শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

আমার নানান রঙের দিনগুলি

আমার নানান রঙের দিনগুলি 
ফিডেল ডি সাংমা


আমি জন্মগতভাবে জলছত্র গ্রামের (মধুপুর, টাঙ্গাইল)। কিন্তু আমার শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলো কেটেছে সাইনামারী গ্রামে। আর বাকী দিনগুলো কেটেছে বয়জ হোষ্টল নামক বন্দিশালায়। আমি যখন ক্লাশ টুতে পড়ি, তখন বাবা পরিবারসহ চলে আসেন তাঁর বাবার বাড়ি সাইনামারী গ্রামে। পরিবারের বড় নাতির মহাআদর পেয়ে আমি রয়ে গেলাম আমার নানীর কাছে। ক্লাশ থ্রী পর্যন্ত পড়ার পর আমাকেও বাবা-মা নিয়ে আসলেন সাইনামারীতে। ওখানে ক্লাশ ফোরে ভর্তী হলাম। ঘুমথেকে উঠার পর থেকে আবার ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত যার সাথে থাকা, মেলামেশা, স্কুল, খেলা-ধূলা, এক থালাতে করে ভাত খাওয়া; এমন কি মাঝে মাঝে ঘুমাতামও যার সাথে; তিনি আমার পাজং (জ্যাঠা)-এর ছেলে পল; আমার নানা রঙের দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে আসলে আমার এই ভাই পলের সাথে আমার এমন কিছু স্মৃতি আছে, তাই শেয়ার করতে চাইছি...
ঘটনা- ০১
তো একদিন স্কুল ছুটির পর আমরা খিরু (নদী)-তে মাছ ধরতে যাবো সেখানে অনেক পানি, ডুব দিয়ে  মাছ ধরা (রিমছিবা) ছাড়া উপায় নেই। আমিতো সবসময় প্যান্ট পরতেই অভ্যাস্ত। কিন্তু এই গ্রামে তখনও লেংটি পরার চল ছিল। কারণ আজ প্যান্ট ভিজালে পরের দিন স্কুলে যেতে পারবে না, তাই সে লেংটি পরে নিল। আমরা খুব কায়দা করে কলা গাছের খোলটাকে ভাজ করে খকসি (খালয়/ মাছ রাখার পাত্র) বানালাম। এটার সুবিধা মানুষ পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরার সময় খোল-খকসিটা পানির উপর ভাসতে থাকে, আর মাছও পালাতে পারে না। তো আমরা দুজন মহানন্দে মাছ ধরছি আর মজার মজার গল্প করছি। কখন যে বেলা পড়ে গেলো, টের পেলাম না। সারাদিন কড়া রোদের কারনে আমরা মাছও অনেক পেয়েছি। সামনে নদীর জলের উপর একটু ছায়া পড়েছে, সেখান থেকে মাছ ধরেই আমরা উঠে পড়বো। মাছ ধরতে ধরতে আমরা এমনই মজে গিয়েছিলাম যে, কখন তার লেংটিটা পানির স্রোতে ভেসে গেছে, সে নিজেও টের পায় নি। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এবার বাড়ি ফেরার পালা। তার পরনের লেংটি হারিয়ে গেছে বলে তো আর নদীতে থাকা যায় না। উপরে উঠতে হবে, কিন্তু উপায় কি!
লেংটির বিকল্প হিসাবে একটা সঠি (দিগগী) পাতা দিয়ে তাঁকে কোন রকমে ঢেকে ঢুকে রওনা হলাম। উফ! এবার আরো একটা উটকো ঝামেলা দেখা দিলো। নদী থেকে উঠে এসে যে রাস্তা ধরে ফিরবো; ঠিক ওই রাস্তা ধরে আমাদের হেডমাষ্টার বেনেডিক্ট সিমসাং এগিয়ে আসছেন। আমরা অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকলাম, মনে মনে স্যারের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছি কিন্তু তিনি যান না। তিনি পথের ধারেই সমিতির পুকুরের মাছ দেখছেন কিংবা মাছের খাবার দিচ্ছেন। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমরা ভয়ও পাচ্ছি। ফেরার পথে বিরাট বড় বাঁশ বাগান। আর সেখানে আচ্ছু চিদাং-এর মহাশশ্মাণ ঘাট। কদিন আগেই সেখানে মড়া পুড়েছে। আবার মিমাং (ভুত-পেত্নী) নাকি সন্ধ্যায় বেড়োয় আর মাছ তাদের খুবই পছন্দের। ভাবতে ভাবতে আমাদের গলা শুকিয়ে আসছিলো।
ঘটনা- ০২
জাতিগতভাবে গারোরা ভীষণ সংস্কৃতিমনা। তার উপর সাইনামারী গ্রামের লোকজন আরো বেশী। আমাদের গ্রামের বার্ষিক পরীক্ষা সামনে। এদিকে বড়দিনের জন্য গ্রামে নাটকের রিহার্সেল চলছে। আমি আর ওই ভাই মিলে সন্ধ্যায় যুক্তি করলাম। চাঁদনী রাত। আমরা যাবো নাটকের রিহার্সেল দেখতে। আমাদের গতিবিধি দেখে পাজং (জ্যাঠা) আমাদের ধরার জন্য লুকিয়ে ছিলেন। আমাদের পরীক্ষার ব্যাপারে তিনি খুবই শংকিত। অথচ আমরা দুজনই ফার্স্ট, সেকেন্ড বয়। যে পাজং আমাকে তাঁর নিজের ছেলের চেয়েও বেশীই ভালবাসতেন; আজ তিনিই ভাবছেন, আমরা দুই ভাই বুঝি উচ্ছন্নে যাচ্ছি। আমিতো জানতাম না; পাজং আমাদের ধরার জন্য লুকিয়ে আছেন।
গ্রামের রাত! শয়তানের ভয়ে আমি গান গাইতে গাইতে আমি তাদের বাড়ির কাছে পৌঁছলাম। তাদের বাড়ির কাছে পৌঁছতেই “আমার সাথে চালাকি, নাং’গিতা অং জাজক ইন্নেহা চানচিংআমিংনি...” বলেই আমার পিঠে বড় একটা লাঠি দিয়ে বেদম মাইর লাগালেন। পাজং-এর বয়স হয়েছে, চোখেও যেমন কম দেখতেন; কানেও তেমন কম শুনতেন। উল্লেখ্য- আমার ঐ ভাইটা লুকিয়ে আগেই রিহার্সেল দেখতে চলে গিয়েছিলো। পরে পাজং  যখন দেখলেন, আমি উনার ছেলে না; বাড়ি গিয়ে আজং (জয়াঠীমা)-র সাথে আলাপ করে অনুশোচনায় পাজং কেঁদে ফেলেছিলেন। আজং-এর কাছে গল্পটা শুনে আমিও আর একবার কাঁদলাম। সেদিন আজং আমাকে খুব আদর করলেন। পরেরবার যখন তাদের বাড়িতে আসলাম; আমি দেখলাম, আমার পাজং-এর মুখটা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। আমার দিকে তাকাতেও পারছেন না। এই আজং আর পাজং দুজনই এখন স্বর্গবাসী।
ঘটনা- ০৩
আমার আম্বি (দিদিমা)-র গানের গলা ছিলো অসম্ভব মিষ্টি, সুন্দর। আশ্চর্য তার প্রতিভা। আচ্চু (দাদু)-র মৃত্যুর পর তার গানের গলা যেন আরও খুলে গিয়েছিলো। স্কুল কি জিনিশ না জানা সত্ত্বেও নিত্য নতুন গান রচনা করে তিনি গাইতেন। আমি, আম্বি আর এক পাগলা কাকা ঘুমাতাম একই ঘরে। আম্বি খুব ভোরে জেগে উঠতেন আর কাঁদতেন। তিনি কাঁদতেন তো বটেই তবে রেরে, আজিয়া, গ্রাপা জাতীয় গানের মাধ্যমে। রাতকে ভোর সকাল করে তুলতেন। আমিই আম্বির এই বিচ্ছেদ বেদনামাখা কান্নার নিয়মিত একমাত্র শ্রোতা এবং ভক্ত ছিলাম । দিনের বেলা প্রায়ই আম্বি আমাকে তার কাজের জায়গায় নিয়ে যেতেন আর সেই সমস্ত গান শেখাতেন। আমার সাথে থেকে পল, আমার ভাইটির বোধয় অর্ধেক গান শেখা হয়ে গিয়েছিলো।
মাঝে মাঝে আমি আর পল একসাথে ঘুমাতাম; এটা তো আগেই বলেছি। ঘুমানোর সময় তার পাশের জনের উপর হাত তুলে ঘুমানো একটা বদ-অভ্যাস ছিলোই; বিশেষ করে শীতের সময় পেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তার ঠান্ডা হাত গরম করে নিতো। আমি প্রায়ই বিরক্ত হতাম, কিন্তু কোনদিনও শুনতো না। সেদিনও রাতে পল আমার সাথে শুলো। তার ঠান্ডা হাতথেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় চালাকি করে আলাপ জমাতেই আমি বললাম, “চল, কাল দিনের বেলা আমাদের সাথে থেকে কাজ করবে এবং গানও শিখতে পারবে”। সে কোনদিন আমার কথা ফেলতো না, তার উপর গান শেখার সুযোগ। রাজী হয়ে সে গেলো। সকাল হলে আম্বির কাছে বলে আমি তাঁকে নিয়ে নিয়ে সরিষা তুলতে নিয়ে গেলাম।
কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। অনেক বড় সরিষা ক্ষেতে আমরা দুজনই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সরিষা উঠাচ্ছি আর উচ্চস্বরে গান গাইছি। দুপুরে আম্বি আমাদের দুজনের জন্য খাবারটা রেখে আবার পানি আনতে গেলেন। কিন্তু পলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে পেছন ফিরে একমনে সরিষা উঠাচ্ছে আর উচ্চস্বরে গান গেয়েই চলেছে। এদিকে ক্ষিধের চোটে পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাবার যোগার। আমার দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেলো। তাঁকে ডাকতে আর চমকে দেওয়ার জন্য একটা মাঝারি সাইজের মাটির ঢেলা নিয়ে তার দিকে ছুঁড়লাম; লক্ষ্য ছিলো ঢিলটা পরবে তার পেছনে বা কাছাকাছি। কিন্তু না! কি সাংঘাতিক দুর্ঘটনা! ঢিলটা সোজা গিয়ে পড়লো তার গালে। তাঁকে চমকে দিতে গিয়ে আমিই হতবম্ব হয়ে গেলাম। কি করতে গিয়ে কি হয়ে গেলো। অপরাধবোধ আমাকে এমন ভাবে পেয়ে বসলো যা বলে আমি বুঝাতে পারবো না। মূহুর্তের মধ্যে তার গালটা ফুলে নীল হয়ে গেলো। সে শব্দ করে কাঁদছে না তবে চোখ দিয়ে দর দর করে জল ঝরছে। আমি খুবই অসহায় বোধ করছি। আমি কিছু বলার আগেই উল্টো পলের স্বরে সান্ত্বনার বানী ঝরতে লাগলো, ‘দেখো, তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছো, আমি জানি, তুমি ইচ্ছা করে ঢিলটা আমার দিকে ছুড়ো নি’। সে যতই কথাগুলো বলে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে, ততই আমার কান্নার বেগ বাড়ছে। আমি উচ্চস্বরে হাও হাও করে কাঁদছি। তাকে ব্যাথা দেওয়া আর উল্টো আমাকেই সান্ত্বনা; মেনে নিতে পারছিলাম না কোনভাবেই। ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলাম। আমি অনুভব করলাম, এতো কিছুর পরও তার পক্ষথেকে আমার প্রতি বিন্দু মাত্র ভালোবাসা, মায়া-মমতা কমে নি বরং বেড়েছে! এই ঘটনাই বোধয় আমাদের দুজনের ভাতৃত্ববোধ, ভালোবাসা, বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করেছে। আপন মায়ের পেটের সন্তানেরা কজনইবা পারে এমন আপন ভাই কিংবা বোন হতে...?
ঘটনা- ০৪
ঘটনার সময়কাল ১৯৯৯ এর। আমি ওয়ার্ল্ড ভিশন সংস্থায় কাজ করছি। সংস্থার কর্মসূচীর বিরাট পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। নতুন করে কর্মী নিয়োগ, যাচাই বাছাই হবে। এতোদিন বাড়ীথেকে যাতায়াত করে কাজটি করার সুবিধা ছিলো; এখন তাও শেষ হতে চলেছে। কারণ চাকরীটা টিকে গেলেও অনেক দূরে বা অন্য জেলায় গিয়ে জব করতে হবে; এরকমই বলাবলি হচ্ছে।
এদিকে আমাদের বাড়ীতে বড় একটা সাংসারিক বিষয় নিয়ে ঝামেলা চলছে। সংসার শুরুর আগেথেকেই আর্থিক দৈন্যতা আমার জীবনের সাথে ল্যাপ্টে ছিলো। পরিবারে শশুর স্ত্রোকের পর নড়তেও পারেন না। শাশুড়ীর বয়স হয়ছে, সংসার দেখা তো দূরের কথা নিজে এক জগ পানি এনেও খেতে পারেন না। এখন আমি যদি চাকরী করতে দূরে চলে যাই; তাহলে স্ত্রী একা ছোট্ট দুটি ছেলে নিয়ে কিভাবে পুরো একটা সংসার সামলাবে, কি ভাবে তার চাকুরীটা করবে; আমি কিছুতেই ভেবে পাই না। তাই আমি আমার গিন্নীকে বললাম তার চাকরীটা ছেড়ে দিতে, কিন্তু তাতেও রাজী হচ্ছে না। সব কিছু ভেবে আমিই এই চাকরীটা করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতিমধ্যে অফিসে খবর পেলাম, যাদের চাকরী থাকবে না বা করবে না, সংস্থা সে কর্মীদের জন্য চাকরীর বয়স হিসাব করে সেভারেন্স পে (এককালীন টাকা) দেওয়া হবে। ভাবছি, ভালই হলো। যেটুকু টাকা পাবো সেটা দিয়েই আমি কোন রকমে সংসার ম্যানেজ করে চলবো; চালিয়ে নেবো। এদিকে আমার স্ত্রী আমাকেও চাকরী ছাড়তে দেবে না। আমার স্ত্রীও দমার পাত্রী নন; তিনি আমার স্ট্যাটাস এবং সংসারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাকে বুঝাতে বসলেন, বললেন, “আমি নিজের প্রতি প্রচন্ড আত্মবিস্বাসী। তুমি আমার জন্য, বাচ্চাদের জন্য, এই সংসারের জন্য ভেবো না। অভাবকে আমি ভয় পাই না। আমি একাই সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা সামলাতে পারবো; তাছাড়া সংসারে যা আছে আর আমার চাকরীর বেতন দিয়েই আমরা কোন রকমে চালিয়ে নিতে পারবো; সে আত্মবিশ্বাস আমার আছে। কিন্তু চাকরী ছেড়ে তোমারই ভালো লাগবে না। দেখো”। আমি বরাবরই একরোখা মানুষ। আমাকে বুঝানো সহজ সাধ্য ছিলো না। আমার স্ত্রী জানতেন, আমাকে বুঝাতে একজনই পারে; সে পল। ঢাকায় চাকুরি করে। ঠিক এই সময় এই ভাইও ঢাকাথেকে বাড়ী এসেছে। তাঁকে স্ত্রী ডেকে পাঠালেন এবং সব ঘটনা খুলে বললেন। এইবার যাই কোথায়, আমার পালাবার উপায় নাই। পল আমাকে রাজী করাতে আদাজল খেয়ে লাগলো। মন সায় দিচ্ছিলো না তবুও আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে কিছুটা সড়ে আসলাম। কায়মনোবাক্যে আমি চাইছি, ইন্টারভিউতে না যাওয়ার জন্য আমি যেন নতুন বাহানা, অজুহাত খুঁজে পাই।
ক্রমেই আমার ইন্টারভিউর দিন ঘনিয়ে এলো। আমি যদি ইন্টারভিউতে না যাই সেই ভয়ে পল তার ছুটি বাড়িয়ে নিলো যেন আমাকে নিয়েই ঢাকায় যেতে পারে। পলের বাড়ি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তাই সে আগের দিন এসে নিজে ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসলো। কিন্তু সন্ধাথেকে মেরাথন বৃষ্টি পড়ে আমার ইন্টারভিউতে না যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে লাগলো। মনে মনে আমি খুশি। প্রার্থনা করছি, এই বৃষ্টি যেনো না থামে। না ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেন নি। আমি বললাম, ‘ছাতাও তো আনি নি; পরিবেশ আর আবহাওয়ার অবস্থা দেখে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না’। পল শুনলো না; বললো, ‘ঢাকা শহরে ছাতা লাগে না, ওখানে ছাতা ব্যাবহার করলে গেরাম্যা গেরাম্যা লাগে; আনস্মার্ট লাগে...’ বলেই বাচ্চা ছেলেকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে তোলার মত করে আমাকে দোখলা (পিকনিক স্পট) বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসলো। কিন্তু বাজার প্রায় ফাঁকা। ভ্যান রিক্সা কিছুই নেই। বৃষ্টির কারনে ভ্যান ওয়ালারা বাড়ীথেকে বেড় হয় নি। এখন উপায়! দোখলাথেকে রসুলপুর পর্যন্ত ভ্যান নিয়ে পুর ৫ মাইল (প্রায় ৮কিমি) বন পেরোতে হবে। বাড়ীর লোকজন এনে একটা ভ্যানগাড়ি আনালো। আবারও প্রায় টেনে হিঁচড়ে আমাকে ভ্যানে উঠালো। ভ্যান চলা শুরু করে দিয়েছে আর আমার মনটাও আরও  খারাপ হচ্ছে। আমি আবারও পার্থনা করছি, হে ঈশ্বর, বনের ভেতর যেনো আমাদের সব কিছু ভিজে যায়, যেনো ফিরে আসতে পারি...’। সত্যি সত্যি মেঘ আর বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়ে গেলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুষল ধারে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে পল তার ব্যাগথেকে একটা লুঙ্গি বেড় করে এনে মাথার উপর মেলে ধরলো। তারপরও আমরা ভিজে চুপসে যাচ্ছি। আমি বললাম, এখন কি করে যাবো, সব তো ভিজে শেষ...। সে আমার কোন কথাই কর্ণপাত করল না। বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই আমার আমাকে ভ্যানে উঠালো। তারপর রসুলপুর...
ঢাকায় অনেকদিন পর আসলাম। হোটেল ফার্মগেইটে উঠেছি। তারপর খানিক ফ্রেস হয়ে আবার এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে ঘুড়ছি। আমার ভাইটা আমাকে ইন্টারভিউর জন্য প্রিপারেশন নিতে তাগিদ দিতে লাগলো। আমি বললাম, তোমার ভাইটা কি এতই অকাজের? প্রায় ১১ বছর যে কাজ করছি, প্রশ্নতো সেখান থেকেই হবে। আমার কলিগরাও বলল, তুই কি ইন্টারভিউতে এসেছো না কি বেড়াতে? পল নিশ্চয় বুঝে গেছে, আমি ইন্টারভিউ দিতে চাইছি না। তাই সে জোড় করে হোটেলে ফেরত নিয়ে, খাইয়ে বললো, ‘এবার পড়’। বললাম, ‘আমি টায়ার্ড, পড়তে ইচ্ছে করছে না’।  সে বললো, তাহলে এক কাজ কর, তোমার নোটগুলো আমাকে দে। তুই শুয়ে পড়, আমি তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি...’ এই বলেই সে পড়া শুরু করে দিলো। সে কঠিন কঠিন ইংলিশ পড়ছে, আর এদিকে আমি ভাবছি, ভাইটা আমাকে কতো ভালোবাসে...। আমার ভিষণ ঘুম পাচ্ছিলো, কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, সেই জানে।
পরদিন যথারীতি ঘুমথেকে জাগিয়ে, নাস্তাপানি খাইয়ে তাড়াতারী প্রস্তুত হতে বললো। আমি যেন উল্টাপাল্টা না করি, জিজ্ঞেস করলে ঠিক মত যেন উত্তর দেই এমন আরো কত কি সাজেশন দিয়েই চললো অফিস পর্যন্ত। ইন্টারভিউতে দুই ঘন্টা ধরে শুধু ভাইভা নেওয়া হলো। ইন্টারভিউর পরিবেশ দেখে আমি মনে মনে খুব খুশি। আমার ভাইটাকে বললাম, ‘এত সহজ প্রশ্ন আর আলাপচারিতায় আমার চাকরি হতেই পারে না’। কথাগুলো শুনে আমার এই ভাইটা খুবই হতাশ হলো।
প্রায় মাস খানেক পর যখন রেজাল্ট দিলো। লিষ্টে আমার নাম থাকবে না, এতো আমি জানি। প্রায় সবাই এ নিয়ে লাফালাফি করলেও উদাস। এক সময় আমার এক কলিগ সবার উদ্দেশ্য বললেন, ‘দেখেন সবাই, ফিডেল’দা কি চালাক! মিষ্টি খাওয়ানোর ভয়ে কিচ্ছু বলছে না’। তখনও আমার নির্বাক উত্তর। ‘ধুর মিয়া, বাজে বকবা না...’। আমি যে সত্যি সত্যি দেখি নি তা কেউ বিশ্বাস করলো না। আমি বললাম, ‘যাও মিষ্টি খাইতে চাইলে, লিষ্টের কাগজটা ফটোকপি করে নিয়ে এসো’। কাগজ দেখার পর আমাকেও সবার জন্য মিষ্টি খাওয়াতে হলো। ভাই পলকে জানিয়ে চিঠি লিখলাম। ১৫ দিনের মধ্যে উত্তর এলো, লাল হৃদয়ে ফুলের মালা দিয়ে ঘেরা লেটার প্যাড। তাতে লেখা- ‘বাহে, জানিস, আজ আমার আকাশ বাতাস জুড়ে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। এ তোমার সাফল্য নয়; আমার সাফল্য; হিমালয় চুড়ার চেয়েও। এ আনন্দে আমি আত্মহারা... অনেক ক্ষণ আনন্দে কাঁদলাম...’। আমি চিঠি পড়ছি আর ভাইটার আনন্দ-অশ্রু ঝরা চোখ, মুখ ভেসে উঠছে। কখন গিন্নী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, টের পাই নি। আমার চোখের জল মুছে দিলো। আমার চোখথেকে আঁচল সড়াতেই দেখি, আমার গিন্নির চোখেও টপ টপ  করে ক’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো..

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন