ঘ) গারোদের বর্তমান বিবাহ পদ্ধতি
সমাজ বা সংস্কৃতির নিয়ম এমনই; যুগে যুগে এর চলমান রীতিনীতিগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। তেমনই গারো সমাজে শিক্ষিতের হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ধীরে পরিবর্তন এসেছে গারোদের ব্যক্তি জীবন যাপনে, পারিবারিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে, চেতনায়। গারোরাও এখন বুঝতে শিখেছে তাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ভালোমন্দ দিকগুলো। গারোরা যেমন ভালো দিকগুলো অর্জন করতে শিখছে, তেমনই মন্দ দিকগুলো বর্জন করতেও দ্বিধা করছে না। এ ধারাবাহিকতায় গারোদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তন আসলেও জাতীয় মূল্যবোধ, সামাজিক বন্ধনের কারণে তাদের চলমান রীতিনীতির কিছু মূল (common) বিষয়গুলোতে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নি; তেমনই পাল্টাতে পারে নি গারো সমাজের বিবাহের রীতিনীতি বা পদ্ধতিগুলোও। আদিধর্ম সাংসারেক, খ্রিষ্টান এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিবাহের সামাজিক পদ্ধতিগুলো (কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান
ব্যতীত) প্রায় একই। নিম্নে গারোদের বর্তমান বিবাহ পদ্ধতিসমূহ ধারাবাহিকভাবে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো-
ঘ. ১ বান্দাবোস কা.আনি (বিবাহের প্রস্তুতিপর্ব)
প্রণয়ঘটিত হোক বা না হোক, কনের পক্ষ থেকে বরপক্ষের কাছে প্রথমে বিবাহের প্রস্তাব জানাবে- এটাই আদিগারো সমাজের প্রচলিত রীতি। তবে, আধুনিক শিক্ষিত হয়ে গারোরাও তাদের আগের এরকম রীতিনিতিগুলো বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যেহেতু ছেলেমেয়ের ইচ্ছা বা স্বাধীনতাকে মূল্য দেয় এবং উভয়পক্ষের পারিবারিক সুবিধা অসুবিধার কথা মাথায় রেখে এই প্রস্তাব রীতি অনেকটাই শিথিল হয়েছে। তাই, অন্যপক্ষ বউ বা জামাই ছাড়তে রাজী হোক বা না হোক- উভয় পক্ষ থেকে যে কোন পক্ষ বিয়ের প্রস্তাব আনতে পারে। এই বিবাহের প্রস্তাবকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়, যেমন-
ঘ.১.১ প্রাক-প্রাথমিক প্রস্তাব :
প্রস্তাব নিয়ে আসতেও কিছু প্রস্তুতি নিতে হয় কনে পক্ষদের। সময়ের আগেই কনের পক্ষের চ্রা (অর্থাৎ মামা, ভাইয়েরা; ধর্মীয়, সামাজিক এবং প্রথাগত আইন সংক্রান্ত যেকোন সমস্যায় পরিবারের মেয়েদের পক্ষাবলম্বন করা এবং তাদের স্বার্থরক্ষা করা এই দলের দায়িত্ব), কনের পিতার সাদুআদা (অর্থাৎ মেয়ের অভিভাবকতুল্য এবং নেতৃস্থানীয় যেমন- কাকা, জ্যাঠা, দুলাভাই, অনেক সময় সস্ত্রীক) এবং কনের নানা-নানী যথাসম্ভব সবাইকে ডাকা হয়। তাদের কাছেও কনের নাম বলে এবং পছন্দের ছেলেকে দেখিয়ে বা উদ্দেশ্য করে বিয়ে করানোর (বা দায়িত্ব পালনের) কথা তুলতে এবং রাজী করাতে হয়। অথবা উক্ত কাকা দুলাভায়েরাও (ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম বা কোনরকম প্রণয়ঘটিত ব্যাপার না থাকলে) ভালো কোন বরের নাম প্রস্তাব আকারে আনতে পারে। এভাবেই সকলের সম্মতিতে উক্ত ছেলে পক্ষের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়ে থাকে। তারপর প্রথমে কনের পক্ষথেকে এক বা দু’জন বরপক্ষের বাড়িতে এই বলে খবর দেওয়া হতো- নাং.নি/ না.সংনি চ্রা দেফান্তেদে, আমা-সারিদের না.সংচা রি.আমনা রে.বানোনা (অর্থাৎ তোমার/তোমাদের ভাইচারি আত্মীয়রা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে বা তোমাদের খোঁজ নিতে আসতে চাইছে)। সাধারণত এরকম দেখতে আসবে বা মা-বোনদের খোঁজ নিতে আসবে বললে কেউই না বলতে পারেন না।
ঘ.১.২ প্রাথমিক প্রস্তাব :
বিয়ের ব্যাপারে বাবা অথবা মামা কিংবা মাহারীর নেতৃস্থানীয় মাহারীর লোকজনের প্রভাব এবং দায়িত্ব অপরিসীম। এমন প্রাথমিক প্রস্তাব নিয়ে বর পক্ষের বাড়িতে চ্রা-জিকচল-সাদু মিলিয়ে মাত্র দুই-চারজনের মতো গিয়ে থাকে এবং এসময়ে কনে বা কোন মহিলার যাওয়ার প্রয়োজন হয় না বা সাধারণত কোন মহিলা যান না। বরের বাড়িতে প্রস্তাবকারীরা পৌঁছার পর বরের পিতা/অভিভাবক তাদের আশপাশের ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজনদের দ্রুত সংবাদ দিয়ে নিয়ে আসবেন তারপর হালকা আপ্যায়নের পর (অথবা চু পানের আসর বসিয়ে) উভয়পক্ষ সম্মিলিতভাবে বসে আলাপ শুরু করবেন। আলাপের শুরুটা বরাবরের মতো গৃহকর্তার পক্ষে গৃহকর্তার চ্রাগণ করবেন এবং অভ্যাগতদের আসবার কারণ বা উদ্দেশ্য জানতে চাইবেন। এরই মধ্যে কনে পক্ষের তুখোড় চ্রাগণ তাদের বিবাহযোগ্যা মেয়ের জন্য একজন ছেলে (জামাই) চাইতে এসেছেন বলে জানাবেন। এই প্রাথমিক প্রস্তাবের পর অন্য কোন মেয়েপক্ষ (এমনকি, যদি এই ছেলের অন্য কোন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক থাকেও- তবুও উক্ত ছেলের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারে না।
ঘ.১.৩ মাধ্যমিক প্রস্তাব :
এটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার Long process। কেননা- বর, বরের অভিভাবক বা আত্মীয়দের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা হেতু এই বিবাহের প্রস্তাবে নাও রাজী হতে পারে। তাই, বর (বা কনে) এবং তার অভিভাবকবৃন্দ বিবাহদানের এই প্রস্তাবে রাজী না হওয়া পর্যন্ত কনে পক্ষের লোকেরা বরের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে বা অনুরোধ নিয়ে আসতেই থাকবে। উভয়পক্ষের কোন সমস্যা বা মেনে নেওয়ার মতো বা উল্লেখযোগ্য কোন কারণ দেখিয়ে ছেলে বা ছেলেপক্ষ রাজি নাও হতে পারে। তবে, বড় কোন কারণ ছাড়াই এই প্রস্তাবে ছেলে বা ছেলেপক্ষ মত না দিলে এবং মেয়েপক্ষের লোকেরা হতাশ হয়ে ফিরে গেলে ঐ সমাজের বা পাড়াপ্রতিবেশিদের কাছথেকে নিন্দা শুনতে হয়। অর্থাৎ এই স্তরেই কনে পক্ষের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ক্রমান্বয়ে বর বা অভিভাবকদের বুঝাতেই থাকবে। সাধারণত আত্মীয়তার টানেও হোক অথবা হবু বরবধূর ভবিষ্যত ভেবেই হোক- সাধারণ কোন পক্ষই রাজী না হয়ে পারেন না। অন্যথায় বিয়ের জন্য অন্য ছেলেকে খুঁজতে হয়।
ঘ.১.৪ চুড়ান্ত প্রস্তাব : চুড়ান্ত প্রস্তাবকে সাধারণ ভাষায় ÒগরবরÓ বলে থাকে (নিম্নে ÒগরবরÓ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হয়েছে, পৃঃ নং... ) । এই দিনে চু, মিদাপ-সামদাপ নিয়ে বরের (অথবা কনের) বাড়িতে মহিলাসহ এবং কনে (অথবা বরের) অভিভাবকসহ বিবাহের কথা পাকাপাকি হয় এবং এই যথাসম্ভব এই দিনেই বিয়ের দিন-তারিখ অথবা কোনরকম সুবিধা-অসুবিধা, চাহিদা, ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ইত্যাদির চুড়ান্ত আলাপ চুড়ান্ত হয়ে যায়। এই গরবর অনুষ্ঠানের পর বর ও বঁধুর সাথে বা তাদের অভিভাবকদের পরস্পরের মধ্যে আর দেখা সাক্ষাৎ সাধারণত হয় না।
বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত হবার পর বিয়েতে দেরী করা রীতি বিরুদ্ধ। তেমনই বাক্দত্তা ছেলেমেয়ের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ এবং মেলামেশাও নিষিদ্ধ। বাগদানের পর এক সপ্তাহ বা মাসখানেক সময় নেওয়া যেতে পারে; তবে ক্ষেত্রবিশেষ বা উপযুক্ত কারণে উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে ৩ মাস পর্যন্ত সময় নেওয়া যেতে পারে বলে প্রবীণ গারোদের অভিমত।
ঘ.১.৫ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান :
প্রস্তাবের তৃতীয় স্তর অর্থাৎ চুড়ান্ত প্রস্তাবে পরিণতি বিবাহ। চুড়ান্ত প্রস্তাব এবং বাগদান অনুষ্ঠানের পর আর কোন পক্ষ ইচ্ছা করলেই এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে না। উদাহারণসরূপ বলা যায়, বাগদান অনুষ্ঠান বা বিবাহের আগপর্যন্তও যদি কোন পক্ষের স্বার্থের কারনে এই বিয়ে ভেঙ্গে যায় এবং বিয়ে ভাঙ্গার কারণ যদি অস্পষ্ট অথবা অপর্যাপ্ত হয় তাহলে অন্যপক্ষ মানহানির অভিযোগ আনতে পারে এবং খিম বা আখিম আইনের আওতায় দোষী সাব্যস্ত হতে হবে; এমকি আর্থিক জরিমানাপর্যন্ত করতে পারে। তবে, প্রস্তাবের মাধ্যমিক স্তরের মধ্যেই যদি উভয়পক্ষের কোন সমস্যা থেকে থাকে; অথবা মেনে নেওয়ার মতো বা উল্লেখযোগ্য এবং অসমাধানযোগ্য কারণ দেখিয়ে ছেলে বা ছেলেপক্ষ রাজি নাও হতে পারে। কারণগুলো যদি মেয়েপক্ষ মেনে নেন, তাহলে আখিম আইন লংঘনের অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকবে। তবে, এভাবে এর আগেই যদি ছেলে বা ছেলের অভিভাবকগণ কোনভাবে বা আংশিক মেয়েটিকে বিবাহের সম্মত হন অথবা কোনরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, অথবা প্রেমের সম্পর্কের কারণে কোনভাবে প্রলোভনে ফেলে বা কৌশলে মেয়েটির গায়ে হাত দেয়; অথবা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করে অথবা যৌন সম্পর্ক হয়ে থাকে- তাহলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে, মেয়েটির সাথে অসৎ আচরণের জন্য মেয়েপক্ষ ছেলের বিরুদ্ধে হয়রানী এবং সম্মানহানির অভিযোগ আনতে পারে। এমতাবস্থায় ছেলেপক্ষ দোষ স্বীকার করে মানহানিবাবদ জরিমানা প্রদান করে বিবাহ ভেঙ্গে দিতে পারে।
ঙ) খ্রিষ্টধর্মমতে গারোদের বিবাহ অনুষ্ঠান : লক্ষ্য করা যায়, বর্তমানকালে গারো সমাজের বিবাহসংক্রান্ত করণীয় কার্যক্রম এবং অনুষ্ঠানগুলো একই। পার্থক্য শুধু আদিধর্ম সাংসারেকদের বিবাহ পরান সাংসারেকদের খামাল (পুরোহিত), খ্রিষ্টানদের বেলায় তাদের চার্চের ফাদার বা পাদরি এবং হিন্দু সনাতনধর্মানুসারিদের বেলায় হিন্দু পুরোহিত বা ঠাকুর। এছাড়া বিবাহের অন্যান্য আয়োজন বা করণীয় পদ্ধতিগুলোর সকল ধর্মানুসারিদের মাঝে মিল রয়েছে। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো-
ঙ.১ গরবর বা বিবাহের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত: বলা যায়, এটা এক ধরণের চুক্তি করা; অর্থাৎ এই দিনে বিবাহের কথা পাকাপাকি হবে। এই দিনই প্রস্তাবকারীরা তাঁদের কনেকে এবং অন্যান্য মহিলাদেরকে নিয়ে আসবেন। ঐ মহিলাদের দল (কনেপক্ষ) চু (যদি উভয় পক্ষই চু ব্যবহার করে), মিদাপ-সামদাপ (মোরগ মাংসের তরকারি এবং ভাত) নিয়ে আসবেন। তারপর ছেলেপক্ষ ছেলেকে জামাই হিসাবে ছেড়ে দিবেন- এই কথাটি কনে কনের মাবোন এবং কনে পক্ষের সকল ময়মুরুব্বিদের সামনে বলবেন। অর্থাৎ এই হবু বর-বধুর জন্য এইদিনথেকেই আখিম আইনে আখিম আইনের আওতায় প্রবেশ করা হলো। এইদিনের পর আর কোনপক্ষই ইচ্ছামত বা নিজেদের স্বার্থে এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারবেন না। যথাসম্ভব এই দিনেই বিবাহ সংক্রান্ত যাবতীয় পরিকল্পনা, বিবাহের দিন-তারিখ বা সুবিধা অসুবিধার বিষয়ে আলাপ হবে। পারলে এইদিনেই অথবা পরিকল্পনা অনুযায়ী হবুবরকে সাথে নিয়ে গিয়ে খ্রিষ্টান হলে মিশনে বা মণ্ডলীতে বান (বিবাহ বিষয়ে প্রশিক্ষণ) লেখানোর জন্য নিয়ে আসবেন; অথবা উভয়ই সাংসারেক ধর্মের অনুসারী হলে দো.বুক দক্কা পদ্ধতিতে বিবাহের জন্য বিবাহের নির্ধারিত দিনে অথবা আগের দিন ছেলেটিকে কনের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
ঙ.২ বাগদান/পানচিনি :
বাগদান বা পানচিনি অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান ইত্যাদি উপমহাদেশের সংস্কৃতিথেকে সংক্রমিত হয়ে এখন গারোদের মাঝেও বিদ্যমান। বাগদান বা পানচিনি অনুষ্ঠান আদি গারো সাংসারেক ধর্মাবলম্বিদের করতে দেখা যায় না। খ্রিষ্ঠান গারোদেরকেই করতে দেখা যায়। সাংসারেকরা গরবরের দিনই মিদাপ-সামদাপ আর চু-দিকখা নিয়ে পানচিনির কাজটা সেড়ে ফেলতো এবং ঐদিনই বা দো.বুক দক্কার দিন হবুবরকে নিয়ে আসতো। আর হবুবর যদি বিয়েতে গড়রাজি থাকে, তাহলেও কন্যাপক্ষ ছেলেটিকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে আসতো। খ্রিষ্টানদের বেলায় জোর জব্বর চলে না; বরং বাগদান বা পানচিনি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হবুবরকে কনের বাড়িতে নিয়ে আসতে হয়। খ্রিষ্টধর্মমতে বিবাহ আশির্বাদের সময় পুরোহিত ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই বিবাহের জন্য রাজী কিনা জানতে চান। শুধু তাই নয়, বাগদান বা পানচিনি অনুষ্ঠানেও ‘বাগদান ও প্রার্থনানুষ্ঠান’ হয়ে থাকে, এই সময়েও হবুবর-বধু উভয়কে, উভয়পক্ষের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন এবং উপস্থিত জনতার কাছে মতামত জানতে চাওয়া হয়। এসময় যদি কেউ আপত্তি (যৌক্তিক) করে, তাহলে এই বিবাহ ভেঙ্গে যেতে পারে। আর সকলেই রাজী থাকলে সকলের আশীর্বাদ প্রার্থনার মাধ্যমে বাগদান অনুষ্ঠান সফল হয়। বাগদান অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে উপস্থিত সকল জনতা বিশেষ করে বরপক্ষের সকলকে বিবাহের দাওয়াত দিতে হয়, এটাই গারোদের প্রচলিত রেওয়াজ এবং সৌজন্যবোধ। এই বাগদান অনুষ্ঠানে কনেপক্ষ (বা বরপক্ষ) বর ও বঁধুর জন্য নতুন পোষাক, গহনা ও আনুষাঙ্গিক জিনিষ, শ্বশুর-শাশুড়ি ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য সাধ্যমত শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, শার্ট ইত্যাদি নিয়ে আসেন। আর জনগণের জন্য সবার জন্য বিলিয়ে দেওয়া হয় কনেপক্ষের (বা বরপক্ষের) আনা পান ও চিনি (বা গুড়), চা (অথবা চু) ইত্যাদি। একটা বিবাহের আয়োজনের মতো এদিনেও আয়োজন এবং খাওয়াদাওয়া, আনন্দ, বিদায়ের বেদনার মাধ্যমে এ অনুষ্ঠান শেষ হয়। হবুবরকে নিয়ে যাওয়ার সময় বরের বন্ধু-বান্ধবীরা এবং গ্রামের লোকজন কীর্তন করতে করতে হবুবর-কনে এবং কনেপক্ষকে বিদায় জানাতে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে আসেন। পরের দিনই যদি বিবাহ অনুষ্ঠান হয়, তাহলে অনুষ্ঠান শেষে বরকে এবং বরপক্ষের লোকজনকে সাথে নিয়ে কনেপক্ষ নিজবাড়িতে ফিরে আসে। আর এদিকে কনের বাড়িতেও কীর্তনের মাধ্যমে হবুবর-বধু এবং বরপক্ষের লোকজনকে অভ্যর্থনা জানাতে কীর্তন সহকারে এলাকার যুবকযুবতীরা এগিয়ে আসে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর চা-চক্র এবং পরে রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়। বিবাহ অনুষ্ঠান এবং ভোজের জন্য নিজেথেকে নিঃসংকোচে গ্রামের সকলেই অংশগ্রহণ করে থাকে। তাই কীর্তন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মহানন্দে রাত্রি জাগরণ হয়।
ঙ.৩ বিবাহ আশীর্বাদ এবং ভোজ : বিবাহ অনুষ্ঠান হয় বাগদানের পরের দিন (অথবা নির্ধারিত দিনে) গীর্জাঘরে অথবা বিয়ে বাড়ির উঠানে সুন্দর করে সাজিয়ে। আর হবুবর আর কনে উভয়ই যদি সাংসারেক ধর্মানুসারি হয়ে থাকে, তাহলে যেদিন ছেলেকে মেয়ের বাড়িতে আনা হবে, সেদিনই রাতে Òদো.বুক দক্কাÓ-র মাধ্যমে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। বাগদানের দিনথেকে শুরু করে বিবাহের দিন পর্যন্ত দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজন, গ্রামের লোকজন যার যার সাধ্যানুসারে গিম্মিন/গুম্মুন (শুকড়, ছাগল, হাঁস, মোরগ, চাল, চালের গুড়া এবং তরকারীতে যা যা প্রয়োজন সব) নিয়ে আসতে থাকে (দ্রঃ গিম্মিন/গুম্মুন, পৃঃ নং...) । আর অতি নিকটাত্মীয় এবং সমাজের অন্যান্য লোকেরাও যার যার সাধ্যমত গিম্মিন, উপহার সামগ্রি নিয়ে আসেন।
বিবাহের দিন ভোরথেকেই সমাজের লোকজন ভোজের প্রস্তুতির কাজ করতে চলে আসে আর নিমন্ত্রিতরা ভোরথেকে সারাদিন লোকজন আসতে থাকে, তবে বিবাহ অনুষ্ঠান হয় যখন বরের প্রত্যাশিত লোকজন এসে উপস্থিত হন। অনুষ্ঠান শুরু হয় পুরোহিতের গীর্জা বা প্রার্থনার মাধ্যমে। বিবাহের আশির্বাদদানের আগে বরবধূর কাছথেকে পুনরায় মতামত জানতে চাওয়া হয়। যদি উভয়ই বা সমাজথেকে কারোরই এই বিয়েতে আপত্তি না থাকে, তাহলে বরবধূকে নিম্নোক্ত শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। শপথ বাক্যটি নিম্নরূপ-
প্রথমে হবুবর শপথ বাক্য পাঠ করবেন-
............(কনের নাম), ঈশ্বরের সামনে এবং মণ্ডলীর (সকলের) সামনে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করছি। আজথেকে সুখে-দুঃখে, ধনে-দারিদ্রে, স্বাস্থ্যে-অস্বাস্থ্যে আজীবন আমি তোমাকে রক্ষা করবো, তোমাকে ভালবাসবো- তোমার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করি।
তারপর কনেও বরের নাম বলে একইভাবে শপথবাক্য পাঠ করার পর পুরোহিত বর ও কনের সংসার জীবন যেন সুখের ও শান্তিপূর্ণ হয় এজন্যে প্রার্থনা ও আশীর্বাদ করবেন।
এভাবে উভয়ই শপথবাক্যটি পাঠ করবেন এবং আংটি, মালা ইত্যাদি আদান-প্রদান করতে হয়। সবশেষে পুরোহিত বরবধূকে পাশাপাশি একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে দুজনের গলায় বড় আকারের একটা মালা পরিয়ে নবদম্পতির জন্য আশীর্বাদ এবং তাদের দাম্পত্য সুখ ও শান্তির জন্য প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বিবাহ আশীর্বাদ অনুষ্ঠান শেষ করেন। ঐ অনুষ্ঠান শেষে বর ও কনের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন এবং বয়জ্যষ্ঠ সকলেই একে একে দম্পতিকে আশীর্বাদ করতে এগিয়ে আসেন এবং প্রয়োজনে বরকনে জোরবেঁধে দুজনই উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছথেকে আশীর্বাদ নিতে যায়। দুপুরের খাবারের সময় হলে প্রথমে বর ও কনের অভিভাবকদের, বিশেষ করে দূরের অতিথিদের তারপর এলাকার প্রবীণ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সবশেষে এলাকার সকল জনগণকে খাবার পরিবেশন করা হয়। এসময় বর ও কনের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন এবং এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পাতে ওয়াক-বিখা (শুকড়ের কলিজ্বার বড় আকারে টুকরা) দেওয়া হয়। এবং যে বাড়িতে চু-পানের আয়োজন রয়েছে সেখানে খাজিসহ চু খাওয়ানো হয়। এভাবে দিনব্যাপী খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গানসহ আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হয়।
ঙ.৪ জা.সি চা.আ : জা.সি মানে পায়ের আঙ্গুল; কথাটা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। সত্যিকার অর্থে এই জা.সির মানে কোন পশুর পেছনের অনেকখানি মাংসসহ আস্ত একটা পা। বলা যায়, এটি একটি বিদায় অনুষ্ঠান। বর বা কনেপক্ষকে শূকরের একটা পা দিয়ে দিতে হয়। দাওয়াত বাড়িতে যারা গিম্মিন নিয়ে আসে তাদেরকেও মিদাপ-সামদাপসহ তাদের আনা পশুর পা একটা করে দিয়ে দিতে হয়; সেসাথে বিয়ে বাড়িতেও যে কয়টা শুকড় বা গরু-ছাগল মারা হয়েছে- তার প্রত্যেকটার একটা করে পা রেখে দিতে হয়। পরেরদিন সেগুলোসহ প্রয়োজনে আরও কিছু শূকর মেরে রান্না করে বিয়েবাড়িতে অবস্থানরত সবাইকে এবং বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য এলাকার লোকজন যারা শ্রম দিয়েছে তাদেরকে খাওয়ানো হয়। গারোদের যে কোন বড় ভোজের পরের দিন জা.সি চা.আ-র ব্যবস্থা থাকে। চু, ভাত, খাইয়ে এভাবেই বরপক্ষের এবং দূরের লোকজনকে বিদায়ের আয়োজন চলে; এটাকেই বলা হয়- জা.সি চা.আ। জা.সি চা.আর আরেকটা বিশেষত্ব হচ্ছে- উপস্থিত সম্মানিত অতিথিদের মধ্যে, বা সমাজের লোকদের মধ্যে বা আয়োজনে নেতৃত্বদানকারিদের মধ্যে বা কোন প্রকার সমস্যা, ভুলত্রুটি, মনোমালিন্য, ঝগড়াফ্যাসাদ ঘটে থাকতে পারে, যাদের জন্য (বিশেষ করে গিম্মিনদের জন্য, এবং বিয়াইবাড়িতে) যা দেওয়ার তা দিয়ে দিতে ভুল হতে পারে, অতিরিক্ত চু খেয়ে মাতাল অবস্থায় কেউ কেউ মন্দ গালাগাল করতে পারে- গৃহকর্তা বা চ্রাগণ সেগুলো জেনে নিবেন এবং যথাসাধ্য সংশোধন পূর্বক সকলকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন। এভাবেই গারোরা সমাজে মিলেমিশে বসবাস করে। এই দিনেও চু পানের আয়োজন হয়ে থাকে।
ঙ.৫ ফিরাগমন : নবদম্পতি বিবাহের এক সপ্তাহ বা তাদের সুবিধামত পিতামাতার বাড়িতে যাওয়ার নাম ফিরাগমন। নবদম্পতির সাথে আরও কয়েকজন মহিলা পুরুষ একটা শূকর বা হাঁস মোরগ, মাছ, তৈল এবং মশলাপাতি, চাল, চা, চিনি, দুধ, পান, সুপারি, মুড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি নিয়ে যাবেন। যে বাড়িতে চু পান চলে, সেখানে বিচ্চিসহ চু-দিকখা নিয়ে যেতে হয়। এগুলো সবকিছুই বর, কনে এবং কনের সহযাত্রীরা রান্নাবান্না ও প্রস্তুত করে শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে খাওয়াতে হয়। খাওয়াদাওয়ার পর শুধুমাত্র দম্পতির সঙ্গীরা বিদায় নিয়ে কনের বাড়ি ফিরে আসবে। এই দল বরের বাড়ির এবং সারাদিনের অবস্থা সম্পর্কে কনের পিতামাতাকে জানানোর পর আবার চু, ভাত খেয়েদেয়ে যার যার বাড়িতে ফিরে যায়। আর দম্পতিরা কিছুদিনের জন্য বরের বাড়িতে অবস্থান করে, পরে বরকে নিয়ে কনেকে নিজবাড়িতে ফিরে আসে। ফিরাগমনের আরেকটি বিশেষত্ব যে- এই ফিরাগমন সময়েই বরের অভিভাবকগণ চ্রা-মানকদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের ছেলের জন্য ছেলের হাথত (ছেলের অবিবাহিত থাকাকালীন উপার্জিত অর্থ-সম্পদ) এবং পরিবারের সামর্থ অনুসারে জমি, গৃহপালিত পশু, টাকা-পয়সা ইত্যাদি যা দেবার দিয়ে দেওয়া হয় অথবা দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে থাকে। যদি কিছু দেবার সামর্থ নাও থাকে, তাহলে একটা রাং অথবা কাঁসার থালা দিয়ে দিবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন