শুক্রবার, ১২ জুন, ২০১৫

দৃষ্টিপাতঃ৮ নীতিমালাগুলো কি শুধু অপেক্ষাকৃত দূর্বল ব্যাক্তি এবং সংখ্যালঘুদের জন্য?


দৃষ্টিপাতঃ৮ "কতা কয়লে কতা বাজে, হাল বায়লে গ্যাঁড়া বাজে"; নীতিমালাগুলো কি শুধু অপেক্ষাকৃত দূর্বল ব্যাক্তি এবং সংখ্যালঘুদের জন্য?

মাঝে মাঝে কোন কোন মানুষের মুখে নীতিকথা শুনলে লোকটাকে মহান, নীতিবান বলে মনে হয়। দেশে, পৃথিবীতে কিছু নীতিবান লোকতো আছেই, তবে বাদবাকী এসব গিরিগিটী স্বভাবের চরিত্রটা উন্মোচিত হয়- যখন দেখি, সেই নীতিকথা তাঁর নিজের জন্য নয়, শুধু পরের জন্য; অপেক্ষাকৃত দূর্বল ব্যাক্তি এবং সংখ্যালঘুদের জন্য। নিজেদের প্রভাব, আধিপত্য প্রদর্শণের জন্য সেসব স্বঘোষিত নেতা, ব্যাক্তিবর্গ সেসব জ্ঞান, নীতিবাক্য চাওয়াতে তাঁদের উপরে চাপিয়ে দিতে চান ছলেবলে কলেকৌশলে। খুব বেশিদিন মুখোশ পড়ে থাকতে পারেন না। তথাপি, সেসব জানার পরেও বলা যায় না, বলতে গেলেই দোষ, তখন আরেক কাহিনীর জন্ম নেয়। মোদ্দাকথা, উনারা বুঝেও না বুঝার ভান করেন- "হাতের পাঁচটা আংগুল সমান না"- এটা জানবেন, কিন্তু "সবাই পাঁচটা আঙ্গুল দিয়ে ভাত খায়"- এটা জানবেন না, তাতো হয় না।

আগে একটা টাঙ্গাইলা প্রবাদ বলি। তা হলো- "কতা কয়লে কতা বাজে, হাল বায়লে গ্যাঁড়া বাজে"। এ প্রবাদ বাক্যের প্রতিটা শব্দের অর্থগুলো জানলে পুরো বাক্যের অর্থটা খুবই সোজা। কিন্তু প্রবাদের সূচনা কেন করছি, তা আর কেউ না জানুক, যাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আশা করি তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন। একই পরিবারের লোক যেমন সমমনা না হলে সে সংসার টিকে না, তেমনই ভাতৃত্ববোধ না থাকলে, সমমনা না হলে দেশে ও সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা যায় না। তাই, সেসব মুখোশধারী নীতিবান লোকদের কাছে ভ্রাতৃত্ববোধের ব্যাখ্যা ও উপায় জানতে চেয়ে আমার এলেখাটি।

সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার উদাহারণ দিয়ে বলি। কিছুদিন আগে ঢাকায় একটি গারো মেয়েকে ধর্ষণের প্রতিবাদে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, সেখানে জনৈক ব্যাক্তি (বন্ধুও বটে!) একটি দামী মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছেন, “গারো তাতে কি? ...... যারা উপকারের এর নামে ধর্ষণকারী তাদের শাস্তি আমিও চাই।এযুগে এমন মনোভাব এবং মন্তব্য খুবই হতাশাব্যঞ্জক। আমি মনে করি, এই মন্তব্যে অনেকগুলো মানুষের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অতীত অভিজ্ঞতাতো তাই বলে। তাই আমি তাঁর কমেন্টের প্রত্যুত্তরে লিখেছিলাম, “"আদিবাসীরা বিশেষ করে গারোরা যেভাবে এবারে আন্দোলন করছে, তাতে বাঙ্গালী মুসলিম ভাইবোনদের কতটুকু সহযোগিতা করছে- তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এভাবে পক্ষপাতিত্বতো দেখালেতো দেশের ন্যায়নীতি ঠিক থাকবে না। ক্ষুদ্র, বিচ্ছিন্নভাবে সুশাসন আদায় করা অন্তত এই দেশে সম্ভব না। আজকের ধর্ষিতা একজন আদিবাসী না হয়ে বাঙ্গালী মুসলিম হলে বোধয় স্ট্যাটাসে লাইক কমেন্ট করে কুলানো যেতো না। বিশ্বাস নাহয়, এই ধর্ষণের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের কয়টা স্ট্যাটাস পাবেন, তা নিউজফিডে স্ট্যাটাস চেক করে দেখতে পারেনবাস্তবতা হলো, এই ধর্ষণের বিরুদ্ধে মধুপুর গড়ের গারো এবং দেশের অন্যান্য আদিবাসী সংগঠনগুলো প্রতিবাদে মুখর হলেও বাঙ্গালী কোন সংগঠন এগিয়ে আসে নি। তবে ঢাকার কিছু ছাত্র সংগঠন এবং অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বাঙ্গালি ভাইবোনেরা ব্যাক্তিগত ভাবে এগিয়ে এসেছেন, আমি ব্যাক্তিগতভাবে তাঁদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। সেসব নীতিবান লোক, যাঁদের কাছে আমরা সমবেদনা, সুবিবেচনা, সুবিচারের আশা করি, আজ তাঁদের মৌনতা দেখেছি। তাঁদের বলা নীতিবাক্যগুলোও যেন আমাদের বিবেকের পিত্তাশয়ে তীরের মতো বিঁধে। আমাদের প্রতিবাদতো কোন জাতি বা গোষ্ঠ্যির বিরুদ্ধে ছিলো না, প্রতিবাদ ছিলো ছিলো কতিপর ধর্ষকদের বিরুদ্ধে। তাহলে সেসব নীতিবান লোকদের এই মৌনতার কারণ কি? কেন এ দৈন্যতা?

যাইহোক, এবারকার মতো গারো যুবকেরা এমন অকল্পনীয় কাজটাই করে ফেললো। এই ধর্ষণের বিরুদ্ধে ঐক্য আন্দোলনের মাধ্যমে সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো এই বাংলাদেশের বুকে গারো জাতির লোকেরাও বাস করে। "হাতের পাঁচটা আংগুল সমান না" হলেও "সবাই ঐ পাঁচটা আঙ্গুল দিয়ে ভাত খায়" এই প্রবাদটি প্রমাণ করে ছাড়লো ঐ ধর্ষকদের গ্রেফতার করতে বাধ্য করে। যেখানে সংখ্যাগুরুর বেলায় অনেক ধর্ষকেরাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, সেখানে এ আদিবাসীদের বেলায় প্রমাণিত হলো "সবাই পাঁচটা আঙ্গুল দিয়ে ভাত খায়"। সাব্বাশ যুবক ভায়েরা! খা সাংমা, খা মারাক!

"কতা কয়লে কতা বাজে, হাল বায়লে গ্যাঁড়া বাজে"; কিংবা বেশি কথায় খেতা (কাঁথা) হারায়”- দুটোই টাঙ্গাইলের প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত প্রাচীন প্রবাদ; এবং এর অর্থ টাঙ্গাইলারা নয়, আশা করি সবাই বুঝবেন। তাই, আর আজ আর কথা বাড়াতে চাই না। কথা হলো- কারা কি মনে করে, কারা কিভাবে চলে, তা চোখ-কান খোলা রাখলেই, একটু মনযোগ দিয়ে ভাবলেই বুঝা যায়, কয়েকদিনেই সবারই তা বুঝা উচিৎ। শুধু সেসব স্বঘোষিত আদর্শবান ব্যক্তিদের প্রতি অনুরোধ করবো- আপনাদের ব্যাক্ত করা মধুমাখা বাক্যগুলো, পরের উপর চাপিয়ে দেওয়া নীতিমালাগুলো শুধু অপেক্ষাকৃত দূর্বল ব্যাক্তি এবং সংখ্যালঘুদের জন্য না বলে নিজের জন্যেও বলুন। আপন চোখের ময়লা আগে পরিষ্কার করুন। জয় হোক মানবতার! জয় হোক সকল মানুষের!