শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪

অসীম সাহসী বীর গারো মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা

অসীম সাহসী বীর গারো মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা

দেশ স্বাধীন করেও আজও আমরা পরাধীন!
ফিডেল ডি সাংমা।

নিজেদের দেশ ও মাটিকে ভালবেসে ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে যাঁরা জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধাও ছিলেন, এখবর আজ আর নতুন নয়। তাঁরা জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে মুসলমান ও হিন্দু মুক্তিসেনাদের সাথে সমান তালে হাতে অস্ত্র নিয়ে শক্রর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে শত্রুদের পরাজিত করে বাংলার বুকে লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। সে সময় জীবনবাজী রাখা টগবগে আদিবাসী বীর মুক্তিসেনারা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং অভাব অনটনে জর্জরিত। তাঁদের অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে কোন রকমে মাথা গুঁজারও ঠাই পান না। এঁদের কেউ কেউ অন্যের জমিতে কাজ করেন। কেউবা আবার বর্গার জমি নিয়ে চাষ করেন, আবার কেউ কেউ অনাহারে অর্ধাহারে, বিনা অষুধে রোগে শোকে ধুকে ধুকে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। ঘরে ফসল তুলতে  হয়। কাজ না করলে অন্নের সংস্থান হয় না। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে শত্রুকে পরাজিত করে বাংলার স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু পান নি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ বলে জানালেন আমাদের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা।

১৬ই ডিসেম্বর নিজগ্রামে (ধরাটি) ঢাকাথেকে আগত মানবিক সংগঠন এবং গ্রামের জনগন সম্মিলিতভাবে  সম্বর্ধনা দিলেন গ্রামের ৩ গারো মুক্তিযোদ্ধাকে। তাঁদের মধ্যে চীন দালবত, ফালগীন দালবত এবং এঁদের আরেকজন ধীরেন্দ্র সাংমা। গারো আদিবাসীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যিনি সবচেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী বলে খ্যাত ছিলেন, অথচ আজ তিনিই তাঁর শারীরিক সমস্যার কারনে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেন নি। তাই “মানবিক” এবং গ্রামবাসীর পক্ষে উনার বাড়িতে আমরা "দামা" গ্রুপের সদস্যরা হাজির হয়েছিলাম। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা আমাদের দেখে হতবাক হলেন। পরে আমাদেরকে রোদ পোহানোর সুবিধার কথা বলে তাঁর বাড়ির উঠোনে বসতে বললেন। আমরা তাঁকে সম্বর্ধনার ফুল, উত্তরীয়, বিজয়ের প্রতীক ফুল এবং অন্যান্য উপহার উনার হাতে তুলে দিতেই উনার অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ, দুঃখের মলিন মুখ নিমিষেই স্বাধীনতার লাল সূর্য্যের মত রক্তিম হয়ে উঠল। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি  জানালেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উনাকে দেখার জন্য, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ করার জন্য, তাঁর জীবন যাপনের খোঁজ নেওয়ার এপর্যন্ত কেউ যায় নি।

 অসীম সাহসী এ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম- ধীরেন্দ্র সাংমা। পিতার নাম থনিন্দ্র মারাক, মাতা- গেন্দি দালবত। বর্তমান ঠিকানা, গ্রাম- ধরাটি, পোস্ট- পীরগাছা, উপজেলা- মধুপুর, জেলা- টাঙ্গাইল। মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা, জাতিতে গারো। জন্ম- ১৯৩৭খ্রিস্টাব্দ। তিনি ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করেছেন। পিতা- থনিন্দ্র মারাক, মাতা- গেন্দি দালবত। বর্তমান ঠিকানা, গ্রাম- ধরাটি, পোস্ট- পীরগাছা, উপজেলা- মধুপুর, জেলা- টাঙ্গাইল। ছেলেমেয়ের সংখ্যা ১০জন এবং এদের ঘরে মোট ২৪ জন নাতিপুতি রয়েছে। মস্তিস্কে বিকৃত ১ ছেলেকে নিয়ে ছোট ছেলে নবীন নকরেকের সংসারে দিনাতিপাত করছেন। বাকী সব ছেলেমেয়রা বিয়েসাদী করে যার যার মত কোনরকমে সংসার ধর্ম করছেন। গারো মুক্তিযোদ্ধার ধীরেন্দ্র সাংমার সাথে সাক্ষাতের সময় উনার কাছে আমরা কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণে আমাকে সহযোগিতা করছেন “দামা” গ্রুপের সদস্য যোনাথন নকরেক এবং করবী জেত্রা।

প্রশ্ন-১। মুক্তি যুদ্ধে আপনি কিভাবে গেলেন?
আমরাও এ দেশেরই সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের আগে ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই পশ্চিম পাকিস্তানের এদেশের প্রতি অন্যায় জুলুমের কথা জানতাম। তারপর বিভিন্ন মাধ্যমে যখন জানলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, তখনই ভাবলাম এদেশকে রক্ষা করতে আমরাও যাবো মুক্তিযুদ্ধে। করতে। তারপর (দিন তারিখ মনে নেই) বাড়ির কাউকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘন বনজঙ্গল পেরিয়ে আমরা চলে যাই ভারতের রংনাবাগ ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে রাইফেল, বন্দুক, মেশিনগান, গ্রেনেড চালানো শেখানো হয়েছে।

প্রশ্ন-২। আপনারা কোথায় এবং কোন ফ্রন্টে যুদ্ধে ছিলেন?
আমরা ভারতের রংনাবাগ ট্রেনিং সেন্টারে ১৮ দিন ট্রেনিং শেষে দেশে এসে ১১ নং সেক্টরে যোগ দিই। এই দলে আমরা ২১জন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা  ছিলাম। এদের মধ্যে আমাদের ধরাটি গ্রামের আমার সাথে চীন দালবত, অমলেশ মৃও ছিলেন। সেসময় জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও কামালপুরে কয়েকটি অপারেশনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও ছিলেন। তিনি শেরপুরের ঝিনাইগাতি এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তারপর ধনিয়া, কামালপুর, কাটাপুল, বর্গাডাব এলাকায় যুদ্ধ করে শত্রুর চলার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন ব্রীজ ধ্বংস করেন। পুরাগাছায় পাকিস্তানী ক্যাম্প এবং নকশি ক্যাম্প এটাক করেন।

প্রশ্ন-৩। ৭১ এ যখন যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল তখন আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তখন কি আপনি ভেবেছিলেন  বাঙ্গালীদের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন?
হ্যা, তাতো অবশ্যই। কারণ আমরাওতো এ দেশেরই সন্তান। এ দেশেই আমাদের জন্ম-কর্ম। পশ্চিম পাকিস্তানের এদেশের প্রতি অন্যায় জুলুমের কথাতো আমরাও জানতাম। দেশকে মুক্ত করতে এইতো সুযোগ। তাই আমরাও সবার সাথে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিলাম। অথচ এখন বাঙ্গালীরা আমাদের হেয় ভাবে, এটাই কষ্টদায়ক।

প্রশ্ন-৪। যুদ্ধের স্বপক্ষে কোন কোন বিষয়গুলি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন?
বাংলাদেশ স্বাধীন না হলেতো আমরা সবাই পরাধীন থেকে যেতাম। পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে থাকতে হতো। ওদের দয়া দাক্ষিন্ন নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু আমরা আদিবাসীরা স্বীকৃতি পেলাম না; আর আমরা আদিবাসীরা পরাধীনই রয়ে গেলাম।

প্রশ্ন-৫। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য যে যুদ্ধ তা অর্জন করতে এককভাবে অন্য রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া কি সম্ভব ছিল?
আমি যুদ্ধের সময়ে সেভাবে ভাবি নি। অন্য দেশের সহযোগিতার কথা তেমন জানতামও না। তবে আজ এটুকু জানি- ইন্ডিয়া এবং অন্যান্য দেশ আমাদের সহায়তা না করলে দেশ স্বাধীন করা অনেক কঠিন হতো। বিভিন্ন দেশথেকে যারা আমাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন, শুনেছি, তাদেরকে সরকার সম্মাননা দান করেছেন। আমিও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

প্রশ্ন-৬।  যুদ্ধকালীন সময়ে আদিবাসী হিসেবে আপনারা হিন্দু বা মুসলিমদের মত ভারতে গেলেন না কেন? সবাই তো কম বেশী ভারতে যাচ্ছিল।
সেসময়ে বাংলাদেশ ভারত বর্ডারের অনেকেই চলে গিয়েছিলো এবং দেশ স্বাধীণ হওয়ার পর অনেকেই ফিরেও এসেছেন। তবে এখানে আমাদের মধুপুর গড়ে সেসময় ঘন বনজঙ্গল থাকায় আমাদের লোকজনদের পালিয়ে থাকার বেশ সুবিধা ছিলো। অন্যদিকে এদিকটা রাস্তাঘাট ভালো না থাকায়, শত্রু পক্ষের লোকেরা সুবিধা করতে পারে নি।

প্রশ্ন-৭। যুদ্ধকালীন সময় বাঙ্গালী, পাহাড়ি, আদিবাসীদের মাঝে কোন পার্থক্য দেখেছিলেন? আর দেখে থাকলে সেগুলোকে কিভাবে দেখেছিলেন?
না, সেসময় বাঙ্গালী, পাহাড়ি, আদিবাসীদের মাঝে তেমন পার্থক্য ছিলো না। বাঙ্গালীদের দ্বারা আদিবাসীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতীত, শোষিত বঞ্চিত হচ্ছে তা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। বর্তমানে আমার পত্তনী জমির প্রায় কোনাবাড়ী বাজারে প্রায় দেড় একর জমি সরকারের দখলে। সেখানে পুকুর খনন হয়েছে, আর ইউনিয়ন কাউন্সিল সেটা লিজ দিয়ে রেখেছ। এ জমিটা আমার দখলে থাকলে আমাকে এতটা কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো না। আমার সন্তানদেরও জমিজমা কিছুই দিতে পারি নি।

প্রশ্ন- ৮। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আপনাদের কি কি সুবিধা দেওয়া হয়েছিলো?
ওরা আমাদের দুইবেলাই খাবার রুটি, ভাত, মাংস দিতো। কোন কোনদিন ফ্রুট, জুস থাকতো। আমি জুনথেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মাসিক ৫০টাকা বেতন পেতাম। আর এসব দিয়ে আমরা এলাকার অসহায় লোকদেরকেও সাহায্য করেছি।

প্রশ্ন- ৯। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এমন একটি ঘটনার কথা বলুন যা আপনাকে আনন্দ দিয়েছে
তখনতো আনন্দ করার সময় না। তবে, কমান্ডারের নির্দেশে আমরা যেদিন চীন দালবতকে মেয়ে সাজিয়ে গান গাইতে গাইতে নৌকায় যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের মনে যেমন শঙ্কাও ছিলো, তেমনই মেয়েরূপী চীনের নাচ দেখে মজাও পেয়েছি। শেষে সন্ধ্যার দিকে শত্রুদের ক্যাম্পের কাছিকাছি গিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে দিয়ে আসার পর সকালে যখন জানলাম সব শত্রু মরে গেছে, তখন আমাদের আনন্দ ১০ গুন বেড়ে গেল।

প্রশ্ন- ১০। বাংলাদেশ আজও আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিলো না। এখন যদি আপনাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, তখন কি অনত্র চলে যাবেন?
আমরাও জীবনকে বাজী রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে। তাহলে কেনো যাবো এ দেশ ছেড়ে। আমি এদেশেরই সন্তান, আমি এদেশের মাটিতেই মরতে চাই। আফসোস, দেশ স্বাধীন করেও আজও আমরা পরাধীন!

প্রশ্ন- ১১। সবশেষে আমাদের প্রজন্মের জন্য কিছু বলুন
আমরা যেমন নিজের জীবনকে বাজী রেখে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পরেছি, তেমনই তোমরাও জাতি ও সমাজের জন্য কিছু একটা কর। শিক্ষিত সমাজ হিসাবে গড়ে তোল; তবেই দেশের সকলেই সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে। ধন্যবাদ তোমাদের, ধন্যবাদ মানবিক গ্রুপ এবং গ্রামের প্রতিটি মানুষকে।

অসীম সাহসী বীর গারো মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমার সাথে আলাপ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছিলো। আমরা আসার আগে আরেকবার দেশের অবদানের জন্য উনাকে এবং উনার স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরাও বিদায় নিলাম।

পুনশ্চঃ আসুন আমাদের বাড়ি বা গ্রামের আশপাশে অভিমান নিয়ে বসবাসকারী কিংবদন্তী তুল্য এমন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট্ট পরিসরে হলেও সম্মানিত করি। সেল্যুট সকল মুক্তিযোদ্ধা! ধন্যবাদ পাঠকবৃন্দ, ধন্যবাদ সবাইকে।

ছবি ১- স্বস্ত্রীক মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা
ছবি ২- সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী ফিডেল ডি সাংমা
ছবি ৩- সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী দল
ছবি ৪- মুক্তিযোদ্ধার সনদ
ছবি ৫- - পত্তনীকৃত জমির কাগজ
ছবি ৬- পত্তনীকৃত জমি যেখানে এখন