চ) গারো সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং ব্যবস্থাপনা : গারোদের আ.খিম (বা খিম) প্রথানুসারে পারিবারিক এবং গোষ্ঠীগতভাবে কোন নারী অথবা পুরুষের বিবাহের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর হবু বর-বধু কেউই আর ইচ্ছা স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে না। এমনকি তাদের উভয়ের পরিবারও ইচ্ছা করলেই বা অসমাধানযোগ্য কোন কারন ছাড়া বিবাহদানের চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে না, তেমনই ইচ্ছামত অন্য কাউকে বিবাহ করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার আগেও হবুবর-বধুর কেউ যদি মারা যায়, অথবা বিবাহের পরও যদি কেউ মারা যায়- তাহলেও এই আখিম প্রথার আওতায় পড়বে। (দ্রষ্টব্যঃ আ.খিম প্রথা, পৃঃ নং ...) এ আখিম প্রথানুসারে, মৃত স্ত্রী অথবা স্বামীর গোষ্ঠী থেকে অন্য মেয়ে অথবা ছেলেকে প্রদান করা বাধ্য এবং দ্বিতীয় পক্ষের তা গ্রহণ করা বা মেনে নেওয়া কর্তব্য। এই নীতিমালা ভঙ্গকারীকে দোষী সাব্যস্ত করে অর্থদণ্ড করা হয়। অর্থাৎ যদি এক পক্ষের স্বার্থজনিত কারণে বাগদান বাতিল হয়ে যায় এবং বাতিলের কারণ অস্পষ্ট অথবা অপর্যাপ্ত হয় তবে যে পক্ষ বিবাহ বাতিলে আগ্রহী সেই পক্ষ অন্য পক্ষকে মানহানি বাবদ জরিমানা প্রদানে বাধ্য থাকবে। তবে, অনিবার্য কারণবশত বা অসমাধানযোগ্য কোন কারণে উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে বিবাহ চুক্তি বা বাগদান এবং বিবাহ বাতিল হয় তবে কোন পক্ষকেই জরিমানা দিতে হবে না। অবশ্য কিন্তু যেহেতু তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি সেহেতু আখিম্ আইনের জরিমানা প্রদান করতে হবে না।
অতএব, গারো সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রচলন রয়েছে; তবে তা আখিম আইনের আওতায় হতে হবে। সাধারণত, স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের লোকজন পারস্পরিক সম্মতিক্রমে সামাজিকভাবে বিচার সালিশের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা বেশ কজন প্রবীণ এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। যেসমস্ত কারনে গারোদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে থাকে, তা নিম্নরূপ-
·
হবুবর-বধূর কেউ যদি বিবাহের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে।
·
হবুবর-বধুর যদি অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
·
বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর কেউ যদি পলায়ন করে বা দীর্ঘকালিন সময় নিরুদ্দেশ থাকে।
·
পলাতক স্বামী বা স্ত্রী যদি অন্যত্র বিয়ে করে।
·
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ যদি সংসার কর্মে অলস, উদাসীন থাকে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
·
স্বামী যদি স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণে অস্বীকার করে।
·
স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি বারবার পরকীয়ায় লিপ্ত থাকে এবং সংশোধন না হয়।
·
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি দীর্ঘকালিন সময় বনিবনা না থাকে, এবং এটি যদি কোনভাবেই সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।
·
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি দৈহিকভাবে কারোর দুরারোগ্য সমস্যা বা রোগব্যাধি থাকে (এটি খ্রিষ্টানদের জন্য প্রযোজ্য নয়)।
·
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি অসামাজিক কার্যকলাপ যেমন চোর, ডাকাতি অথবা এমন কোন অন্যায় বারবার করতে থাকেএবং এটি যদি কোনভাবেই সংশোধন হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।
·
উপরোক্ত কারণসমূহের কারণে স্বামী-স্ত্রীপক্ষের কোন পক্ষ যদি সমাধানে এগিয়ে না আসে অথবা সামাজিক সিদ্ধান্ত অনুসারে শাস্তি, জরিমানা প্রদানে অস্বীকার করে- তাহলে কলহ অব্যাহত থাকতেও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটতে দেখা যায়।
ছ) বিধবা বা বিপত্নীকদের জন্য ব্যবস্থা : গারো সমাজে ভিক্ষুক নাই বা থাকে না বললে অন্যান্য জাতির লোকেরা অবাক হয়ে চোখ কপালে তোলেন। গারো সমাজে বিধবা বা বিপত্নীক খুঁজে পাওয়াও মুশকিল বললেও তাই হবে। আলাপ প্রসঙ্গে এক প্রবীণ ব্যাক্তিকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, একশো বছর আগে বাংলাদেশ সরকার বা অন্য কেউ যদি বিধবা বা বিপত্নীক ভাতা দেওয়ার জন্য একশো জনের নাম চাইতো, তখন কি হতো? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, একশোদিন ঘুরেও একশো জন বিধবা পাওয়া যেতো না, বিপত্নীকতো আরো নয়ই। কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন, গারো সমাজের প্রথাগুলোই এর কারণ। এক, আখিম প্রথার যথাযথ চর্চা, দুই, রান্দি মিকচি গাল্লা-তে মানুষের আস্থা, এবং তিন- মানক, জিকচল বা নকচিকদের ক্ষমতা এবং দায়িত্ববোধ (গারো সামাজিক প্রথাসমূহ দেখুন, পৃষ্ঠা নং ...) ইত্যাদি।
গারোদের সামাজিক সম্প্রীতির মনোভাব বা মূল্যবোধ অত্যন্ত উঁচুমানের। প্রচলিত রীতি অনুসারে, একজন ব্যক্তি একজনকে বিবাহ করার অর্থ শুধু স্বামীস্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন নয়; বরং তাদের পরিবার এবং গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং সে সম্পর্ক আজীবন বজায় রাখা; যা গারো সামাজিক মূল্যবোধের বড় একটা অংশ। সামাজিক মূল্যবোধের কারণে- বিচ্ছেদ বা বৈধব্যজীবনের জন্য কেউ চাইলেও (শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম না হলে) সম্মতি সহজে পাওয়া যায় না। গারোরা মনে করে, কারোর বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়া এবং স্বেচ্ছায় বৈধব্য জীবনকে বেছে নেওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, স্বামী (বা স্ত্রী)-র গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক চ্ছেদ করা; যাকে গারো ভাষায় বলা হয় ‘আখিম খিমত্তা’ বা ‘আমাসারি ওয়াতগালা’। একারণে গারো সমাজে ‘জিক-সে গালগ্রিকা’ বা স্বামীস্ত্রীর ছাড়াছাড়ি বলার চেয়ে ‘আমা-সারি গাল্লা’ বলা হলে সেটি হয় চরম অপমানজনক। এজন্য গারো সমাজে সামাজিক কিছু নিয়ম বা কর্মসূচী মেনে বিপত্নীক বা বিধবার মানকগণ দ্বিতীয় স্ত্রী বা স্বামী দাবী করার রীতি রয়েছে- যাকে Òরান্দি মিক্চি গাল্লাÓ অর্থাৎ ‘বিধবা/বিপত্নিকের অশ্রু বিসর্জন’ বলা হয় (দ্রঃ রান্দি মিক্চি গাল্লা, পৃঃ নং ...)। উক্ত বিধবা বা বিপত্নীকের বয়স যতোই হোক না কেন, দৈহিকভাবে সক্ষম (বা উপযুক্ত) হলে, পরিবারে তাকে দেখাশুনা সেবাশুশ্রূষার নির্ভরযোগ্য লোক না থাকলে এবং স্বভাব-চরিত্র, সংসারি মনোভাব সন্তোষজনক মনে হলে- দ্বিতীয় স্ত্রী বা স্বামী দিতে হয়- এটা গারোদের প্রচলিত সামাজিক রীতি। মৃতস্বামী বা মৃতস্ত্রীর পরিবার বা গোষ্ঠীথেকে উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রী না মিললে গোষ্ঠি বা মাহারিথেকে হলেও পাত্র/পাত্রীর ব্যবস্থা করে দিতে হয়। আর যদি পাত্র বা পাত্রী দিতে না পারে, তাহলে মাহারিগতভাবে নিজেদের অপারগতা ও অযোগ্যতার দায় মাথায় নিয়ে, অপমান সয়ে মৃতস্বামী বা মৃতস্ত্রীর গোষ্ঠীর কাছে আখিম খিমসত্তা (গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক চ্ছেদ করা) এবং গাম্মাসিয়ার (আর্থিক জরিমানা) মাধ্যমে মুক্তি পেতে হয়। আর উক্ত বিপত্নীক বা বিধবা যদি নিজেথেকে বিচ্ছেদ বা বৈধব্য জীবন যাপন করতে চায়, তাহলেও তার পুরো গোষ্ঠী আখিম খিমসত্তা আইনের আওতায় পড়বে এবং উপযুক্ত শাস্তি বা জরিমানা গোষ্ঠীর প্রাপ্য। এসমস্ত কারণে গারো সমাজে বিধবা বা বিপত্নীক খুঁজে পাওয়া ছিলো দুরূহ ব্যপার।
অন্যদিকে কোন পুরুষ নিজে থেকে বিপত্নীক থাকতে চাইলে তার অর্থাৎ স্ত্রীর পরিবার এবং গোষ্ঠীর অনুমতি এবং সমর্থন পেতে হয়, না হলে উক্ত বিপত্নীককে সন্তান, অর্থসম্পদের মায়া ত্যাগ করে তার মায়ের বাড়ি বা মানকদের কাছে ফিরে যেতে হবে- যা একজন গারো পুরুষের জন্য অত্যন্ত নিন্দনীয়, অপমানজনক।
সেকারণে স্বামী বা স্ত্রী এবং তাদের দুপক্ষের লোকেরাই কেউ কারোর কাছে হারতে চাইতো না বলে দ্বিতীয় স্বামি বা স্ত্রী চাওয়াটাই অধিক সহজ সমাধান বলে মেনে নেওয়ার কারনে গারো সমাজে ভিক্ষুক, বিধবা ও বিপত্নীক খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যপার ছিলো। তবে, ইদানিং আধুনিকতার ছোঁয়ায় অথবা উচ্চশিক্ষা লাভ করায় গারোদেরও মন পরিবর্তন হচ্ছে। দ্বিতীয় স্ত্রী বা স্বামীর ব্যবস্থা করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ার কারনে অনেককেই পারিবারিক সম্মতিক্রমে বিধবা বা বিপত্নীক থাকতে দেখা যায়। আর এমন বিপত্নীক বা বিধবারা পারিবারিকভাবে এবং গোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন