ফিডেল ডি সাংমা
রাবিনের হাতে এখন অফুরন্ত সময়। রাবিন ভাবে- বাবা শিক্ষিত হলে তার নাম রাবিন না হয়ে রবীন্দ্রনাথ রাখত। তেমন অর্থ ছাড়াই কোন মানুষের নাম হয়। কি অদ্ভুত! গত রবিবার বিকেল বেলায় পাশের বাড়ি থেকে সঞ্জিব দ্রং-এর লেখা ‘বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসি’ বইটি আনা হয়েছে। গারোদের মধ্যে এমন লিখিয়ে খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে এই ভদ্রলোক বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত আদিবাসীদের কথা, বিশেষ করে গারোদের কথা লিখলেও, গারো পুরুষ কোনভাবে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে কী হবে অথবা তার পক্ষে সান্ত¡নামূলক কোন কথাই লিখেননি। এটাই বড় আপসোস! বইটি একপাতা দু’পাতা করে পড়ে আজ প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। অনেকদিন না পড়ে পড়ে বই পড়ার অভ্যাসটাই একেবারে চলে গেছে রাবিনের। পরের দিনের জন্য বাকী পাতাগুলো রেখে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। বালিশের একপাশে বইটা রেখে ঘুমাতে গিয়ে ঘুম আসে না রাবিনের। প্রায়ই সারা রাত কখনো ইজি চেয়ারে বসে থাকে, কখনওবা জানালার গ্রীল্টা ধরে বাইরে দূরের আকাশ দেখতে থাকে সে। যেন কখনো তার জীবনে শান্তির পরশ পায়নি। বড় বিষাদ ভরা মুখ।
শরীর ও মনে বিশ্বের ক্লান্তিরা আকড়ে ধরেছে রাবিনকে। প্রচন্ড ঘুমে দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে তবু ঘুম আসে না তার। শুধু এপাশ-ওপাশ করে। দু’চোখ বন্ধ করে থাকে সে। অন্ধকারে দু’হাত শুন্যে কিংবা দু’পাশে ছড়িয়ে বিছানার চাঁদরে কিছু একটা ছোঁয়ার, অনুভব করার চেষ্টা করে। যেন এই অন্ধকারেই কিছু একটা হারিয়ে গেছে তার। না, আজ কিছুই সে হারায়নি; যা হারাবার তা হারিয়েছে অনেক আগেই।
আবিমার ঠিক মাঝখানটাতে রাবিনদের গ্রাম। সামান্য উচু-নীচু লাল মাটির এলাকাটা প্রায় সিলেটী গ্রামের মত। গ্রামে বিভিন্ন ধর্ম- বর্ণের বসবাস। দৈনিক তিনবার গীর্জ্জার ঘন্টা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান, সকাল- সন্ধ্যা পূজার উলুধ্বণী, পাখিদের কলরব আর বাড়ির পাশে বাতাসে কলা পাতার ফর-ফর করা শব্দ সব সময় তাকে মাতিয়ে রাখত। অফুরন্ত হেসে খেলে কেটে যেত অতীতের সোনালী দিনগুলো।
দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে রাবিন সবার বড়। ক্লাশের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্তেও হতভাগা রাবিনের মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা। যৌবনের শুরুটা কেটেছে কাদের বাহিনীতে গিয়ে শেখ মুজিবের হত্যার বিচার চেয়ে। মুরারজী দেশাই বাংলাদেশে পুশব্যাক করার পর বড় ভাই হিসাবে সংসারের কাজে বাবাকে সাহায্য করে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। প্রতিদিনের মত কাজে গিয়ে বিকেল বেলায় ছোট ভাইকে ছুটে আসতে দেখে রাবিন। তার দিকেই হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছে। বলে - ‘দাদা, বাড়িতে মামার সাথে অনেক লোকজন এসেছে; তোমাকে নাকি জামাই নিয়ে যাবে..।’ ছোট মামার মেয়ে- সারাং বেশ সুন্দরী। নামটা সারাং না হয়ে নারাং হলে মানাত। কমলার মত গায়ের রং তার। রাবিনের চোখে ভাসতে থাকে- আদিবাসি পোষাকে সারাং তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। হাসি, চাহনী, শরীরের নড়াচড়া সবই ছন্দময়। তন্ময় হয়ে দেখতে থাকে সে। আর কতক্ষণ যে দেখতো- কে জানে। ‘দাদা, চল..’ ছোট ভাইয়ের কথায় সম্বিত ফিরে পায় রাবিন। মদ-মাংস খাওয়া আর হই-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে। আপন ছোট ভাই মেয়ের জামাই নেবে, তাই বাবা-মা রাজী হয়ে গেলেন। রাবিনকেও জিজ্ঞেস করা হল। অবশ্য তাকে জিজ্ঞেস না করলেও চলত। লজ্জাবনত মস্তকে শুধু ‘হূঁ’ শব্দটি করেছে । তাতেই হার্টবিট বেড়ে যায় তার। গারোদের দাক্বেওয়াল মেনে ঘর-বর, পান-চিনি, বান প্রকাশ করতে করতে বিয়েটা মাস তিনেক লেগে গেল। পান্থে হাতত হিসাবে একটা বকনা বাছুর আর দশ হাজার টাকা সারাং এর হাতে গুজে দিলেন শাশুড়ী। শুরু হল রাবিনের জীবনের নতুন অধ্যায়।
নতুন সংসারে স্বামী স্ত্রী মিলে অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখে রাবিন। মায়ের দেয়া দশ হাজার টাকা ভাঙ্গতে আর অলস জীবন যাপনে প্রায় পাঁচটি বছর কেটে গেল। এরই মধ্যে এসেছে দ’টি কন্যা সন্তান। আটজন ছেলে মেয়ে নিয়ে শশুরের বিরাট সংসার। আয় রোজগার সীমিত হওয়ায় সংসারে টানা-পোড়েন, অশান্তি দেখা দিল। সারাদিন ঘুরে ফিরে বাড়িতে এসে দেখে মা-মেয়ে বনিবনা না হওয়ায় আলাদা হাঁড়ি-পাতিল তাতে সামান্য শাক-ভাত রান্না। হতবাক রাবিন ভাবতে থাকে। অবশিষ্ট সামান্য কয়টা টাকা দিয়ে সে কি করবে। মেয়ে হিসাবে যা ওয়ারিশ পাবে, তাও দেওয়া হল না। শশুর একমন ধান দিতে চেয়েছিলেন, সারাং রাগ করে তাও নিল না। বোকা মেয়ে। মাত্র দুই হাজার টাকায় আড়াই শতাংশ জমি কেনা বাড়ীর ভিটার জন্য। পাশেই ত্রিশ শতাংশ উঁচু জমি মেয়াদী নেওয়া গেছে। চাষ করতে বাপের বাড়িথেকে একটা গরু ধার চেয়ে মলিন মুখে ফিরে এসেছে সারাং। উল্টো কাপুরুষ, মুরোদহীন বলে বকে দিল। কিছু টাকা রোজগার করে, নিলাম কাপড়ের ব্যবসা শুরু করে রাবিন। যেদিন বেশী বিক্রি হয়, সেদিন মোটা চাল আর সব্জি কেনে। মাছ মাংসের খবর থাকে না। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে বলে- বিকেলে মাছ মেরে মেয়েদের খাওয়াব। প্রায়ই এমনি করে খাইয়েছে সে। একদিন ব্যবসার টাকায় সতর হাজার টাকা দিয়ে একটা বকনা বাছুর কিনে। গরু দুটি দিয়ে জমি চাষ করা যাবে। রাবিনের মনে আছে- কেনা গরুটির দুধ বিক্রি করে সতর হাজার টাকা না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে দু’টিকে এক ফোঁটা দুধ সে খেতে দেয়নি। আজ কথাগুলো মনে হলে রাবিনের বড় কষ্ট লাগে।
জীবন সংগ্রামে কখন চৌদ্দটি বছর কেটে গেছে টের পায় নি রাবিন সারাং। টেবিলে ভাত দেওয়া হয়েছে। রাবিনের মনে পড়ে- ভাত খাওয়ার জন্য ভাল কোন প্লেট ছিল না। দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে সে পাচঁটা মাটির সাইক কিনে আনার পথে পা পিছলে দু’টো ভেঙ্গে গেল। সেদিন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভাঙ্গা সান্কীর জন্য দুঃখ পেয়েছিল। সেখানে আজ মেলামাইনের প্লেট-গ্লাস শোভা পাচ্ছে। এখন আর খাওয়া পরার জন্য রাবিনকে তেমন চিন্তা করতে হয় না; তবু অপচয় ঠেকাতে চা, পান, বিড়ি-সিগারেট এমন কি মদও সে খায় না। এজন্য পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে মহাকৃপন উপাধি জুটেছে তার। তা হোক। নাছোড় বান্দা রাবিনকে আরো উপরে উঠতে হবে। এখন প্রায় বিশ একর জমির মালিক। যে মানুষ বিশ হাজার টাকার স্বপ্ন দেখত না; সে দশ লক্ষ টাকা আনারস বাগানে শুকাতে দিয়েছিল। টাকা বাড়ার সাথে সাথে শত্রুও বেড়ে গেছে রাবিনের। এজন্য হাইজ্যাক পার্টির কবলে পড়ে চৌদ্দদিন পর লক্ষ টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেয়েছে। দিনের প্রায় চব্বিশ ঘন্টা সাইকেলের চেইন দিয়ে হাত পা বাধাঁ ছিল তার। চোখ এবং পায়ের সমস্যায় অনেকদিন চিকিৎসাও নিতে হয়েছে।
জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত গেছে রাবিনের। মাসে চব্বিশ হাজার টাকা খরচ করেও বড় মেয়েকে বাঁচাতে পারেনি। বড় ধরনের অসুখ হয়েছিল। মেয়ের পাঁচ বছর পর স্ত্রীও চলে গেল। ছোট মেয়ের জন্য জামাই আনা হয়েছে। স্ত্রী নিজের মৃত্যুর কথা জেনেই হয়তবা ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে জোর দিয়েছিল। রাবিনের মনে হয়, পৃথিবীতে সে একা। কাছাকাছি কেউ নেই, এমনকি দূরেও ঘন কুয়াশায় কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। বড় কষ্ট দেয় এই নিঃসঙ্গতা। মানুষের দিন ফুরিয়ে যায় অতি দ্রুত। ক্ষুদ্র জীবনের পঙ্তিতে জমা হয় অম্ল মধুর স্মৃতিসত্ত্বা। সে স্মৃতিসত্ত্বাই বয়োবৃদ্ধদের বাকী জীবনে বেঁচে থাকার রসদ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাবিনের এই মধ্যবয়সেই স্মৃতিগুলো তার জীবনে বেঁচে থাকার রসদ না হয়ে কঠিন বিষময় হয়ে আছে।
যার ছায়ায় রাবিনের জীবনটা অতিবাহিত হবে, সে মেয়েটাও ইদানিং কেমন হয়ে গেছে। সংসার-সম্পদ নিয়ে ব্যস্ত। বিপত্নিক পিতার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। স্ত্রীর মৃত্যুর এক বছর পর শ্রাদ্ধ এবং যাবতীয় অনুষ্ঠান হয়েছে। স্ত্রীপক্ষথেকে তাল বাহানা করে রাবিনের জন্য বউ দিল তো না-ই বরং কি ভাবে এ বাড়িথেকে তাকে বিতাড়িত করা যায় সে ব্যবস্থা নিতে থাকল। অন্য পরিবারের মেয়ে এ বাড়িতে বউ হয়ে আসলে তাদের সম্পদ ভাগ হয়ে কমে যাবে- এভাবে ছোট মেয়ে এবং জামাইকে বুঝাতে সক্ষম হল। অন্যদের প্ররোচনায় জন্মদাতা পিতার প্রতি চরম অবহেলা, অপমান বাড়ে। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি বেড়েই চলল। নিজের জমিতে চাষ-বাস, ক্রয়-বিক্রয় করার কাজে বাধা আসতে থাকে রাবিনের। গভীর রাতে মৃত স্ত্রী এবং মেয়ের কথা ভেবে চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না সে। দিন দিন জীবন সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণায় মনটা বিষিয়ে উঠছে। মরে যেতে ইচ্ছা করে তার। কোন কোনদিন মা মেয়ে মিলে রাবিনকে নিতে আসে কিন্তু কেন জানি যাওয়া হয় না। বুঝিবা রাবিনের কপালে আরো কোন দুর্গতি অপেক্ষা করছে।
পঞ্চাশ বছর পার হওয়া একটা লোক এখন একা। রাবিনের জন্য আর দ্বিতীয় বউ দেওয়া হল না। নিজের রক্তের মেয়ে সেও বাবাকে ঠাঁই দিল না। যে মেয়ের জন্মদিনে রাবিন আনন্দে নেচে ওঠেছিল, ভবিষ্যতে সুখের স্বপড়ব দেখেছিল, আজ সে মেয়ের কারনে চোখের জল ফেলে। শুণ্য থেকে শুরু করে এত কষ্টে ধন সম্পদ অর্জন করেও তা ভোগ করা হল না রাবিনের। নিষ্ঠুর ভাবে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হল তাকে। গারোদের নিয়ম বলে কথা! কোন রকমে চলা, মায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে রাবিনের। গারো সমাজে সম্পত্তির সমানাধিকার হলে অন্তত রাবিনকে মা-বোনের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হত না। খেতে বসে ভীষন লজ্জা আর দ্বিধা লাগে তার। বিয়ে হওয়া আর না হওয়া ছোট দুই ভাই-ই সংসারের প্রতি কেমন উদাস হয়ে গেছে। তারা মুখের ওপর বলে গেল, ‘খেটে-খুটে কী হবে, রাবিন দাদার জন্য আমরা কী করতে পেরেছি ....’ ইত্যাদি। নির্বাক রাবিন নীরবে শুধু চোখের জল ফেলেছে। শারিরীক ও মানসিক ভাবে ক্লান্ত রাবিনের সেই যৌবনের শক্তি এখন আর নেই। এদিক-ওদিক ভেবে কোন কূল পায় না সে। যেন নীড় হারা- ডানা ভাঙ্গা এক আহত পাখি। রাবিন ভেবে পায় না কেন তার এমন পরিণতি। মাঝ পথে এসে- থেমে যাওয়া কেন? কী তার দোষ! আদিবাসি মায়ের পেটে জন্ম নেওয়টাই কী তার পাপ! পাশের ঘরে মোরগটা হঠাৎ ডেকে উঠল। চমকে ওঠে রাবিন। ঘোর কেটে যায় তার। সারারাত ঘুম তার মোটেও এল না। ‘বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসি’ বইয়ের শেষ পাতাগুলো পড়ে ফেলতে পারে সে।
‘অর্ডার অর্ডার...’ আদালতে বিচার কাজ চলছে। ম্যাজিষ্ট্রেট হেমন্ত কুবির হাতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামী রাবিন। এডভোকেট দীনেশ দারু জেরা করতে প্রস্তুত। ডিষ্ট্রিক্ট রেজিষ্ট্রি অফিসার সুভাষ জেংচাম জমি-সম্পদ সংক্রান্ত কাগজ পত্র বগলে নিয়ে এক কোনায় নীরবে বসে আছেন। কলামিষ্ট সঞ্জিব দ্রং এবং রাখী ম্রং কলমের মুখ বন্ধ করে শুধু শুধু সাদা কাগজের পাতায় তর্জনী দিয়ে আঁকিবুকি করছেন। সম্ভবত তাদের ক্যামেরাটা (!) ব্যাগে ভরাই আছে। শত শত বুদ্ধিজীবি, সমাজ সেবক, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ দর্শকের আসনে মুখে টেপের মত কিছু একটা গুজে নিথর বসে আছেন। বাইবেল হাতে স্বয়ং বিশপ পনেন কুবি এগিয়ে এসে শপথ বাক্য পাঠ করালেন, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিবনা..
মহামান্য আদালত, সারা বিশ্বে যতগুলো আদিবাসি আছে, তার মধ্যে গারো জাতির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি আছে; যা অত্যন্ত সুন্দর এবং আকর্ষনীয়, জাতীয় মূল্যবোধ ততধিক উৎকৃষ্ট। আমি আমার জাতিকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসি এবং সন্মান করি। কিন্তু মহামান্য আদালত, আমাদের গারো জাতির সেই সৌন্দর্য্য আর মূল্যবোধ আজ আমরা হারাতে বসেছি। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখবেন- বিভিন্ন অন্যায়- অপরাধ এবং দূর্নীতির সাথে আমরা জড়িয়ে পড়ছি; মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করছি। আচিক্ জাতির মাঝে ভালবাসা, সহমর্মীতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়নতা এবং সহজ সরল জীবন যাপন এখন আর নেই। যে জাতি নিজস্ব সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের জন্য গর্ব করতে পারত; সে জাতিতে আমি রাবিনের এমন পরিণতি কেন? একটু চোখ খুলে দেখুন, কান পেতে শুনুন, এই গারো সমাজে আমার মত অনেক রাবিন আছে, পুরুষ বলে লজ্জায় কেউ মুখ খুলে না। এই গারো সমাজের নিয়মের বলি কাষ্ঠে আজ আমি অসহায়, হতভাগ্য একজন মানুষ। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলে; স্ত্রী নাই বলে, আমার সারা জীবনের বহু কষ্টার্জিত সহায় সম্পত্তি, ঘর-সংসার, সন্তান-আত্মিয়-পরিজন সব কিছুই আমাকে হারাতে হল। এমন অবস্থা দিনকে দিন চলতে থাকলে আচিক্ সমাজ একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগেই এই জতির ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা একবার ভাবুন। বৃহত্তর সমাজে মাথা উচু করে উন্নয়নে সামিল হওয়ার কথা চিন্তা করার সময় হয়ে এসেছে। আর তা না হলে এই গারো সমাজকে যাদুঘরেই স্থান করে নিতে হতে পারে। তাই আজ আমার আকূল আবেদন, আমার জীবন, আমার প্রিয় আচিক্ সমাজের কথা ভেবে- আমার প্রতি আপনি ন্যায় বিচার করবেন। আমি আরও একটা প্রস্তাবনা দিতে চাই মহামান্য আদালত, আশা করি আমার প্রস্তাবনাটি একটু ভেবে দেখবেন; আর তা হল- স্ত্রীর ওয়ারিশ/ সম্পত্তি তা স্ত্রীর নামেই থাকুক কিন্তু সংসারে স্বামী-স্ত্রী মিলে যে সম্পদ অর্জন করে তা সকল সন্তান এবং স্বামী-স্ত্রী যেন সমান ভাবে পেতে পারি এমন বিধান রাখা হোক। পৃথিবীর সকল দেশ ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে সংবিধান বা রীতি-নীতির পরিবর্তন, পরিমার্জন হয় আমাদের জাতীকে টিকিয়ে রাখতে যদি প্রয়োজন মনে হয় সমগ্র গারো সমাজ বিষয়টা ভেবে দেখবেন।
মহামান্য আদালত- ছোট মুখে বড় কথা মানায় না; তবুও বলি- দোষ হলে ক্ষমা করবেন। আজ সারা বিশ্বের নারী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দেলন করছে, সে যুগে একজন পুরুষ হয়ে নিজের কথা বলতে ভীষন ভাবে লজ্জিত হয়ে পড়ছি। মহামান্য বিচারক মহোদয় আপনি নিজেও একজন গারো..। আপনারা যারা গারো পুরুষ, বড় বড় সমাজ সেবক হয়ে সমাজ সেবা করে যাচ্ছেন, বড় বড় কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবি সরকারী-বেসরকারী অফিসের উচ্চ আসনে আসীন। আজ আমার জীবনের যে করুণ পরিনতি; তা আপনাদের প্রত্যেকের জীবনে যদি ঘটে যায়, তখন কী হবে? আপনাদের সারা জীবনের শ্রম সাধনা যদি বিফলে যায় তার পরিনতি একবার ভেবে দেখবেন কি? এত বড় সমাজে আমি রাবিন হারিয়ে গেলে হয়তবা কারোর কিছুই আসবে যাবে না কিন্তু আপনাদের মত প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ হারিয়ে গেলে আদিবাসি সমাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে মহামান্য আদালত...।’
আদালত প্রাঙ্গনের সকল লোকজন নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কী যেন বলাবলি করতে লাগল। কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে- একজন গারো পুরুষের মুখে এমন লজ্জাজনক আহাজারি শুনে বিচারক মহোদয় তিনি নিজেও বিচার কাজে বিব্রতবোধ করছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু নড়ে-চরে বসে টেবিলে সজোড়ে হাতুরী দিয়ে বললেন, ‘অর্ডার অর্ডার...’ শব্দটা এত বেশী মনে হল যেন টেবিলটাই ভেঙ্গে যাবে। চারিদিক পিন্ পতন নীরবতা। তারপর আরও একবার দ্বিগুণ জোড়ে হাতুরীর শব্দ ঠক্-ঠক্-ঠক্ ...। কিন্তু কথাগুলো আর ‘অর্ডার অর্ডার’ জাতীয় শব্দ নয়। প্রতিদিনের মত দরজায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট ভাগনীটা বলছে, ‘ মামা- চাকাত্বো, ওয়াল্ সেংজক্ ( উঠে পড়, রাত ভোর হয়েছে) ...। বই পড়ে শেষ করার পর তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাবিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠে দরজাটা খুলতে খুলতে রাবিন ভাবে, ‘পৃথিবীতে প্রতিটি রাত যেমনি ভোর হয়, তেমনি তার জীবনের রাতের অন্ধকার কখনো ঘুচবে কি-না...। আদিবাসি মা-বোনেরা আমার ভাগ্নীর মত কোনদিন ঝল্-মলে আলোর সন্ধান দেবে-তো...?’
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দরজা খোলে রাবিন। সকালের নির্মল শীতল বাতাস তার ঘরে ঢুকছে ...।
(www.bangladeshnews24x7.com
রাবিন, বাংলাদেশনিউজ২৪x৭.কম www.bangladeshnews24x7.com) - এ প্রকাশিত গল্পটি কপি করা হয়েছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন