হিন্দু ধর্মাবলম্বী গারোদের বিবাহ পদ্ধতি
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ৭ প্রকারের বিবাহ পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, ইত্যাদি। তন্মধ্যে প্রজাপত্য বিবাহ পদ্ধতিটিই এখন বেশি প্রচলিত। সেধারায় গারো হিন্দুদের মধ্যেও এই প্রজাপত্য বিবাহটাই বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের গারো হিন্দুদের বিবাহ পদ্ধতিটি নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-
১) বিবাহের পূর্ববর্তী ক্রিয়াদি- ছেলে বিবাহের উপযুক্ত হলে ছেলে এবং অভিভাবকের পক্ষে কয়েকজন মিলে মেয়েকে দেখতে যায়। মেয়ে দেখে পছন্দ হলে মেয়ে পক্ষও ছেলের সম্পর্কে জানতে এবং ছেলের পারিবারিক অবস্থা ও আত্মীয়স্বজনদের দেখতে চলে আসে। উভয় পক্ষই যদি এই বিবাহতে সম্মতি থাকে তাহলে বিবাহের কাজ যেমন পণ নিয়ে আলোচনা, লগ্ন দেখে বিবাহের তারিখ বা সময় নির্ধারণ এবং বিবাহের যাবতীয় কেনাকাটা হতে থাকে।
২) বিবাহের জন্য হবুবরকে সাজিয়ে বিবাহের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে প্রায় ৫০ থেকে ২০০/৩০০ জন পর্যন্ত লোক কনেবাড়িতে যায়। কনেপক্ষ তাদেরকে আপ্যায়ণের পর হবুবরের বসার জন্য নির্ধারিত ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেখানেই বরকে বিবাহের পোষাকে পরানো করা হয়। এদিকে অন্যঘরে মেয়েকেও বিবাহের পোষাক অলংকারাদি দিয়ে বউ সাজানো হয়। আর এরইমধ্যে বিবাহ মণ্ডপের জন্য চারটি কলাগাছে চারকোণায় দিয়ে ফুল, পাতা ও আল্পনায় সুন্দর করে সাজানো হয়।
৩) লগ্ন ঘনিয়ে আসলে হবুবরকে ঘরথেকে পিঁড়িতে বসিয়ে বিবাহ মণ্ডপে নিয়ে এসে বরকে মণ্ডপের মাঝখানে দাঁড়ানোর পর হবুবঁধুকেও পিঁড়িতে বসিয়ে দুটো বড় পান দিয়ে মুখ ঢেকে বিবাহ মণ্ডপে আসা হবে। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় শুভদৃষ্টি। এসময়ে প্রথমে কনের পিতা বা অভিভাবক বরের হাতে কনেকে সম্প্রদান করেন। তারপর নববঁধুর বহনকারীরা বিয়ের পিঁড়িতে বসা অবস্থায় বঁধুকে নিয়ে বরের অর্থাৎ বিবাহ মণ্ডপের চারিদিকে ৭বার প্রদক্ষিণ করবে। প্রদক্ষিণ করার সময় প্রত্যেকবারই হবুবঁধু বরের কপালে এবং মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে বরকে বরণ করে নিবে।
৪) বিবাহ মণ্ডপ প্রদক্ষিন সম্পন্ন হবার পর বর ও বধূকে মুখোমুখি বসিয়ে দুজনের হাত কাশপাতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হবে, সেসাথে বরের ধূতির সাথে বঁধুর কাপড়ের আঁচলে বেঁধে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হবে। তারপর ঠাকুর, বর ও বধু তিনজন মিলে বিবাহের মন্ত্র পাঠ করতে থাকবেন এবং জলন্ত আগুনের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে বর নিজহাতে বঁধুকে শাঁখা ও সিঁদুর দান করবে। বর ও বঁধুর বিবাহিত জীবনের মঙ্গল কামনা করে সমবেত জনতার তুমুল করতালি এবং উলুধ্বনির মাধ্যমে প্রথম দিনের মূল বিবাহ অনুষ্ঠান আপাতত এপর্যন্ত।
৫) পরেরদিন আরও কিছু বিবাহের আচার পালন করতে হয়, যাকে বলা হয় বাসিবিয়া বা বাসি বিবাহ। এজন্য বিবাহ মণ্ডপে প্রায় দেড় বর্গফুট পুকুরের মত গর্ত করে সেখানে পানি দেওয়া থাকে। বরবধূ দুজনের আংটি খুলে সে পানিতে একেকজন করে লুকাবে এবং কে দ্রুত সেটিকে খুঁজে বের করতে পারে সেটি পরীক্ষা করা হয়। কাজটি হয়ে গেলে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বরকে তার নববঁধুর আঁচলে মোট ৭টা পান এবং ৭টা সুপারি কনের আঁচলে বেঁধে দিতে হয়। বর নববধূকে কোলে নিয়ে এই লাফ দিয়ে এই পুকুর ডিঙ্গাতে হয়। পুকুর ডিঙ্গানোর পর ঠাকুর বরবধূর হাতধরে দুধ ঢেলে মন্ত্র পড়ে দম্পতিকে আশীর্বাদ করেন। তারপর বর মণ্ডপে রাখা ঘট বা হাঁড়ি আছড়িয়ে ভেঙ্গে পানি ফেলে দিতে হয়। সেখানথেকে কাঁদা তুলে যুবকযুবতীরা পরস্পর মাখামাখি করে আনন্দ করে। এরপর কনেপক্ষ সবাইকে বিবাহভোজে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
৬) এবার বঁধুর বিদায়ের পালা। এপর্বে আগেই বঁধুর আঁচলে কিছু চাল বেঁধে রাখা হয়। বিদায়ের সময় আচলথেকে সে চাল নিয়ে মাথার উপর দিয়ে পেছনে তার মাবাবার উদ্দেশে ছুঁড়ে এই নাও তোমাদের ঋণ শোধ করে গেলাম।
৭) বরের বাড়িতে উপস্থিত সকলেই উলুধ্বনি দিয়ে ধান দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বঁধুকে বরণ করে নেওয়া হয় এবং সেসাথে আরও কিছু আচারসহ কালরাত্রি পালিত হয়। অর্থাৎ এদিন দম্পতিদের বাসরশয্যা নিষিদ্ধ।
8) ফিরাগমনের দিন বরকনে এবং বরপক্ষের লোকজন শ্বশুরবাড়ি যাবে এবং ঐদিনের ভোজের সকল খরচ বরকে দিতে হয়। সেখানে আড়াইদিন অতিবাহিত করে বর স্ত্রীকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে।
গারো মুসলিমদের বিবাহ পদ্ধতি ও আচার
প্রথমেই বলে নেওয়া প্রয়োজন, গারো নও মুসলিমরা নিজেদের গারো বলে প্রকাশ করতে চান না; বরং বাঙালি হিসাবেই পরিচিত হতে চান। আর বৃহত্তর বাঙালি মুসলিমদের মাঝে মিশে যেতে আগ্রহী বলে গারো নও মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিবাহ প্রায় ৯৯% বাঙ্গালি মুসলিমদের সাথে হচ্ছে। অবশ্য নও মুসলিমদের নিজ সম্প্রদায়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিবাহ না হওয়ার বড় একটা কারণও রয়েছে; তা হলো- এই গারো সমাজ থেকে বের হয়ে আসা নও মুসলিমরা বাঙালি মুসলিম সমাজের মতো চাচা/কাকাত ভাইবোনের মধ্যে বিবাহকে (গারোদের ভাষায় এইটি মাদং বা বাকদং; দ্রষ্টব্য- মাদং, বাকদং, পৃষ্টা- ) মেনে নিতে পারেন না। ফলে বাধ্য হয়েই বাঙালি মুসলিমদের সাথে সম্পর্ক গড় তুলছে। সেকারণে এই নবু মুসলিমদের চেহারাতেও প্রায় বাঙ্গালিয়ানা চলে এসেছে। গারো সমাজের লোকদের মতোই এই নও মুসলিম পুরুষদের মধ্যে যখন তখন বিভিন্ন অজুহাত/কারণ দেখিয়ে তালাক দিতে বা বহুবিবাহ করতে দেখা যায় না। এছাড়াও বৃহত্তর বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রচলিত যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক সম্পদের উপর পুরুষদের একচ্ছত্র অধিকার ইত্যাদি প্রথাগুলো স্বাভাবিকভাবে মানতে পারেন না গারো সমাজথেকে বের হয়ে আসা এই নব্য মুসলিম সমাজ। শুধু তাই নয়, এই নব্য মুসলিমরা মুখে গারো পরিচয় না দিলেও তাদের আচারে এখনও কিছু কিছু গারোত্ববোধ লক্ষণীয়। কেননা, এই নব্য মুসলিমরা এখনও বৃহত্তর গারো সমাজে পারিবারিকভাবে নিকটাত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে এখনও নিজগোষ্ঠী বা মাহারিদের বিবাহ বা শ্রাদ্ধতে গারোদের মতোই গিম্মিন/গুম্মুম (শূকরের পরিবর্তে ছাগল) নিয়ে স্বপরিবারে অংশগ্রহণ করেন বলে স্বীকার করেছেন। (দ্রষ্টব্যঃ গিম্মিন/গুম্মুম, পৃষ্ঠা...)। প্রকারান্তরে, বৃহত্তর গারো সমাজ বা খ্রিষ্টানদের সাথে তাদের কোন প্রকার ক্ষোভ, আক্ষেপ, হিংসা, দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ নেই বলে জানা যায়।
এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। গারো মুসলিমদের বিবাহ পদ্ধতি অন্যান্য বাঙালি মুসলিমদের মতোই। একারণে এ নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করছি না। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে এই- প্রথমে ছেলে এবং ছেলেপক্ষের লোক মেয়েকে দেখতে যায়, পছন্দ হলে মেয়ে পক্ষরাও ছেলের বাড়িতে আসে। তারপর উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে কাজী ডেকে এনে দেনমোহর ধার্য করে কাবিননামায় স্বাক্ষর প্রদান করতে হয়। তারপর উভয় পক্ষ মিলে দিন নির্ধারণ করে বরকনেকে সুরা পাঠ ও মোনাজাত করার মাধ্যমে বর-কনে উভয়কেই স্বামী স্ত্রী হিসাবে স্বীকার (কবুল) করানো হয়। খাওয়া-দাওয়া শেষে নববধূকে নিয়ে বরযাত্রী বরের বাড়িতে চলে আসে। অন্যান্য বিবাহ অনুষ্ঠানের মতোই এই নব্য মুসলিমদের অনুষ্ঠানে বৃহত্তর বাঙালি মুসলিমরা নিমন্ত্রিত হন এবং উপহার সামগ্রী প্রদান করে বিবাহভোজে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে প্রচুর আমোদ ফুর্তি করে থাকে। এছাড়াও নব্য মুসলিমরা বউভাতের দিনে গারো সমাজ থেকে তাদের নিকটাত্মীয়দের নিমন্ত্রণ দিয়ে থাকে।