান্ডবদের মধ্যে আত্মক্ষয়ী মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই মহাযুদ্ধে রাজা ভগদত্ত তার পরম মিত্র কুরু রাজা দূর্যোধনের পাবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। তার সৈন্যদলে বহু গারো(কিরাত সৈন্য) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিরত্ব সহকারে অংশগ্রহন করে মৃত্যু বরণ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা। পন্ডিতদের মতে উহার সংঘটিত কাল তিন হাজার একশত আত্রিশ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে অর্থাৎ আজথেকে প্রায় পাঁচ হাজার একশত পঞ্চাশ বছর আগে। কাজেই ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের আগমনকালকে আজথেকে আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে ধরে নেওয়া যায়। (ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু)
ঝ) ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু আরও লিখেছেন- গারোদের বিশ্বাস ২৫০০ খ্রষ্টপূর্বাব্দ থেকেই উল্লিখিত (বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও থানা) অঞ্চলসমূহে বসবাস করে আসছে। নৃ-তত্ত্ববিদ Edward Dalton, Robbins Burling প্রমূখ অনুরূপে অভিমত পোষণ করেন।
ঞ) উইকিপিডিয়ায় বলা আছে- "উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। ধারণা করা হয় দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল"। (বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাংলার ইতিহাস - উইকিপিডিয়া)
ট) নৃতাত্ত্বিকদের মতে, গারোরা তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী (সুভাষ জেংচাম- গারোদের সমাজ ও সংস্কৃতি)
একদিন অফিস লাইব্রেরীতে ডঃ মোহাম্মদ হান্নান রচিত ‘হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম’ নামক বইটি দেখে পড়ে দেখার শখ হল। বই-এর ভেতরের বিষয়বস্তুগুলো আমি বেশ উপভোগ করেছি। তাই একটি বিষয় সবার সাথে শেয়ার করতে চাই। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর নাম আমরা কমবেশী শুনেছি। তাঁর সম্পর্কে ‘হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম’ বই-তে লেখা আছে’ যেভাবে লেখা আছে, তার কিছু অংশ হুবহু তুলে ধরছি- ‘‘খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলে গ্রিক-রোমান সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে প্রাচীন বঙ্গ ও ভারতীয় সংস্কৃতি বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়। অনেকে মনে করেন, লোককাহিনীর সেকান্দর বাদশা এই আলেজান্ডার ছাড়া আর কেউ নন। আলেকজান্ডার > ইস্কান্দার > সেকান্দর- এমন একটা বুৎপত্তিকে সমাজবিদরা উড়িয়ে দেন নি।’’ ঠিক এমন সময় আমারও নানী-দাদীর কাছে শোনা কল্পকাহিনীর নায়ক বোঙ্গিপা (গারোদের পূর্বপুরুষ)-এর কথা মনে পড়ে গেল। ঐ বোঙ্গিপা-এর নামেই আমার সোনার বাংলাদেশ নামটা আসলে কেমন হত? “ আলেকজান্ডার > ইস্কান্দার > সেকান্দর” যেমন করে হয়েছে; ঠিক তেমন করে বোঙ্গিপা থেকে ‘বোঙ্গি> বঙ্গ> বঙ্গাল> বাঙ্গালা> বাংলা> বাংলাদেশ। হতেও তো পারে ! হাস্যকর মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, ইতিহাস, প্রবন্ধ পড়ে অনেকেরই বিস্বাদ, ক্লান্তি লাগে, তাই একটু ফান করলাম। তবে আরও একটু হাসার সুযোগ করে দিচ্ছি...
উপমহাদেশের ইতিহাস বলে, সিন্ধু সভ্যতা মিসরীয়, ব্যাবিলনীয় এবং আসিরীয় সভ্যতার সমসাময়ীককালের খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে সিন্ধু নদের তীরে এ সভ্যতা গড়ে উঠে। পাকিস্তানের লারকানা জেলায় অবস্থীত মহেঞ্জোদারো এবং মন্টোগোমারি জেলার হরপ্পা অঞ্চলসমুহ নিয়ে এ সভ্যতা গড়ে উঠে ছিল। মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা প্রমূখের নামানুসারে অঞ্চলসমূহের নামাকরণ হয়েছে। (হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম)।
অপরদিকে গারোদের ইতিহাস বলে, গারোদের পূর্বপুরুষ জাপ্পা, বোঙ্গিপা, জালিন্পা, সুখ্পা, আসানপা প্রমুখের পথ নির্দেশনা ও পরিচালনায় গারোরা এ উপমহাদেশে এসেছে। উপমহাদেশের ইতিহাসের হরপ্পা আর গারো ইতিহাসের জাপ্পা, জালিন্পা, বোঙ্গিপা প্রমূখ একসাথে এসেছেলেন কি না বা তারা জ্ঞাতি কি না তা দেখার তো কেউ নেই। গারোদের টাইটেল দারু/ দারোর সাথে উপমহাদেশের ইতিহাসের মহেঞ্জোদারোর কোন সম্পর্ক আছে কিনা তাই বা দেখবে কে? কারণ হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে কোন গারোর নাম মহেন বা মহেন্দ্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়, হয়েছিলও তাই। এখনও অনেক মহেন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্র, পরেশ চন্দ্র, সীতা, গীতা, অঞ্জলী ইত্যাদি নাম আছে। শেঠ বংশের কোন গন্যমান্য ব্যক্তিকে সম্মান করে যেমন শেঠজি, অথবা স্বামী বিবেকানন্দকে স্বামীজি ডাকা হয়। সে ভাবে মহেন্দ্র দারু থেকে মহেনজি এবং মহেনজি দারো থেকে মহেঞ্জোদারো। অর্থাৎ মহেন দারু> মহেনজি> মহেনজি দারো> মহেঞ্জোদারো; হতেও তো পারে। এখন কথা হচ্ছে- সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্যবশত উপমহাদেশের ইতিহাসখ্যাত হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর সাথে গারোদের সম্পর্ক থাকলেও এর কোন তথ্য প্রমাণ নেই। কিংবা তথ্য প্রমাণ থাকুক বা না থাকুক, এদেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বলেই আমাকে আজীবন ‘উপজাতি’ আখ্যাটি কাঁধে বয়ে বেড়াতে হবে; তা বলাই বাহুল্য।
একটা জাতি এলাকায় কত শত বছর বসবাস করলে আদিবাসী হবে- এ কথা কেউ কোথাও বলেননি বা লিখেননি। বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত যে কাউকেই উপজাতি বললে তাদের কেউই খুশি হন না; তা হয়ত সবাই জানেন। উপরোক্ত ক থেকে ঝ নং আলোচনায় উল্লেখিত ঐতিহাসিকদের গবেষণা অনুযায়ী গারোরা এ উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে খ্রীষ্টের জন্মের ২৫০০ বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ বছর যাবত বাস করে আসছে। কত বছর আদিথেকে বাস করলে আদিবাসী হওয়া যায়; গারো কিংবা বিভিন্ন কারণে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া লোকেরা তা জানে না। জাতির আবার 'উপ' হয় কি করে? জাতির কোন 'উপ' হতে পারে না। ভিন্ন জাতি হতে পারে কিন্তু উপজাতি নয়। আদিবাসীদের মনে এমনই ধারণা।
অন্যদিকে বাঙ্গালিরা বলেন, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বলেই নাকি এদের উপজাতি বলা হয়। আর যদি তা-ই হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক স্ববাসী বা প্রবাসি সুশিক্ষিত, খ্যাতিমান ব্যক্তি বিদেশে গিয়ে জাতিতে বাঙ্গালী নয় এমন জাতি এবং ভিন্ন ধর্মের ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে করেছেন, আজ উনারা যদি বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন, তাদের সন্তান সন্ততি হলে- তারা কোন জাতিতে আখ্যায়িত হবেন, উপজাতি কি? অথবা আমেরিকান কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি, মিনিস্টার কিংবা প্রেসিডেন্টের পুত্র বা কন্যা এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে তাদের বাঙ্গালী বলা যাবে কি? আমার অনুমান, তারপরও তাদের উপজাতি বলা যাবে না।
তবে যে যাই ভাবুন এক কথায় বা বিশ্বাসে সকলকেই ফিরে আসতে হবে তা হচ্ছে ‘আশরাফুল মাখ্লুকাত’। বিশ্বের জনসংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা খ্রীষ্টান এবং ইসলাম ধর্মানুসারীগণ বিশ্বাস করেন তাদের আদি পিতা মাতা আদম ও হাওয়া। অর্থাৎ ধর্মের দিক দিয়ে একই মায়ের সন্তান। অর্থাৎ একই মায়ের সন্তান হয়ে একভাই জাতি আরেক ভাই উপজাতি হয় কি করে, আমি বুঝি না। পবিত্র বাইবেল এবং কোরআন যেমন পবিত্র এবং সত্য, তেমনি তার বাণীর সার্থকতা আর পূর্ণতা আসুক- সকলের একতা আর ভালবাসায়, এটাই আমার কামনা। আসুন আমরা সবাই সমস্বরে বলি, ‘ আশরাফুল মাখ্লুকাত।’
সহায়ক গ্রন্থসমূহ-
# বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাংলার ইতিহাস - উইকিপিডিয়া
# দ্য গারো’স- মেজর এ. প্লেফেয়ার ( ভারত)।
# দ্য স্ট্রং ওমেন অব মধুপুর- ডঃ রবিনস্ বার্লিন।
# বাংলাদেশের গারো আদিবাসী- সুভাষ জেংচাম।
# গারো সম্প্রদায়: সমাজ ও সংস্কৃতি- ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু।
# হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের অ্যালবাম- ডঃ মোহাম্মদ হান্নান।
# সমকালীন বাংলাদেশ: সমাজ ও সংস্কৃতি- ড: নাসিম আখতার হোসাইন
# বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী- সঞ্জিব দ্রং।
# ধর্ম ও সংস্কৃতি- মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন