গারো সমাজের আদি এবং বর্তমান বিবাহ পদ্ধতি
বিবাহ একটি সেতুবন্ধন। একজন নারী ও পুরুষের মিলনের, পরিবার থেকে পরিবারের, গোষ্ঠি থেকে আরেক গোষ্ঠীর এবং এক সমাজের সাথে আরেক সমাজের সাথে আত্মীয়তার নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে বিবাহ। এই আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন অর্থ-সম্পদ দিয়ে হয় না- গারো সমাজ তাই মনে করে। একারনে গারো সমাজে পণ বা যৌতুক প্রথা বা দেনমোহর বলতে কোনকিছু কোনদিন ছিলোও না, এখনও নেই। গারোদের লিখিত কোন আইন না থাকলেও সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে যে জাতীয় চেতনা এবং জাতির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে; এই শ্রদ্ধাবোধ, চেতনাসমূহের মাধ্যমেই গারো সমাজ বংশ পরম্পরায় তাদের বিবাহের রীতিনীতি লালন ও পালন করে চলেছে। তারপরেও বিশ্বের প্রতিটি সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর বিবাহের রীতিনীতি যেমন রয়েছে, তেমনই গারো সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়।
বলে রাখা ভালো যে, সাধারণত গারো সমাজের কোন বাবা-মাÕই তাদের কন্যা সন্তানদের পরের বাড়ি বউ পাঠাতে চান না। কেননা, গারো সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সংসারের যাবতীয় সম্পদের মালিক মেয়েরা বলা হলেও সম্পদ রক্ষণা-বেক্ষণের মূল দায়িত্ব থাকে গোষ্ঠির উপর। গারো সমাজের দৃষ্টিতে একজন মেয়ে অন্য পরিবারে বা গোষ্ঠীতে বউ যাওয়া মানে তার প্রাপ্য সম্পদ নিয়ে যাওয়া। কোন পরিবার বা গোষ্ঠীই চান না যে সম্পদের মালিক অন্য পরিবারে বা গোষ্ঠীতে চলে যাক। সেকারণেই ছেলেদেরকে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয় এবং স্ত্রীর পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বভার নিতে হয়। ফলে আদিযুগথেকেই তেমন কোন ব্যতিক্রম না হলে গারোদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হতো কনে বা শ্বশুরবাড়িতে। আর একারনেই (আরও কিছু কারণ যোগ হতে পারে) হয়তো Òগারো ছেলেরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাবে/যায়Ó ব্যাপারটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। তবে, আধুনিককালের ছেলে-মেয়েরা জামাই যাবে, নাকি বউ আসবে- তার সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারছে। লক্ষ্য করা যায়, কালের স্রোতে অভিভাবকরাও তাদের ছেলেমেয়েদের বউ-জামাই যাওয়ার ব্যপারে আগের তুলনায় অনেকখানি নমনীয়।
যাইহোক- বর্তমানে গারোরা সকলেই আর আদিধর্মে নেই, তাই তাদের বিবাহের রীতিনীতি এবং প্রচলিত বিবাহের আনুষ্ঠানিকতায় কিছুটা পরিবর্তন আসলেও গারো সমাজের বিবাহের কিছু মূল বিষয় বা বৈশিষ্ট্যগুলো এখনও মেনে চলছে। নিম্নে উল্লেখিত ক্রমানুসারে গারোদের বিবাহের প্রকারভেদ, রীতিনীতি এবং কার্যক্রমগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
ক) গারোদের আদি এবং বর্তমান বিবাহ পদ্ধতিসমূহ
খ) গারো সমাজের বিবাহের প্রধান পুর্বশর্তসমূহ
গ) বিবাহের বয়স
ঘ) বিবাহের প্রস্তুতিপর্ব
ঙ) বিবাহ অনুষ্ঠান
চ) বিবাহ বিচ্ছেদ
ছ) বিধবা বা বিপত্নীকদের জন্য ব্যবস্থা
ক) গারোদের আদি এবং বর্তমান বিবাহ পদ্ধতিসমূহ :
বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশী গারোদের মধ্যে ৯৮% ভাগ এবং ভারতের ৮০% খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী। বাকী গারোরা আদিধর্ম সাংসারেক; সনাতন হিন্দুধর্মানুসারি এবং কিছু অংশ
মুলসিম। বাংলাদেশে অল্প কিছু সংখ্যক গারো পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে ইসলাম বা বাঙালি সমাজের মতোই জীবনযাপন করছে। বিয়ের আইনগত প্রচলিত প্রথা ছাড়াও গারো সমাজে এমন কতগুলো বিয়ের প্রথা প্রচলিত রয়েছে যেগুলো সাধারণভাবে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। নিম্নে গারো সমাজের আদি এবং বর্তমান বিবাহ পদ্ধতি (উল্লেখিত ৪ ধর্মে বিশ্বাসীদের
সহ) নিয়ে আলোকপাত করা হলো।
ক আদিগারো সমাজের বিবাহ পদ্ধতিসমূহ :
ক. ১ দো.বুক নিয়া/ দো.সিয়া/দো.দক্কা : এলাকাভেদে এই পদ্ধতিতে বিবাহের অনেকগুলো নাম মনে হলেও শাব্দিক অর্থ একই। যেমন দো.বুক নিয়া (মোরগ হত্যার পর এর পেট ছিঁড়ে
নাড়ীভুঁড়ি দেখে দাম্পত্য জীবন পরীক্ষা বা নির্ণয় করা; দো.সিয়া (মোরগ মারা/হত্যা করা); এবং দো.দক্কা (মোরগ হত্যা করা) ইত্যাদি।
অর্থাৎ খামাল (সাংসারেক ধর্মের পুরোহিত) দ্বারা নির্দিষ্ট মন্ত্রপাঠ এবং মোরগ হত্যার মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন করা। গারো সমাজে বিবাহের এই পদ্ধতিই সর্বজনস্বীকৃত এবং গারো আইনে সিদ্ধ। অর্থাৎ খ্রিষ্টান বা অন্যান্য ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে গারো সমাজে দো.বুক নিয়া/ দোসিয়া/দোদক্কা পদ্ধতিতেই বিবাহ সম্পন্ন হতো। শুধু তাই নয়, নিম্নে বর্ণিত অন্যান্য পদ্ধতিতে বিয়ে হলেও এই পদ্ধতিতে পুনরায় বিবাহ দেওয়া হয়। বিবাহের এই পদ্ধতি অনুযায়ী বিবাহের অনুষ্ঠানের শুরুতে খামাল (পুরোহিত) হবুবর-বধুর উভয়ের সম্মতি রয়েছে কিনা জানতে চান (উল্লেখ্য, বেশীরভাগ সময়েই
যুবকদের অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও এবং মেয়ের অসম্মতিক্রমেও উভয়পক্ষের অভিভাবকদের
সম্মতিতে বিয়ে প্রদানের রীতি প্রচলন ছিলো)। সম্মতি প্রকাশ করলে খামাল দুটো মোরগ নিয়ে বিবাহের নিম্নোক্ত মন্ত্রটি উচ্চারণ করার পর মোরগের মাথা ছিঁড়েন। পড়ে মোরগ দুটোর পেটথেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে নবদম্পতির ভাগ্য পরীক্ষা করেন। তারপর চু (গারোদের তৈরী পানীয়), ভাত-মাংস আহারের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান শেষ হয়। বর্তমানে শুধু মাত্র সাংসারেক ধর্মাবলম্বি গারোরাই এই পদ্ধতিতে বিবাহ করে থাকে।
দো.বুক দক্কা বিবাহের মন্ত্র-
(যুবকের জন্য) ইয়া হৈ.....
.....(খালি জায়গায় ছেলের নাম) মুংআই......(মেয়ের নাম) দা.আসালদে ম, দা.আজাদে ম, দোবুক দকগিংঙা, ওয়া.খু আন্নিংঙা, দা.সিও দুরানি, মিজাও সংদিনি, দুরুনা খা.বাকি ফিন্নিগা, মান্দিনা সকচুই আগানা, হিন্দিসা দুরু মান্দিবা, দিমারিসিবা, খা.বাক বা.আংঙা, সকচুবাংঙা, উয়া দুরা পি.সা দুদুরানা, সংদি পি.সা আমিরাখ, দা.সিও ছাওয়ারি হি.বাংঙা, নকখু থালবাংঙা, দো.বুক নিবাংঙা, ওয়া.খু আনবাংঙা, ইয়া হৈ........
(যুবতীর জন্য) ইয়া হৈ.....
দা.আসালদে ম, দা.আজাদে ম, ........(মেয়ের নাম) মুংআই......(ছেলের নাম) মুংআই, দো.বুক দকগিংঙা, ওয়া.খু আন্নিংঙা, সিথিরিগিত্তা, মাদাগংগিত্তা, প্রাপছিগিত্তা, আছিরিগিত্তা, দা.সিও খা.বাকাগিত্তা, মিজাও সকচুয়াগিত্তা, আমা আংসারি, আপফা নকছামি, দুরানি খা.বাকাগিত্তা, সংদিনি সকচুয়াগিত্তা, দো.বুক নিংঙা, ওয়া.খু আন্নিংঙা
ইয়া হৈ........
ক.২ থুনাপা/চুনাপফা : থুনাপা বা চুনাপফার অর্থ হলো স্বামী-স্ত্রীর মতো শয়ন বা একসাথে থেকে সংসার শুরু করা। যুবক-যুবতীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকলে এবং উভয়ের সম্মতিতেই যুবক যুবতীর শয়ন কক্ষে গোপনে প্রবেশ করে মেয়ের সঙ্গে একত্রে রাত্রি যাপন করতো। এক্ষেত্রে (ছেলেকে উপযুক্ত মনে হলে) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুবতীর পিতামাতার নীরব সমর্থন থাকে। পরের দিন যুবক-যুবতীর উভয়ের গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে জানাজানি হলে (বা যুবতীর পরিবারের পক্ষথেকে জানিয়ে দেওয়া হতো), আর কোন পক্ষের আপত্তি বা সম্মতি না থাকলে পরেরদিনথেকে একমাসের মধ্যে যুবকটিকে তাড়িয়ে দিতে হতো, অথবা যুবকের আত্মীয়স্বজন যুবকটিকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেতো হতো। অন্যথায়, দুপক্ষের সম্মতিক্রমে এই বিয়ের স্বীকৃতি মেলে। স্বীকৃতির দিনে উভয়পক্ষ মিলে খেয়েদেয়ে আনন্দ ফুর্তি করে পুনরায় দো.সিয়া পদ্ধতিতে বিয়ে পরিয়ে উপরোক্ত পদ্ধতিতে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখা হতো। অবশ্য থুনাপার স্বীকৃতি মিললে দো.বুক নিয়া বা দো.সিয়া পদ্ধতিতে বিবাহ করাতে হবে এমন কোন কথা নেই।
অপরদিকে কদাচিৎ যুবক-যুবতী খ্রিষ্টান হলে পুনরায় খ্রিষ্টধর্মের নিয়ম অনুসারে বিবাহ প্রদান করা হয়।
ক ১.৩ নকপান্থে গা.আ : এর অর্থ হচ্ছে, অবিবাহিত যুবকের শয়নগৃহে প্রবেশ। বিয়ের এই পদ্ধতি প্রায় পূর্ববর্ণিত পদ্ধতির মতই। তবে এই পদ্ধতিতে যুবতী মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। উল্লেখ্য, কোন যুবকের শয়ন কক্ষে কোন যুবতী (বাইরের যুবতীতো নয়ই) প্রবেশ করতে পারে না। অবিবাহিত প্রাপ্ত বয়স্কা যুবতী চুপিসারে বা রাতের অন্ধকারে কাঙ্ক্ষিত যুবকের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে প্রেমিককে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার পর যুবকটি যদি প্রস্তাবে সাড়া দেয়, তাহলে যুবকের অভিভাবকদের সম্মতি থাকুক বা না থাকুক পরেরদিন যুবতীর সাথে বসবাসের উদ্দেশ্যে যুবতীর বাড়ীতে চলে যাবে। যুবতীর অভিভাবক এবং আত্মীয়স্বজনের সম্মতি না থাকলে তারা ছেলেটিকে তাড়িয়ে দিতে পারে, অন্যথায় তারা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করবে। বর্তমানে অভিভাবকদের দ্বারা প্রস্তাব আদান-প্রদানের মাধ্যমেই বিবাহ সম্পন্ন হয়।
ক ১.৪ চা.সেঙা : এর শাব্দিক অর্থ (পছন্দ করা যুবকের পরিবারে গিয়ে থাকা)
একসাথে খাওয়া এবং অপেক্ষা করা। এই পদ্ধতিতেও মেয়ের ভূমিকাই বেশি থাকে। পছন্দের পিসিতো ভাই অথবা মামাতো ভাই থাকলে তাদের বাড়িতে গিয়ে অবস্থান নেয়। অবশ্য যুবকের পরিবারের সকলের মামা-মামি অথবা পিসি-পিসার এতে মৌন সমর্থন থাকতে হয়। যুবতী উদ্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে সেই পরিবারের সদস্যদের মতো থাকা, খাওয়া এবং তাদের পরিবারের সাংসারিক এবং যুবকের কিছু কিছু কাজকর্ম করে দিতে থাকবে, সেসাথে কাঙ্ক্ষিত যুবকটির মন জয় করার চেষ্টা করতে থাকবে। পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে যুবকের পিতামাতা যদি যুবতীর আচার-ব্যবহার, কাজকর্ম দেখে পছন্দ করেন, তাহলে তারা যুবকের ঘরে মেয়েটির হাতে খাবার দিয়ে পাঠান। যুবকটি যদি একই পাত্রে একসাথে খেতে রাজী হয়, তাহলে খেতে খেতে যুবতী তার মনের বাসনা প্রকাশ করবে। এতে যদি যুবক ইতিবাচক সাড়া দেয়; তাহলে দো.বুক নিয়া বা দো.সিয়া পদ্ধতিতে বিবাহ প্রদান করা হয়। বর্তমানে এ পদ্ধতির প্রচলনও প্রায় দেখা যায় না।
ক. ৫ চামে জি.কা : এই পদ্ধতিটিকে বলা ভালোবেসে বা পছন্দ করে ফাঁদে ফেলে বিবাহে বাধ্য করা। উল্লেখ্য, গারোদের বড় বড় অনুষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বা দীর্ঘ সময় ধরে অনুষ্ঠিত হতো (বিবাহ, শ্রাদ্ধ, ওয়ানগালা,
রংচুগালা ইত্যাদি); এরকম বড় অনুষ্ঠানগুলোতে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারে। সেখানে সকলেই গান গেয়ে, নেচে, খাওয়া-দাওয়া করে আনন্দ ফুর্তি করতে পারে। সেসাথে যুবক-যুবতীদের জন্য বাড়তি সুযোগ, মৌন সমর্থন বা রেওয়াজ ছিলো পছন্দের ছেলে বা মেয়ে নির্বাচন করার। কোন যুবতী তার আচার-আচরণে, কথাবার্তায়, নেচে-গেয়ে অথবা কোন খাদ্য-পানীয় খাইয়ে যদি ছেলের মন জয় করতে পারলেতো ভালো; আর না হলে পটিয়ে অথবা কৌশলে যুবকের খুতুপ (পাগড়ি) অথবা পরিধেয় বস্ত্র সংনকমা (গ্রাম মাতবর)-র কাছে নিয়ে জমা দিতে পারলে (বলা যায়- যুবতী দ্বারা যুবকটিকে দাবী করলে) যুবকটি বিয়ে করতে বাধ্য হতে হতো। অবশেষে দো.বুক নিয়া বা দো.সিয়া পদ্ধতিতে বিবাহ প্রদান করা হতো। আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েদের প্রেম করে বিবাহ করার সুযোগ পাচ্ছে, তাই এই পদ্ধতির প্রচলনও দেখা যায় না।
ক.৬ চাওয়ারি রা.আ : চাওয়ারির বাংলা অর্থ হচ্ছে জামাতা বা জামাই। অর্থাৎ নকনা ব্যতীত সকল মেয়েই আগাত্তে বা আগাথে; আর তাদের স্বামী সকলকেই চাওয়ারি বলা হয়। অর্থাৎ চাওয়ারি হচ্ছে- পরিবারের উত্তরাধিকারিনী মেয়ে ব্যতিত অন্যান্য মেয়েরদের স্বামী। চাওয়ারি রা.আ- এটি সাধারণ একটি বিবাহ পদ্ধতি বা চলমান প্রথা। প্রথমে বিবাহযোগ্যা মেয়ের জন্য ছেলে পছন্দ করতে হয় (যদিও এযুগের ছেলেমেয়েরা প্রেম করে বা নিজেরাই পছন্দ করার সুযোগ পাচ্ছে), তারপর মেয়ের অভিভাবকগণ আয়োজন করে (Òবান্দাবোস কা.আনিÓ চ্যাপ্টারটি দেখুন পৃষ্ঠা ... ) ছেলের বাড়িতে গিয়ে ছেলে, ছেলের অভিভাবক এবং আত্মীয়স্বজনদের রাজী করাতে হয়। এই পদ্ধতিতে জামাই আনার নামই হচ্ছে- চাওয়ারি রাআ (আরোও এবিষয়ে জানতে Òআগাত্তে/আগাথে_চাওয়ারি প্রথাÓ দেখুন)।
ক.৭ নক্রম সাল্লা : শাব্দিক অর্থে নক্রম হছে নকনি ক্রং; অর্থাৎ ঘরের খুটি। নক্রমের বিশেষত হচ্ছে- পরিবারের সম্পত্তির ভাবী উত্তরাধিকারিনী মেয়ে অর্থাৎ নকনার স্বামী। এই নকনার স্বামী ঘরজামাই এবং ভবিষ্যতে শ্বশুর পরিবারের কর্তৃত্বের অধিকার দাবীদার। শ্বশুরের পরিবারের সম্পদ, কাজকর্ম পরিচালনায় অক্ষমকালিন সময়ে কিংবা শ্বশুরের মৃত্যুর পর এই নক্রমই শ্বশুরের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং গোষ্ঠী, সমাজেও সম্মানপ্রাপ্ত হবেন। এ পদ্ধতিটি আগাত্তে বা আগাথেদের স্বামী বা চাওয়ারি রাআর প্রায় কাছাকাছি মনে হলেও সত্যিকার অর্থে তা নয়। যেমন, ১) পরিবারের সম্পত্তির ভাবী উত্তরাধিকারিনীর স্বামী; অর্থাৎ অন্যান্য চাওয়ারি বা জামাইদেরথেকে বেশি অধিকারপ্রাপ্ত, দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সম্মানপ্রাপ্ত। ২) শ্বশুরের আপন ভাগ্নেকে ছাড়া নক্রম করা হয় না। ৩) নেহায়েত আপন ভাগ্নে পাওয়া না গেলে অন্য গোষ্টি থেকে Òদে বা.আ/ দে-গাত্তাÓ পদ্ধতিতে আপন ভাগ্নের মর্যাদা দিয়ে নক্রম করতে হয়। ৪) নক্রম নির্বাচন ছেলে বা মেয়ে ছোট থাকতেই নির্বাচন বা দাবী করা যায়; অবশ্য পরিণত বয়সে নির্বাচিত নক্না নক্রম পরস্পর সম্মতি কিংবা অসম্মতি প্রকাশ করতে পারে (আরোও এবিষয়ে জানতে Òনকনা-নক্রম প্রথাÓ দেখুন)।
ক.৮ জিকগিদ্দি রা.আ : শাব্দিক অর্থ দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ। স্ত্রী যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের কথা ভেবে চ্রাগণ অর্থাৎ মামা, ভাইদের দল সেই পুরুষ/স্বামীর জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়ার অনুমতি দেন। অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে বাধ্য বাধ্য করা হয়। এছাড়াও স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগলে বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে পঙ্গুত্ব এবং স্ত্রীর মৃত্যুবরণ করলে দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে হয়। তবে যে কারণেই দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়া হোক না কেন, দ্বিতীয় স্ত্রীটি প্রথম স্ত্রীর গোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজন। যেমন, স্ত্রী যদি চিরান হয়, তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রীও হতে হবে চিরান মা.চং পরিবারের। এভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়াকেই জিকগিদ্দি রা.আ বলা হয়।
ক ১.৯ চাপ্পা/অনচাপা/দকচাপা : চাপ্পা, অনচাপা বা দকচাপার বাংলা অর্থ হচ্ছে একটার সাথে আরেকটা দিয়ে দেওয়া। উপযুক্ত কোন পুরুষ বা মহিলা বিধবা অথবা বিপত্নীক হয়ে থাকবে- এটা গারো সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু, অপমানজনক। কারোর স্ত্রী বা স্বামী মারা গেলে সে সামাজিক (আখিম) আইনের মাধ্যমেই স্বামী/স্ত্রী দাবী করতে পারে। যদি পুরুষ/স্বামী মারা যান, তাহলে স্বামীর আত্মীয়স্বজনেরাও অপমানিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, যদি স্বামীর পরিবর্তে স্বামী দিতে না পারে। স্ত্রী মারা গেলেও একইভাবে আত্মীয়স্বজনেরাও অপমানিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, যদি স্ত্রীর পরিবর্তে স্ত্রী দিতে না পারে। তাই মধ্য বয়সে কারোর স্বামী মারা গেলে আর উপযুক্ত বা সমবয়সের পুরুষ পাওয়া না গেলে এবং ঐ মধ্য বয়স্কার জন্য দ্বিতীয় স্বামী হিসাবে তরুণ-যুবককে দিতে হয়। এমতাবস্থায় এই তরুণ স্বামীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কম বয়সী মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে নির্বাচন বা দেওয়া হয়- এই পদ্ধতিটাকেই চাপ্পা/অনচাপা/দকচাপা বলা হয়।
ক.১০ সেক্কা/সেক্কে দঙা/সেক্কে খিম্মা : এর শাব্দিক অর্থ হরণ বা অপহরণ করে বিয়ে করা। অর্থাৎ কোন পুরুষ দ্বারা বিবাহিতা মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশে নিজেদের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়া এবং বসবাস করাকে বুঝায়। কিছুদিনের মধ্যে পলাতক ব্যক্তিদ্বয়কে যদি বিচ্ছিন্ন করা না হয়- তাহলে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করবে। অবশ্য ব্যভিচার এবং আখিম আইন লংঘন ও অবমাননা করার অভিযোগে তারা উভয়ই নবদম্পতির গোষ্ঠিরা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। খ্রিষ্টান ধর্মানুসারে এমন বিয়ের স্বীকৃতি নেই।
ক.১১ সেক্কে খাত্তা : এর অর্থ পালিয়ে বিয়ে করা। অর্থাৎ অবিবাহিত যুবক-যুবতী উভয়ের অভিভাবকদের অমতের কারণে দূরে কোথাও পালিয়ে বসবাস করাকে বুঝায়। সাধারণত অভিভাবকদ্বয়ের সম্মতি না থাকলে এভাবে পালিয়ে বিয়ে করে। শেষ পর্যন্ত মেয়ের অভিভাবকদের সম্মতি না থাকলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই উক্ত যুবক-যুবতীকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে; এক্ষেত্রে যুবকটিকে কোন অর্থদন্ডে দন্ডিত করা হবেনা। বর্তমানে খ্রিষ্ট বিশ্বাসী গারো যুবক-যুবতীদের মধ্যে এমন হলে অভিভাবকরা অনেক সময় মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন এবং পরিশেষে খ্রিষ্টান ধর্মানুসারে মণ্ডলীতে বিবাহ সম্পন্ন করেন। ইদানিংকালে যারা পালিয়ে বিয়ে করছে, তাদের ম্যারেজ পদ্ধতিতেই বেশি হচ্ছে। এটি গারো সমাজে স্বীকৃত নয়, অভিভাবগণ বাধ্য হয়ে তাদেরকে মেনে নিলে এর শেষ পরিণতিও খ্রিষ্টধর্মানুসারে বিয়ে।
ক ১.১২ জিক্ বাং.এ খিম্মা (বহু বিবাহ): গারো সমাজে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বহুবিবাহ করতে পারে না। কদাচিৎ পুরুষদের ক্ষেত্রে হয় এবং এজন্য উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। যেমন প্রথমত, স্ত্রী যদি দৈহিকভাবে কারোর দুরারোগ্য সমস্যা বা রোগব্যাধি থাকে অথবা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে স্ত্রী এবং স্ত্রীর গোষ্ঠীর অনুমতিক্রমে স্ত্রীর ছোটবোনকে জিকগিদি বা জিকগিত্তে (সহযোগি স্ত্রী) হিসাবে বিবাহ করতে পারে। শর্ত থাকে, এক্ষেত্রে জিকগিদি মেয়ে/মহিলাটি স্ত্রীর বড়বোন বা স্ত্রীর চেয়ে বয়সে বড় কাউকে বিবাহ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, যদি কোন কারণে মধ্য বয়েসী বিধবা মহিলার জন্য কোন তরুণ বা যুবক বয়সের কাউকে স্বামী হিসাবে প্রদান করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট মাহারী বিশেষ বিবেচনায় যুবকটির সহযোগি স্ত্রী হিসাবে দেওয়া যাবে। উল্লেখ্য, এই
ক্ষেত্রে, বিধবার পূর্ব স্বামীর ঔরষজাত কোন অবিবাহিতা কন্যা সন্তানকে জিকগিত্তে দেওয়া যাবে, অথবা- ঐ পরিবারে কন্যা সন্তান না থাকলে আত্মীয়দের মধ্য হতে অন্য কোন মেয়েকে প্রদান করতে পারে। বর্তমানে খ্রীষ্টধর্মে বিশ্বাসী গারোদের মধ্যে বহু বিবাহের প্রচলন একেবারেই নেই, স্ত্রী মারা গেলেই আরেকবার বিবাহ করা যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন