খ) গারো সমাজের বিবাহের প্রধান পুর্বশর্তসমূহ
গারো সমাজের বিবাহের পূর্বশর্তগুলো ১) খিমনা খি.য়া বা জাকখিয়া এবং ২) খিমনা খি.জা বা জাকখিজা। এদুটি বিষয়ে নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-
খ.১ খিমনা খি.য়া বা জাকখিয়া : গারো সমাজের বিয়ের অন্যতম রীতি হলো- বর এবং কনের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্ক হবে উভয়ই উভয়ের মামাতো অথবা ফুফা/পিসিতো ভাইবোন; অর্থাৎ গারো সমাজে শুধুমাত্র মামাতো/ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ চলে। অন্যদিকে বরের পিতা এবং কনের মাতার মধ্যেকার সম্পর্ক হবে ভাইবোন সম্পর্কের। অর্থাৎ ভাইবোনের সন্তানদের মধ্যে বিয়ে সম্ভব; কিন্তু দুই ভাইয়ের সন্তানদের মধ্যে বা দুইবোনের সন্তানদের মধ্যে বিয়ে একেবারেই নিষিদ্ধ। কেননা, দুইভাই বা দুইবোনের সন্তানদের মধ্যেকার সম্পর্ক অতি নিকটাত্মীয় বা আপন ভাইবোনের মতো। অতএব, গারো সমাজে শুধুমাত্র মামাতো/ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ চলে। আর এরূপ সম্পর্কের বিবাহকেই খিমনা জাকখিয়া (অর্থাৎ গোত্র বা উপগোত্রের নিয়মানুসারে বিবাহ চলে) বলা হয়।
খ. খিমনা খি.জা বা জাকখিজা: নিম্নোক্ত দুই কারনে গারোদের মধ্যে বিবাহ চলে না। যেমন-
খ.১ মা.দং : গারো সমাজে কাকাতো (বা চাচাতো), জ্যাঠাতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। কারণ গারোদের রীতি অনুসারে কাকাতো (বা চাচাতো), জ্যাঠাতো ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্ক হয়ে থাকে আপন ভাইবোনের মতো। দুর্ঘটনাবশত বা প্রণয়ঘটিত চিরান ছেলে এবং চিরান মেয়ের মধ্যে বিয়ে করে, সে বিয়েকে গারো সমাজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না। সাধারণত এমন ঘটনা বিরল। আর এরকম বিবাহকে ‘মা.দং’ অর্থাৎ নিজের আপন (পরিবারের) মা-বোনকে বিয়ে করা বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার শামিল বলে গণ্য হয় (ইসলাম ধর্মমতে যাকে বলা হয় যেনা করা)। সুতরাং, এরকম সম্পর্কের বিবাহ যেমন চরম নিন্দনীয়, তেমনই সেই দম্পতিকে পারিবারিক সম্পত্তির ওয়ারিশথেকে বঞ্চিত হওয়াসহ সমাজ এবং গ্রামথেকেও বিতাড়িত হতে হয়।
খ.২ বাকদং: সাংমা গোত্রের মধ্যে অনেকগুলো উপগোত্র রয়েছে, তেমনই মারাক গোত্রেও অনেকগুলো উপগোত্র। গারো সমাজে সাংমা মাহারির ছেলের সাথে সাংমা মাহারির মেয়ের সাথে বিয়ে চলে না, মারাক ছেলের সাথে মারাক মেয়ের মধ্যেও তাই। বিয়ে হতে হলে শুধুমাত্র সাংমা গোত্রের সাথে সাথে মারাক গ্রোত্রের; বা মারাক গোত্রের সাথে সাথে সাংমা গ্রোত্রের মধ্যেই সম্ভব। (বিঃদ্রঃ সাংমা মারাক সম্পর্কে পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে; Òবাকদিল বা গোত্রসমূহÓ দেখুন) । একই গোত্রের ( অর্থাৎ সাংমা সাংমার মধ্যে বা মারাক মারাক গোত্রের মধ্যে) ছেলেমেয়ের মধ্যে সম্পর্ক হবে মাসতুত বা জ্যঠাত ভাইবোন। আগেও বলা হয়েছে, গারো সমাজে মামাত বা ফুপাতো/পিসিতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয়, কিন্তু মাসতুত বা জ্যঠাত ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয় না। যদি কোনভাবে এরকম সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ হয়ে যায়- তাহলে এমন বিয়েকে বাকদং নামে আখ্যায়িত করা হয়; অর্থাৎ নিজের মাতৃসম বা ভগ্নিসম মেয়েকে বা ছেলেকে বিবাহ করেছে বলে গণ্য হয়। এরকম সম্পর্কের বিয়েকেও স্বাভাবিক নিয়ম বলে ধরা হয় না, বরং উক্ত দম্পতিদ্বয় নিন্দা, উপহাস এবং করুণার পাত্র হয়।
গ) বিবাহের বয়স
গারো সমাজে বেশ কিছু প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে। বিবাহের বয়স বা সময় সম্পর্কিত দুটো প্রবাদ হলো- Òখ্রা চা.না সিকখাং, রাসং সিনা সিকখাংÓ এবং Òমিকগিল ফি.য়া, জাকসি চিক্কাÓ। প্রবাদ দুটোর ভাবার্থ একই। প্রথমটা অর্থ- Òলজ্জা পাওয়ার আগে, গর্ব/সুনাম নষ্ট হওয়ার আগেÓ এবং দ্বিতীয়টার অর্থ হচ্ছে- Òপাতা/পর্দা উল্টেছে, আঙ্গুল কামড়িয়েছেÓ। বিশেষ করে, মেয়েদের বাড়ন্ত বয়সে অভিভাবকদের বলতে শোনা যেতো- Òলজ্জায় পড়ার আগে, সুনাম নষ্ট হওয়ার আগেÓ বা Ò(লজ্জার কারণে) চোখের পাতা যাতে উলটে না যায়, আঙ্গুল কামড়িয়ে যাতে ব্যথা না পাইÓ- তাই মেয়ে ভালো থাকতেই জামাই আনতে হবে। অর্থাৎ উক্ত প্রবাদে বুঝা যায়, গারো সমাজে বাল্যবিবাহ হতো না; কিংবা হলেও অস্বাভাবিক বা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে হতো। এবিষয়ে কতিপয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে- একমাত্র Òচাপ্পা, অনচাপা বা দকচাপাÓ-র কারনে অনেক সময় নাবালিকাকে বিয়ে দেওয়া হতো (নিম্নে চাপ্পা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, পৃষ্টা নং ….. দেখুন); প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র ভবিষ্যতের জন্য চিহ্নিত বা নির্বাচন করে রাখা মাত্র। পরিণত বয়স না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটির পিতামাতা অথবা অভিভাবক বা প্রথম স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে রেখে লালন-পালন করা হতো। প্রথম স্ত্রী সংসারকর্মে অক্ষম হলে এবং মেয়েটি শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযুক্ত হলেই মেয়েটিকে (অর্থাৎ দ্বিতীয় স্ত্রীকে) স্বামীর হাতে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তুলে দেওয়া হতো। অতএব, বলা যায়- আদিযুগের গারোরা নিরক্ষর ও বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করে হলেও ছেলেমেয়েদের পরিণত বয়সে বিবাহ প্রদান করতো। আর ইদানীংকালে গারো ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার প্রতি ঝুকছে, বিবাহের আগেই নিজেকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিবাকরিও করছে, তাই গারোদের বিবাহের বয়সের গড়ও বেড়ে গেছে। আর যেহেতু গারোরা অধিকাংশই খ্রিষ্টান, তাই রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে ছেলের কমপক্ষে ২১ এবং মেয়ের কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোন অভিভাবক এবং খ্রিষ্টধর্মের পুরোহিতগণ বিবাহ দিতে চান না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন