শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪

অসীম সাহসী বীর গারো মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা

অসীম সাহসী বীর গারো মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা

দেশ স্বাধীন করেও আজও আমরা পরাধীন!
ফিডেল ডি সাংমা।

নিজেদের দেশ ও মাটিকে ভালবেসে ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে যাঁরা জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধাও ছিলেন, এখবর আজ আর নতুন নয়। তাঁরা জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে মুসলমান ও হিন্দু মুক্তিসেনাদের সাথে সমান তালে হাতে অস্ত্র নিয়ে শক্রর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে শত্রুদের পরাজিত করে বাংলার বুকে লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। সে সময় জীবনবাজী রাখা টগবগে আদিবাসী বীর মুক্তিসেনারা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং অভাব অনটনে জর্জরিত। তাঁদের অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে কোন রকমে মাথা গুঁজারও ঠাই পান না। এঁদের কেউ কেউ অন্যের জমিতে কাজ করেন। কেউবা আবার বর্গার জমি নিয়ে চাষ করেন, আবার কেউ কেউ অনাহারে অর্ধাহারে, বিনা অষুধে রোগে শোকে ধুকে ধুকে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। ঘরে ফসল তুলতে  হয়। কাজ না করলে অন্নের সংস্থান হয় না। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে শত্রুকে পরাজিত করে বাংলার স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু পান নি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ বলে জানালেন আমাদের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা।

১৬ই ডিসেম্বর নিজগ্রামে (ধরাটি) ঢাকাথেকে আগত মানবিক সংগঠন এবং গ্রামের জনগন সম্মিলিতভাবে  সম্বর্ধনা দিলেন গ্রামের ৩ গারো মুক্তিযোদ্ধাকে। তাঁদের মধ্যে চীন দালবত, ফালগীন দালবত এবং এঁদের আরেকজন ধীরেন্দ্র সাংমা। গারো আদিবাসীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যিনি সবচেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী বলে খ্যাত ছিলেন, অথচ আজ তিনিই তাঁর শারীরিক সমস্যার কারনে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেন নি। তাই “মানবিক” এবং গ্রামবাসীর পক্ষে উনার বাড়িতে আমরা "দামা" গ্রুপের সদস্যরা হাজির হয়েছিলাম। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা আমাদের দেখে হতবাক হলেন। পরে আমাদেরকে রোদ পোহানোর সুবিধার কথা বলে তাঁর বাড়ির উঠোনে বসতে বললেন। আমরা তাঁকে সম্বর্ধনার ফুল, উত্তরীয়, বিজয়ের প্রতীক ফুল এবং অন্যান্য উপহার উনার হাতে তুলে দিতেই উনার অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ, দুঃখের মলিন মুখ নিমিষেই স্বাধীনতার লাল সূর্য্যের মত রক্তিম হয়ে উঠল। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি  জানালেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উনাকে দেখার জন্য, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ করার জন্য, তাঁর জীবন যাপনের খোঁজ নেওয়ার এপর্যন্ত কেউ যায় নি।

 অসীম সাহসী এ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম- ধীরেন্দ্র সাংমা। পিতার নাম থনিন্দ্র মারাক, মাতা- গেন্দি দালবত। বর্তমান ঠিকানা, গ্রাম- ধরাটি, পোস্ট- পীরগাছা, উপজেলা- মধুপুর, জেলা- টাঙ্গাইল। মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা, জাতিতে গারো। জন্ম- ১৯৩৭খ্রিস্টাব্দ। তিনি ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করেছেন। পিতা- থনিন্দ্র মারাক, মাতা- গেন্দি দালবত। বর্তমান ঠিকানা, গ্রাম- ধরাটি, পোস্ট- পীরগাছা, উপজেলা- মধুপুর, জেলা- টাঙ্গাইল। ছেলেমেয়ের সংখ্যা ১০জন এবং এদের ঘরে মোট ২৪ জন নাতিপুতি রয়েছে। মস্তিস্কে বিকৃত ১ ছেলেকে নিয়ে ছোট ছেলে নবীন নকরেকের সংসারে দিনাতিপাত করছেন। বাকী সব ছেলেমেয়রা বিয়েসাদী করে যার যার মত কোনরকমে সংসার ধর্ম করছেন। গারো মুক্তিযোদ্ধার ধীরেন্দ্র সাংমার সাথে সাক্ষাতের সময় উনার কাছে আমরা কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণে আমাকে সহযোগিতা করছেন “দামা” গ্রুপের সদস্য যোনাথন নকরেক এবং করবী জেত্রা।

প্রশ্ন-১। মুক্তি যুদ্ধে আপনি কিভাবে গেলেন?
আমরাও এ দেশেরই সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের আগে ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই পশ্চিম পাকিস্তানের এদেশের প্রতি অন্যায় জুলুমের কথা জানতাম। তারপর বিভিন্ন মাধ্যমে যখন জানলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, তখনই ভাবলাম এদেশকে রক্ষা করতে আমরাও যাবো মুক্তিযুদ্ধে। করতে। তারপর (দিন তারিখ মনে নেই) বাড়ির কাউকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘন বনজঙ্গল পেরিয়ে আমরা চলে যাই ভারতের রংনাবাগ ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে রাইফেল, বন্দুক, মেশিনগান, গ্রেনেড চালানো শেখানো হয়েছে।

প্রশ্ন-২। আপনারা কোথায় এবং কোন ফ্রন্টে যুদ্ধে ছিলেন?
আমরা ভারতের রংনাবাগ ট্রেনিং সেন্টারে ১৮ দিন ট্রেনিং শেষে দেশে এসে ১১ নং সেক্টরে যোগ দিই। এই দলে আমরা ২১জন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা  ছিলাম। এদের মধ্যে আমাদের ধরাটি গ্রামের আমার সাথে চীন দালবত, অমলেশ মৃও ছিলেন। সেসময় জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও কামালপুরে কয়েকটি অপারেশনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও ছিলেন। তিনি শেরপুরের ঝিনাইগাতি এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তারপর ধনিয়া, কামালপুর, কাটাপুল, বর্গাডাব এলাকায় যুদ্ধ করে শত্রুর চলার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন ব্রীজ ধ্বংস করেন। পুরাগাছায় পাকিস্তানী ক্যাম্প এবং নকশি ক্যাম্প এটাক করেন।

প্রশ্ন-৩। ৭১ এ যখন যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল তখন আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তখন কি আপনি ভেবেছিলেন  বাঙ্গালীদের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন?
হ্যা, তাতো অবশ্যই। কারণ আমরাওতো এ দেশেরই সন্তান। এ দেশেই আমাদের জন্ম-কর্ম। পশ্চিম পাকিস্তানের এদেশের প্রতি অন্যায় জুলুমের কথাতো আমরাও জানতাম। দেশকে মুক্ত করতে এইতো সুযোগ। তাই আমরাও সবার সাথে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিলাম। অথচ এখন বাঙ্গালীরা আমাদের হেয় ভাবে, এটাই কষ্টদায়ক।

প্রশ্ন-৪। যুদ্ধের স্বপক্ষে কোন কোন বিষয়গুলি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন?
বাংলাদেশ স্বাধীন না হলেতো আমরা সবাই পরাধীন থেকে যেতাম। পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে থাকতে হতো। ওদের দয়া দাক্ষিন্ন নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু আমরা আদিবাসীরা স্বীকৃতি পেলাম না; আর আমরা আদিবাসীরা পরাধীনই রয়ে গেলাম।

প্রশ্ন-৫। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য যে যুদ্ধ তা অর্জন করতে এককভাবে অন্য রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া কি সম্ভব ছিল?
আমি যুদ্ধের সময়ে সেভাবে ভাবি নি। অন্য দেশের সহযোগিতার কথা তেমন জানতামও না। তবে আজ এটুকু জানি- ইন্ডিয়া এবং অন্যান্য দেশ আমাদের সহায়তা না করলে দেশ স্বাধীন করা অনেক কঠিন হতো। বিভিন্ন দেশথেকে যারা আমাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন, শুনেছি, তাদেরকে সরকার সম্মাননা দান করেছেন। আমিও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

প্রশ্ন-৬।  যুদ্ধকালীন সময়ে আদিবাসী হিসেবে আপনারা হিন্দু বা মুসলিমদের মত ভারতে গেলেন না কেন? সবাই তো কম বেশী ভারতে যাচ্ছিল।
সেসময়ে বাংলাদেশ ভারত বর্ডারের অনেকেই চলে গিয়েছিলো এবং দেশ স্বাধীণ হওয়ার পর অনেকেই ফিরেও এসেছেন। তবে এখানে আমাদের মধুপুর গড়ে সেসময় ঘন বনজঙ্গল থাকায় আমাদের লোকজনদের পালিয়ে থাকার বেশ সুবিধা ছিলো। অন্যদিকে এদিকটা রাস্তাঘাট ভালো না থাকায়, শত্রু পক্ষের লোকেরা সুবিধা করতে পারে নি।

প্রশ্ন-৭। যুদ্ধকালীন সময় বাঙ্গালী, পাহাড়ি, আদিবাসীদের মাঝে কোন পার্থক্য দেখেছিলেন? আর দেখে থাকলে সেগুলোকে কিভাবে দেখেছিলেন?
না, সেসময় বাঙ্গালী, পাহাড়ি, আদিবাসীদের মাঝে তেমন পার্থক্য ছিলো না। বাঙ্গালীদের দ্বারা আদিবাসীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতীত, শোষিত বঞ্চিত হচ্ছে তা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। বর্তমানে আমার পত্তনী জমির প্রায় কোনাবাড়ী বাজারে প্রায় দেড় একর জমি সরকারের দখলে। সেখানে পুকুর খনন হয়েছে, আর ইউনিয়ন কাউন্সিল সেটা লিজ দিয়ে রেখেছ। এ জমিটা আমার দখলে থাকলে আমাকে এতটা কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো না। আমার সন্তানদেরও জমিজমা কিছুই দিতে পারি নি।

প্রশ্ন- ৮। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আপনাদের কি কি সুবিধা দেওয়া হয়েছিলো?
ওরা আমাদের দুইবেলাই খাবার রুটি, ভাত, মাংস দিতো। কোন কোনদিন ফ্রুট, জুস থাকতো। আমি জুনথেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মাসিক ৫০টাকা বেতন পেতাম। আর এসব দিয়ে আমরা এলাকার অসহায় লোকদেরকেও সাহায্য করেছি।

প্রশ্ন- ৯। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এমন একটি ঘটনার কথা বলুন যা আপনাকে আনন্দ দিয়েছে
তখনতো আনন্দ করার সময় না। তবে, কমান্ডারের নির্দেশে আমরা যেদিন চীন দালবতকে মেয়ে সাজিয়ে গান গাইতে গাইতে নৌকায় যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের মনে যেমন শঙ্কাও ছিলো, তেমনই মেয়েরূপী চীনের নাচ দেখে মজাও পেয়েছি। শেষে সন্ধ্যার দিকে শত্রুদের ক্যাম্পের কাছিকাছি গিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে দিয়ে আসার পর সকালে যখন জানলাম সব শত্রু মরে গেছে, তখন আমাদের আনন্দ ১০ গুন বেড়ে গেল।

প্রশ্ন- ১০। বাংলাদেশ আজও আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিলো না। এখন যদি আপনাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, তখন কি অনত্র চলে যাবেন?
আমরাও জীবনকে বাজী রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে। তাহলে কেনো যাবো এ দেশ ছেড়ে। আমি এদেশেরই সন্তান, আমি এদেশের মাটিতেই মরতে চাই। আফসোস, দেশ স্বাধীন করেও আজও আমরা পরাধীন!

প্রশ্ন- ১১। সবশেষে আমাদের প্রজন্মের জন্য কিছু বলুন
আমরা যেমন নিজের জীবনকে বাজী রেখে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পরেছি, তেমনই তোমরাও জাতি ও সমাজের জন্য কিছু একটা কর। শিক্ষিত সমাজ হিসাবে গড়ে তোল; তবেই দেশের সকলেই সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে। ধন্যবাদ তোমাদের, ধন্যবাদ মানবিক গ্রুপ এবং গ্রামের প্রতিটি মানুষকে।

অসীম সাহসী বীর গারো মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমার সাথে আলাপ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছিলো। আমরা আসার আগে আরেকবার দেশের অবদানের জন্য উনাকে এবং উনার স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরাও বিদায় নিলাম।

পুনশ্চঃ আসুন আমাদের বাড়ি বা গ্রামের আশপাশে অভিমান নিয়ে বসবাসকারী কিংবদন্তী তুল্য এমন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট্ট পরিসরে হলেও সম্মানিত করি। সেল্যুট সকল মুক্তিযোদ্ধা! ধন্যবাদ পাঠকবৃন্দ, ধন্যবাদ সবাইকে।

ছবি ১- স্বস্ত্রীক মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা
ছবি ২- সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী ফিডেল ডি সাংমা
ছবি ৩- সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী দল
ছবি ৪- মুক্তিযোদ্ধার সনদ
ছবি ৫- - পত্তনীকৃত জমির কাগজ
ছবি ৬- পত্তনীকৃত জমি যেখানে এখন

সোমবার, ১০ মার্চ, ২০১৪

**অন্ধকার** (কিছুটা ১৮+)

**অন্ধকার**

- (বিঃদ্রঃ গল্পটি অতিরিক্ত লজ্জাশীল ব্যক্তিদের পড়া নিষেধ)-

(১)

বেলা পরে যাচ্ছে। চারিদিকে ফুরফুরে হাওয়া। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগছে। শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডায় নয়- উত্তেজনায়। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও সেকান্দর ঘেমে নেয়ে ওঠে। সেকান্দর ভাবে, সূর্য ডোবার সাথে সাথে মানুষের আশাও কি ডুবে যায়! অন্ধকারের মতোই কি মুছে যায় ভালোবাসার রঙ?

পাক্কা ১৫ বছর আগে সেকান্দর গ্রাম ছেড়েছে। টাঙ্গাইল, জামালপুর আর ময়মনসিংহ শহরের ঠিক মাঝামাঝি সেকান্দরের পৈত্রিকভিটা। পোড়খাওয়া পরিবারের দরিদ্র পিতার একমাত্র পুত্র সে। গ্রামের নাম চানপুর। গ্রামের নাম চানপুর হলে কি হবে, এ গ্রামের লোকজন চিরজীবনই অমাবশ্যার মধ্যে বাস করে যাচ্ছে। অর্থাৎ অন্ধকারে জন্ম নিয়ে অন্ধকারেই মরেছে। কারণ, এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই; নেই এলাকার লোকজনের মধ্যে শিক্ষা এবং সচেতনতা। এখানে বেশির ভাগ লোকের সর্বোচ্চ শিক্ষার মান হল- স্থায়ীভাবে ভাঙ্গা-আধচালার মকতবে ২ বছরের আরবি ও পাক কোরআন-এর কিছু প্যারা মুখস্ত পর্যন্ত। সেকান্দরের বাবার শিক্ষা-দীক্ষাও এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনিও মনে করেন, ৫ ওয়াক্ত নামাজের সময় আরবি আর দোয়া বলতে পারলেই মানুষের চলে যায়। তারপর, ক্ষেত-খামারের কাজে বাপ-দাদার কাছথেকে শিক্ষা নিয়ে সেটা কাজে লাগালেই জীবনটা পার করে দেওয়া যায়। এমন লোকদের সচেতনতা দান করার লক্ষ্যে একটি বেসরকারী সাহায্য সংস্থা কাজ করছে। আর ৩ বছরের মাথায় ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত প্রায়মারী স্কুল কোনরকমে চালিয়ে যাচ্ছে। পাশের গ্রামে একটা প্রাইমারী স্কুল থাকলেও, এ গ্রামের লোকজনের ধারণা, এতদূরে গিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করে পড়ার চেয়ে- নিজের ক্ষেত-খামারে কাজের মূল্যটাই বেশি। সেকান্দরের বাবাও তাই মনে করেন। এমন পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে এ গল্পের অবতারণা।

পৌষ মাস। এ সময় ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছুকদের পাশের গ্রামের স্কুলে ভর্তি করানো হয়। একাজটি চানপুরের শিক্ষকরাই করে থাকেন। প্রতি বছর পৌষ মাসে সবাইকে একসাথে নিয়ে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। সেকান্দরের ভাষায় আজ রাগী, বেরসিক আক্কেল আলী স্যারের পালা। ৭জন ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করার কথা। কিন্তু এবছর ১ম স্থান অধিকারিণী ময়না খাতুনের দেখা নেই। সেকান্দরের বাড়িথেকে ময়নার বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। বড় একটা খাল পেরোতে হয়, তবে বছরের বেশিরভাগ সময় এ খালের সাঁকো থাকে না। এই একমাত্র খালটিতে পানি যতই থাক; কারোর কাপড়ই ভিজে না। কায়দা ওদের জানা। পুরুষরা খালটি পারাপারের সময় লুঙ্গি তুলতে তুলতে আর নামাতে নামাতে পার হয়। আর মহিলাদের পারাপারের জরুরী মনে হলে এর সাঁকো ঠিক হয় আর বাকীটা সময়ে ভাঙ্গাই থাকে। আক্কেল আলী স্যার অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে বললেন, কিরে সেকান্দর- ময়নাদের বাড়ি তোদের বাড়ীর কাছে, অথচ ময়নারে ডাইকা সাথে নিয়া আসতে পারলা না? তুই নাহয় এক ক্লাশ উপ্রে পড়স, এইটুক সহানুভূতি দেখাইতেতো পারতা। নাকি মিছা কইলাম? সেকান্দর উত্তর দেয়, স্যার, ময়নার মায় আঙ্গর বাড়ি আইছিলো। কয়ছে, মাইয়া ডাঙ্গর অইয়া গেছে। ভিনদেশে পড়বার দিবো না। বালা সমুন্দ আইলে বিয়া দিয়া দিবো।
-      ছিঃ ছিঃ এইডা কি কথা। সেদিনইতো ওদের বাড়ি গিয়া আলাপ পাইড়া আইলাম।
-      হ স্যার। আমার আম্মাও বুঝায়া দিছে-
-      থাইক, তর হিস্টোরি শুইন্যা দেরী করন যাইবো না। লও- তুই আর আমি দুইজনে যাইয়া ময়নারে নিয়া আসি। বাকীরা তোমরা আগাইতে থাক-
স্যারের এমন আদিখ্যেতা পছন্দ হল না। ওরে আমার বাসায়া (অপেক্ষা করে) আনন নাগবো, এত ঠ্যাকা ক্যাকথাটা বলতে ইচ্ছে করছিলো সেকান্দরের। তার ধারণা- সেও চালু পোলা।

স্যারের উচ্চতা অনেক বেশি। লম্বা লম্বা পা। তাই তার পেছন পেছন হাঁটা মানে হাঁটা নয়; প্রায় দৌড়ের কাছাকাছি। সেকান্দর রাগে গজ গজ করলেও বাধ্য ছেলের মতো স্যারের পেছন পেছন হাঁটে।
-      সেকান্দর তুই ওদের বাড়ি যা। গিয়া ময়নারে নিয়া আয়। ওর বাপমায় না ছাড়বার না চাইলে, কইবা- ময়নার জন্যে এত ভাবতে হয়বো না।
-      তারপরেও যুদি না ছাড়ে-
-      তারপরেও যদি না ছাড়ে, কইবা- স্যার খাল পাড়ে ময়নার অপেক্ষায় খাড়ায়া আছে।
-      স্যার, সাঁকো বাঙ্গা। পানি মুন্নয় আমার কোমরের উপ্রে অবো
-      তাতে কি, নাইম্যা পানি ভাইঙ্গাই যা। লুঙ্গি পরছস অসুবিধা নাই। ডরেরও কিছু নাই, শরমেরও কিছু নাই। পানি বেশি অইতে থাকবো, তর লুঙ্গি তুলতে তুলতে যাবা। আর পানি কমতে থাকবো, তুইও লুঙ্গি নামাইতে থাকবা। কেউ দেখবো না- এই আমিও ঘুইরা খাড়াইলাম।
আক্কেল আলী স্যার সেকান্দরের প্রত্যুত্তরের প্রয়োজন মনে করছেন না, তবে ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছে। শীতকাল। তার উপর এ খালের পানি সবসময়ই ভীষণ ঠাণ্ডা থাকে। পানির ছরছর করা আওয়াজটা বলছে- সেকান্দর পার হয়ে যাচ্ছে। তিনি পেছন ফিরেই সিগারেটের মাথায় দিয়াশলায়ের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চিন্তা করিস না সেকান্দর। কাইলই এখানে একটা সাঁকোর ব্যবস্থা করে ফেলবো।
স্যার, এম্মুরা (এদিকে) তাকাবাইন না, আমি শরম পামু...। .ছেলেটা মালকোঁচা দিয়ে নেমেছিলো। এবার খুলেছে বোধয়; হয়তো ছেলেটা আগেথেকে পানির গভীরতা আন্দাজ করতে পারে নি। পোলাপান মানুষ, এখনই তোর শরম কিরেবলতে বলতে আক্কেল আলী স্যার আবার সিগারেটে মনযোগ দেন।

সিগারেটটা শেষ হবার আগেই সেকান্দর ওপারথেকে বলছে, স্যার একটা বাঁশ নিয়া আইছি। এইটা ফালায়া দরলেই ময়না পারয়া যাইতে পারবো। স্যার, বাঁশের ঐ মাথায় আপনের একটু দরন নাগবো। আচ্ছা, ভালা কাম করছস। বাঁশের মাথাটা এপারে আগায়া দেও, আমি ধরি। কিরে ময়না তরে মায় ছাইড়া দিল?’ সেকান্দর বাঁশটা আড়াআড়ি রাখার পর ময়না কিছু দূর এগিয়ে আসে। কিন্তু মাঝখানে এসে বাঁশটাএখন ভীষণ দুলছে। ময়না ভয় পাচ্ছে দেখে আক্কেল আলী স্যার বলেন, সেকান্দর তুই পানিতে নাইম্যা যা। বাঁশের মাঝখানে ধইরা থাক। মাঝখানের পোতা বাঁশটা দুর্বল অইয়া গেছে মনে হয়। .বাঁশের আরেক মাথা ছেড়ে দিয়ে সেকান্দর লুঙ্গিটা ছোট করে কোমরে গিঁট দেয়। তারপর পানিতে নেমে মাঝখানে ধরে রাখে। তবে, উপকার করতে গিয়ে হয়েছে আরেক বিপদ। বাঁশ আর ময়নার ভারে সেকান্দরের কিছুক্ষণ আগের হাসি মুখ ভোঁতা হয়ে গেছে। ভারে আর বিরক্তিতে সেকান্দর মুখ কুঁচকায় আর দাঁত কটমট করতে থাকে।

ময়না পার হয়ে আসার পর সেকান্দর বাঁশটা ওপারে রেখে নিজেও পার হয়ে আসে। পায়ে কাদা লাগাতে ধোয়ার জন্য ময়না পারে দাঁড়িয়ে পা চুবিয়ে নিল। সেকান্দরেরও লুঙ্গির অর্ধেক অংশ ভিজে গেছে। তাই সেকান্দর লুঙ্গিটা তুলে ছিপে পানি বের করতে থাকে। কাপড়টা একটু সাবধানে তোল বাপসেকান্দরের অবস্থা দেখে আক্কেল আলী স্যার না বলে পারলেন না। কৌতুহল ছিল না, তবু স্যারের বলার সাথে সাথে ময়না সেকান্দরের দিকে তাকায়। ওর জিনিসটা ঠাণ্ডায় জমে এই এতটুকুন হয়ে গেছে দেখে-  ফিক করে হাসে ময়না। ময়নার দিকে তাকিয়ে সেকান্দরের কানটা ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। তারপরথেকে লজ্জায় সারা রাস্তায় দুজনের চাওয়া-চাওয়ি কথাবার্তা বন্ধ।

(২)

-      বহ দোস্ত বহ। কি খবর। ম্যালাদিন কোন খবর নাই। আইজ এতদিন পর হুট কইরা আসলা-
-      হ। তরা কিবা আছ? আর চাচা-চাচি ওরা?
সেকান্দরের কথা শেষ না হতেই শৈশবকালের বন্ধু আবু তালেবের মুখে কথার তুফান বইতে লাগল। আবু তালেবের ছোটবেলাথেকেই সে একই স্বভাব। কথার মাঝখানে কখন দম নেয়, ঠিক বুঝা মুশকিল। সেকান্দর সুযোগ খুঁজে কখন, কিভাবে ময়নার কথা পারবে। বেকুবটা নিজেথেকে বলছেও না। দোস্ত ভাবীরে কও এক গ্লাস পানি দিতে। গলাটা শুঁকায়া গেছেভাবী কও ক্যা, ফরিদা। হ, হেই ফরিদা খাতুন। যার পিছে ম্যালাদিন নাইগ্যা (লেগে) আছিলাম’- সেকান্দর হাসে। ও তাই? শ্যাষমেশ তুই ফরিদারেই-। .সেকান্দরের কথা শেষ না হতে বলে, ‘খালি বিয়া না, তিনডা বাইচ্চার জরম দিসি। .আবু তালেব বিজয়ীর মত হাসে। ‘‘ও গেন্দির মা- দোস্তের নিগা এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি দিয়া যাও। বুচ্ছো ভাই, মাইনসে যখন কয় বসন্তকাল, তখন আমি কই চৈতমাস। কপাইল্যাগর মনে জাগে প্রেম, আর আকপাইল্যাগর শুকায় গলা, হা হা হা। তাইলে দোস্ত, তুই একটু জিরা, তারপর হাত-মুখ ধুইয়া আহ, হাল্কা নাস্তা খাবা। আর ততক্ষনে আমি কয়ডা কাঁচা বাজার কইরা, গরুডাও নিয়া আহি- বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় আবু তালেব। তারপর কিছুটা ঝুঁকে লুঙ্গির উপর দিয়ে কচকচ করে চুলকোতে থাকে। সেটা দেখে সেকান্দরের বিরক্তিটা গিয়ে পরে লুঙ্গিটার উপর। বিরক্তির কারণ তার সেই ছোটবেলার লুঙ্গি কাহিনী। যে ঘটনা সেকান্দরকে এখনও ভীষণভাবে বিব্রত করে, লজ্জা পায়। কাহিনী আরও আছে; প্রথমতঃ লুঙ্গি পরে ঘুমানোর পর সকালে সে লুঙ্গি খুঁজে পায় তার গলায়, আর নাহয় খাটের তলায়। দ্বিতীয়তঃ লুঙ্গি পরে হাঁটলে তার নিচের দিকটা ভীষণ খালি খালি লাগে। তখন মনে হয়, আশপাশের সব লোকজন বোধয় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তৃতীয়তঃ মাঝে মধ্যে মাছেরা যেমন পানির ভেতরে থেকে শ্বাস নেওয়ার জন্য হা করে উপরে মাথা বের করে, লুঙ্গি পরে বসলে তার জিনিসটাও ওরকম করে বলে মনে হয়। তাই বাধ্য হয়ে সেকান্দরকে তার লুঙ্গিটা সবসময় চেপে ধরে থাকতে হয়। একারণে ঢাকা শহরে যাওয়ার পরথেকে লুঙ্গির উপর ক্ষ্যাপা সেকান্দর পারতপক্ষে শুধু প্যান্টই পরে।
তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আর ভায়ের জন্য বড় দেইখ্যা একটা মাছ নিয়া আইবেনবলেই একহাতে গ্লাস আর আরেকহাতে জগে ভরা পানি নিয়ে এসে সামনে এসে দাঁড়ায় ফরিদা। পানির জন্যে হাত বাড়াতে বাড়াতে সেকান্দর বলে, কিরে ফরিদা। তুমিতো দেখছি আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছ। বিয়াশাদী করলে সব মাইয়াই এমন সুন্দর হয়? ফরিদা হাসে। কি খবর বোইন, তরা ভালো আছ?
-      হ বড় ভাই। আপনি কেমন আছেন?
-      এইতো যা দেখতাছ। বলা যায়, ভালোই আছি।
-      আপনিতো ভালোই আছেন, আর ময়নার খবর রাখছেন কিছু?
-      নারে, বলতে পারস- তোদের সবার খোঁজ লইতেই আমার গ্রামে আসা-
-      ময়না কেমনে ভালো থাকবো কন। সেই যে আপনারা সবাই চইলা গেলেন, আর আইলেন না। এদিকে ময়না চোখের পানি ফালাইতে ফালাইতে গাং বানায়া ফালাইলো। আহারে ছেরিডা-
-      কেন ফরিদা, ময়নার কি হয়ছে?
কথাটা বলেই সেকান্দরের বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপতে থাকে। যার জন্যে এতদূর ছুটে আসা- সে কি নিষ্ফল হয়ে ফিরে যাবে? সেকান্দরের মনে পরে, প্রায় ১৫ বছর আগে বাবার সাথে সে গ্রাম ছেড়েছে। অবশ্য সে দায় সেকান্দরের নয়; বাবা এবং চাচাদের। দাদুর মৃত্যুর পর খালের পানিতে বাড়ি-ভিটাটাও ভেঙ্গে গেল। তারপর বাবা-চাচাদের সাথে পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে। সেদিনথেকে বাবা অভিমান করে গ্রাম ছেড়ে সবাইকে ঢাকায় গেছেন। ছোট্ট মুদির দোকান খুলে সংসার শুরু করেছেন। চাচাদের সাথে জিদ করে বাবা নিজেও গ্রামে আসেন নি, আর কাওকেই আসার নাম পর্যন্ত নিতে দেন নি। একারণে প্রচণ্ড টান আর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেকান্দরের গ্রামে আসা হয় নি। সেকান্দরকে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার পর পাশ করতে করতে এবার সে বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। তাই বাবার কাছে অনেক অনুরোধের পর এবার গ্রামে আসার সুযোগ পেল।
-      হেতে আর কেমুন থাকবো ভাই।
-      ক্যান, কি হয়ছে?
-      হওনের আর কি বাকী আছে বড় ভাই। আপনেগর শহরে চইল্যা যাওনের পরথিকা ময়না পত্যেকদিন ইস্কুলে যাওয়া-আসার সময় একবার কইরা আমগর বাড়িত আয়তো। খালি আপনের কতা জিগায়তো আর গুফনে চোখের পানি ফালায়তো। আহারে ছেরি! হেরে দেইখ্যা মাজে-মইদ্যে আমার মনে অয়তো, হের দম বুজি আইটকা যায়-
ফরিদার কথাগুলো শুনতে শুনতে সেকান্দর ঘোরের মধ্যে চলে যায়। হাইস্কুলে পড়ার ২ বছরের মাথায়; একদিনের কথা মনে করে সেকান্দর। সেদিন স্কুলথেকে ফেরার সময় ময়না তার সামনেই সাঁকো পেরোতে গিয়ে ঝুপ করে পানিতে পরে গেল। তার জানা ছিলো না গ্রামের মেয়ে হয়েও ময়না সাঁতার জানে না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সেকান্দর কিছুক্ষণ থেকে সেও পারে বই ছুঁড়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পরল। পানিথেকে টেনে হিঁচড়ে ময়নাকে যখন ডাঙ্গায় তুলল, তখন ময়না দাঁড়িয়ে মাথাটা নীচু করে সামনে ঝুঁকে ভয়ে কাঁপছে। লজ্জারাঙা মুখে পুঁটি মাছের মত খাবি খাচ্ছে। অনেকদিন আগে সেকান্দরের জিনিসটা উন্মুক্ত হবার পর ময়নার দিকে ভালো করে কোনদিন তাকায় নি পর্যন্ত। আজ ময়নাকে সে খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে; এবং এ মূহুর্তে ময়নাকে তার নতুন মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন মনে হচ্ছে? জলপরিরাও এমন সুন্দর হয় কিনা গল্প বইয়ের পোকা সেকান্দর জানে না। লাল-নীল পরীরা দেখতে কেমন, তা কোনদিন কল্পনাও করে নি সে। মৎস-কন্যারাও কি পানিতে ভিজে? কিন্তু ময়নার সারা শরীর ভিজে চুপসে গেছে। ভাগ্যিস কয়েক ঢোক পানি গিলেই রক্ষা হয়েছে, নাহলে কিযে হতো কে জানে। ময়নার সালোয়ার-কামিজ বেয়ে টপ-টপ করে পানি ঝরছে। তখন পশ্চিমের সূর্যটা কোনভাবে ঝুলে থেকে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। আ-আমার ও-ওড়নাটা কই-ময়না কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে। চমকে গিয়ে সেকান্দর এদিকওদিক তাকায়। একসময় দেখে দূরে- খালের মাঝপানিতে ভেসে যাচ্ছে ময়নার আবরন।

(৩)

গেন্দির মা, বাজারে তেমন কিছু পাওয়া যায় নায়। নেও সদাইগুলা ধর। দোস্ত হারাদিন কিছু খায় নায়। তাড়াতাড়ি রাইন্দালাও। আমি গরুডা গোয়ালে তুলিবলেই আবু তালেব তার কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে। ফরিদা যখন বাজারের ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল তখন আবু তালেব ফিসফিসিয়ে বলে, ‘দোস্ত ময়নারে খবর দিয়া আইছি। খালপাড়ে আহনের কতা। সাবদানে যাও, ফট কইরা দেহা কইরা আস
কথাগুলো শুনেই সেকান্দরের সারা শরীর আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যেন ঐশ্বরিক বলে শক্তি ফিরে পেল। এখনই যাবো?’ ‘না, একটু পরে যাও। ওর আইতে দেরিও অইতে পারেবলেছিল আবু তালেব কিন্তু সেকান্দরের তর সইল না। তাই সে হিসু করার অজুহাতে বেরিয়ে পরল।

খালপাড়ে চলে এসে দেখে কোথাও কেউ নেই, চারিদিক কেমন খা-খা; শুন্যতা। ময়না আসলে কি হবে, আর কথাটা কিভাবে বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এলোপাথাড়ি ভাবতে ভাবতে সেকান্দর গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে পরে। ক্লান্ত শরীর। বেশ কয়েকদিন যাবত সে অসুস্থ্য ছিল। তার উপর সারাদিন খাওয়া নাই। এখন সেকান্দরের শরীরটা হেলে পরতে চাইছে। গাছের গোড়ায় হেলান দেওয়ার পর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। খালপাড়ের চারিদিক হিম শীতল বাতাস বইছে। সেকান্দর ভাবে, এসব কাজে পৃথিবীর কোন মানুষকে যেন এভাবে অপেক্ষা করতে না হয়। কী নির্মম এই অপেক্ষার সময়টা। তর সইছে না, তবুও কেমন ঘোরের নেশায় পেয়ে বসে সেকান্দরকে।

ঐতো খালের ওপারে ছায়ামানবী ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। হ্যাঁ ময়নাইতো। খুব সাবধানে এদিকওদিক তাকিয়ে সামনে পা ফেলছে। হাঁটার সময় ময়নার শরীরটা যেভাবে দোলে, তা সেকান্দরের চেনা। এখন সেভাবেই শরীরটা দুলছে আবার থামছে। দুলছে আবার থামছে। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে, আবেগে সেকান্দরের মন থৈ থৈ করতে শুরু করল। আবার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ছেলেবেলার সেই ঝকঝকে দৃশ্যগুলো। লুঙ্গি পরা সেকান্দর খালের মাঝপানিতে নেমে সাঁকোর এক পা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরী ময়না তার ফর্সা, আলতারাঙা পায়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। সেকান্দরের কাঁধের উপর দিয়ে খুব সাবধানে সাঁকো পার হয়ে আসছে ময়নার পা দুটো। কিন্তু ময়নাকে আজ বাতাসের মত কেমন হালকা মনে কেন? ভালবাসলে কি মানুষের শরীর হালকা মনে হয়! নাকি ময়নাই ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে চাইছে না বলে নিজের ভারটাকে হালকা করে দিচ্ছে। এ কি কখনও সম্ভব? আবার দেখে সেকান্দর, বোঝার চেষ্টা করে। ঠিকইতো! ময়না তার কাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। না, কোন কষ্টই হচ্ছে না তার, বরং নিজেকে খুবই নিষ্ঠাবান, দায়িত্ববান অভিভাবকের মত মনে হচ্ছে। যাকে সেকান্দর ভালোবাসে, আজ সে মাথাথেকে শুরু করে বুকের উপর দিয়ে হেঁটে গেলেও বোধয় কোন কষ্টই হবে না তার। সেকান্দর বোঝার চেষ্টা করে, চোখের পলকে ময়না যেন ভয়াবহ সাঁকোটা নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেল।

সেকান্দর কোনদিন যা করে নি, আজ সে তাই করল। সে ময়নার হাত ধরে পাড়ে নিয়ে এসে দুজন দুজনার খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি দাঁড়ায়। দুজনই দুজনার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ভালোবেসে যে সীমাহীন শান্তি, এতোটা তৃপ্তি; ভাবতেই পারে নি সেকান্দর। কারো মুখে কোন কথা নাই। ওদের কথা হয় শুধু চোখের ইশারায়, মনের ভাষায়। আজ যেন জন্ম-জন্মান্তরের একই অঙ্গ, একই মন, একই আত্মায় আবদ্ধ। তারপর অক্টোপাশের মত ওরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে কতক্ষণ ছিল; কেউ জানে না।

সেকান্দরের হঠাৎ মনে কেন মনে হল- সারাপৃথিবী দুলে দুলে উঠছে। প্রচণ্ড বেগে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝর বয়ে যাচ্ছে। চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। আর খুব ক্ষীণ স্বরে, দূরে- বহুদূরে কেউ যেন তার নাম ধরে সে-কা-ন্দ-র, সে-কা-ন্দ-রবলে ডাকছে। হ্যাঁ, ঠিকইতো। এইতো, এখন প্রায় স্পষ্টই সে শুনতে পাচ্ছে- সেকান্দর, এই সেকান্দর। দোস্ত, এই দোস্ত- তাড়াতাড়ি ওঠবলে আবু তালেব ডাকছে। সাথে সাথে তাকে ধরে ঝাঁকুনিও দিচ্ছে। ঘোরের মধ্যেই সেকান্দর কিছু বুঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোন কথা মুখ ফুটে বের হচ্ছে না। সোজা হয়ে বসার চেষ্টা সে করল, বুঝার চেষ্টা করেই যাচ্ছে সে। তার কি হয়েছে? সেই কি ঘুমিয়ে পরেছিল? অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেকান্দর কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। নির্বাক, শুধু ফ্যালফ্যাল করে আবু তালেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবু তালেব আবার বলে, দোস্ত- তর কি হয়ছে? তরে এত ডাকতাসি। তুই এইহানে এত ঠাণ্ডার মইদ্যে ঘুমায়া আসস ক্যা? আর ওইদিকে কি অইছে জানস? তর কাছে আসনের সময় ময়নারে ওর স্বামী ধরছে। আর তারে টাইন্যা হ্যাঁচড়ায়া বাড়িত নিয়া মাইর-ধর কইরা হেষে গলা টিইপ্যা মাইরালাইছে।


হঠাৎ সেকান্দরের মনে হচ্ছে, চারিদিকে ঠাঠা শব্দ করে এইমাত্র মাথায় বজ্রপাত হয়ে গেল। সেশব্দে স্পষ্ট কোন কথা শোনা যাচ্ছে না, কোন কথার কোন মানে বুঝা যাচ্ছে না। আবু তালেবের কথাগুলো ধীরে ধীরে ক্ষীণথেকে ক্ষীণতর হচ্ছে, সারা পৃথিবী সীমাহীন অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে ...