সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬

গারোদের ডায়ালেক্ট বা উপভাষাসমূহ



গারোদের ডায়ালেক্ট বা উপভাষাসমূহ
আগেই বলা হয়েছে, গারো জাতি পৃথিবীর মধ্যে ব্যতিক্রম জাতি যার অনেকগুলো সম্প্রদায় এবং এদের প্রত্যেকটির আলাদা মাতৃভাষা রয়েছে। তবে কালের বিবর্তনে এদের সবার ভাষা চর্চার অভাবে প্রায় হারাতে বসেছে কিংবা হারিয়ে গেছে।

গারো গবেষকগণ গারোদের ১৭টি সম্প্রদায়ের ভাষার মধ্যে মিগাম এবং আত্তং সম্প্রদায়ের গোত্রের ভাষার শ্রেণিবিন্যাস ভিন্ন বলে মত প্রকাশ করেছেন। আত্তং ভাষা সম্পর্কে লেখক-গবেষক সুভাষ জেংচাম তাঁর গারোদের সমাজ ও সংস্কৃতিগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “কোচ উপাখ্যানে জানা যায়, দেশত্যাগী কোচ সম্প্রদায়ের ১২টি পরিবার সোমেশ্বরী নদী পাড়ি দিতে অসমর্থ হয়ে সিজুর কাছাকাছি কোন একটি গারো গ্রামে অস্থায়ীভাবে অবস্থান শুরু করে এবং পরবর্তীতে তারা সেখানে গারোদের সাথে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তারা গারোদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করে। গারো এবং কোচ সম্প্রদায়ের এই মিশ্র বিবাহের বংশধররাই পরবর্তীতে গারোদের আত্তং দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কোচ ভাষা ও আত্তং দলের নিজস্ব কথ্য ভাষার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য বিদ্যমান। 
অন্যদিকে ড. রবিন্স বার্লিং তাঁর ‘The Strong Women of Modhupur’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “The Megam speak a dialect of Khasi. On linguistic grounds the Megam must be classified with the Khasis rather than with the Garos, but there is considerable intermarriage along the border, and the Megam share so many features of Garo kinship and social organization that they are sometimes described as another subgroup of Garos.”

সম্প্রতি SIL Bangladesh গারোদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছেন। গারোদের ভাষার শাব্দিক মিল পর্যবেক্ষণ করে যে রিপোর্ট তুলে ধরেছেন, সেটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। সেসাথে গারো ভাষাগুলোর মধ্যে কোন গোত্রের ভাষা অন্যান্য গোত্রের ভাষার তুলনায় এর টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশী বা কম এ নিয়েও ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের গবেষণালব্ধ তথ্যটি গারোদের সবার জানা উচিৎ। তাই তাদের রিপোর্টথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি নিম্নে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশের মান্দিদের মধ্যে একে অন্যের সাথে যোগাযোগের ভাষা আবেং-এর সাথে অন্যান্য মান্দি ভাষা বৈচিত্রের সাথে তুলনায় অনেক মিল দেখা যায়। আর এ ক্ষেত্রে ব্রাকের সাথে সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায়, কিন্তু চিবক, দুয়াল, আত্তং এবং মিগামের সাথে কিছুটা কম এবং এ সাদৃশ্য তাদেরকে এখানে উল্লেখিত ক্রম  অনুযায়ীই কম হতে থাকে, অর্থাৎ চিবক-এর সাথে মিলের পরিমাণ অন্যান্য চারটির তুলনায় বেশি এবং দুয়ালের সাথে আরো কম এবং এভাবে চলতে চলতে মিগামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম। আবেং, ব্রাক, চিবক এবং দুয়াল এগুলোকে একে অন্যের আঞ্চলিক রূপ বলা চলে, কিন্তু শুধু শাব্দিক বা আভিধানিক সাদৃশ্যের দিক থেকে আত্তং এবং মিগামকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা বলা চলে। সকল মান্দি ভাষাবৈচিত্র্য থেকে কোচ সম্পূর্ণ একটা আলাদা ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবশ্য এটা সত্য বলে প্রতীয়মান হয় যে, মান্দি ভাষাবৈচিত্রের মধ্যে আত্তং ও কোচ ভাষার মাঝে সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু আঞ্চলিক সম্পর্ক থাকার মতো যথেষ্ট মিল ছিলনা”সবশেষে সিলেট বিভাগে পূর্বের পরিচালিত জরিপ থেকে সংগৃহীত লিংগাম ভাষার শব্দের তালিকার সাথে মিগাম ভাষার শব্দের তুলনা করা হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয় যে শুধুমাত্র লিংগাম ভাষার সাথে মিগাম  ভাষার এক রকম মিল রয়েছে।

গারো গবেষক, লেখক সুভাষ জেংচাম তাঁর ‘গারোদের সমাজ সংস্কৃতি’ গারো ভাষার সঙ্গে অন্যান্য কতিপয় জাতির ও সম্প্রদায়ের ভাষা কিছু তুলনার ছকের মাধ্যমে দিয়েছেন। পাঠকদের সুবিধার্থে এ ছক তিনটি তুলে ধরা হলো-
সুভাষ জেংচাম ‘গারোদের সমাজ সংস্কৃতি’ – পৃঃ ১২৫, ১২৬


সবশেষে আবারও SIL Bangladesh-এর গারোদের ভাষার স্থায়িত্ব নিয়ে যে জরিপ রিপোর্ট করেছেন, সেটি জানা আমাদের সকলের জরুরী। তাই তাদের রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
ভাষার স্থায়িত পর্যবেক্ষণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পর্যবেক্ষণকৃত ছয়টি গারো ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যে ব্রাক  ভাষার হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, কারণ ব্রাক ভাষার লোকেরা অধিক মাত্রায় এমনকি বাড়িতেও  বাংলা এবং আবেং ভাষা ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, আবেং বাংলাদেশী গারোদের মাঝে যোগাযোগের ভাষা  হওয়ায় অন্যান্য ভাষার তুলনায় এর টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশী, এবং এটা বেশির ভাগ বাংলাদেশী  গারোদের মাতৃভাষাও বটে। পর্যবেক্ষণকৃত অন্যান্য চারটি ভাষা- আত্তং, চিবক, দুয়াল এবং মিগাম; তাদের  ভাষারও টিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এটা মনে হয় যে, যদি আবেং ভাষার আরো বেশি বিকাশ ঘটে এবং বর্তমানের মত বর্ধিত হারে জনগনের মাঝে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় বাংলা ব্যবহৃত হতে থাকে তবে সেই ভাষাগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলা এবং আবেং ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হবে”।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন