গারোদের মাতৃ ভাষাঃ
পৃথিবীর প্রতিটি জাতি বা আদিবাসীর একটি করে নিজস্ব
ভাষা আছে। তেমনই গারোদেরও নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যদিও এ ভাষার বর্ণমালা নেই। গারো উপকথা অনুসারে জানা যায়- গারোরা যখন তিববত থেকে এদেশে আগমন করে, পশু চর্মে লিখিত
গারো ভাষায় যে সমস্ত বই পুস্তক তখন যার বা যাদের জিম্মায়
ছিল, তিনি বা তাঁরা ক্ষুধার জ্বালায় পথিমধ্যে সমুদয় বইপুস্তক সিদ্ধ
করে খেয়ে ফেলেন। বিষয়টি অনেকদিন গোপন থাকার পর যখন জানাজানি হয় তখন আর কারো পক্ষে গারো
বর্ণমালা স্মরণ করা সম্ভবপর হয়নি। আবার কোথাও শুনেছিলাম, ময়মনসিংহের এক জমিদার শিকারে গিয়ে এক গারো পর্বতগুহায়
পুঁথির দু-একটি ছেঁড়া পাতা পেয়ে এর ফটো সৌরভ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। তা এত ঝাপসা
ছিল যে, কোনো অক্ষরই বোধগম্য হয় নি। বাহ্যিকভাবে লেখাগুলি ছিল চীনা চিত্রলিপির মতো।
প্রখ্যাত গবেষক
ডঃ রবিন্স বার্লিং তাঁর ‘The
Strong Women of Modhupur’ গ্রন্থে বলেছেন, “মান্দি ভাষা টিবোটো-বার্মান
ভাষাগোষ্ঠীর বিশেষ একটি উপরিভাগের অন্তর্ভূক্ত। সামগ্রিকভাবে গোটা ভাষাগোষ্ঠীর
ইতিহাস সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা না গেলেও এই বিশেষ উপরিভাগের ইতিহাস সম্বন্ধে
কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
নৃবিজ্ঞানীগণের
মতে, গারোরা সিনো-তিব্বতীয়
ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং অক্ষরহীন ও অলিখিত একটি প্রাচীন অনার্য ভাষা ব্যবহার করে। এই একই (তিব্বতি-চীন) ভাষা- বোড়ো, নাগা, ত্রিপুরা, মনিপুরী,
মুরমি, মুগরি, লেপচা বা রোং, আবোর, মিকির, আংগামি, সেমা, আত্ত, তাংখুলা, লুসাই,
থাডো, কুকি জাতির লোকেরাও ব্যবহার করে থাকে। চীনা ভাষার সঙ্গে গারো ভাষার শব্দ, ব্যাকরণ
ও ভাষাতত্ত্বগত প্রচুর মিল রয়েছে বলে ভাষাবিদদের অভিমত। গারো ভাষায় নৃতত্ত্ব ও ধর্মের
কথা
রয়েছে। তেমনই- প্রবাদ-প্রবচন,
শ্লোক, গান, ছড়া, কিংবদন্তি, উপকথা, পালাগান ইত্যাদি রয়েছে। বহু ভাষার শব্দ
দ্বারা গারো ভাষার শব্দকোষ পুষ্ট এ গারো ভাষাও ব্যকরণিক দিক দিয়ে বাক্যগঠন, পদবিন্যাস,
বিভক্তি-প্রত্যয়ের অবস্থান, ক্রিয়া ও শব্দের রূপান্তর উন্নত ভাষার মতো সুশৃঙ্খল।
এ থেকে অনুমান করা হয়, ভাষাটির অতীত ঐতিহ্য ছিল। বাংলা ও অসমিয়া ভাষার সঙ্গে কিছু সাদৃশ্যের কারণে গারো
ভাষাকে কেউ কেউ এ দু ভাষার মিশ্ররূপ বলে মনে করেন। আসলে এটি একটি মৌলিক ভাষা।
উল্লেখ্য, গারো একটি জাতি হলেও এদের মধ্যে অনেকগুলো সম্প্রদায় রয়েছে। যেমন- আবেং;
আচিক; আখাওয়ে বা আওয়ে; চিবক; দুয়াল; মাচ্ছি; গারাগানচিং; চিসক; কচ্চু; আতিয়াগ্রা; মাৎজাংচি বা মাত্তাবেং; রুগা;
ব্রাক; সমন;
দলি; গন্ডায় ইত্যাদি।
আর
এ সম্প্রদাগুলোর মধ্যেও
প্রায় প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের
গারোরা গারো ও বাংলা ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলে এবং লিখতে পারে। শিক্ষিত গারোরা ইংলিশ ভাষাও ব্যবহার করেন। কিন্ত ভারতীয় মেঘালয়ের গারোরা গারো, হিন্দি, ইংলিশ এবং বাংলা; আসামের গারোরা
গারো, ইংলিশ, অসমিজ এবং পশ্চিমবঙ্গের
গারোরা গারো, বাংলা, ইংলিশ এবং হিন্দি
ভাষায় কথা বলতে পারেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন