বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

Story- শমির ঢাকা শহর


শমির ঢাকা শহর

ফিডেল ডি সাংমা
শমীর আদিবাসী নাকের ফুটো দুটো দূর থেকেই দুই নালা বন্দুকের মত দেখা যায়। অনেকেই বলে- তার নাকটা নাকি দেখতে প্রায় অভিনেত্রী শমী কায়সারের নাকের মত। তাই শমী কায়সারের নামের সাথে মিল রেখেছে সে- শমী। ঢাকা শহরে শমী নামেই বেশী পরিচিত। মেক-আপটা ডানে বায়ে আলতো ভাবে ঘসে, হা করে আরেকবার হালকা লিপষ্টিক ঠোঁটে মেখে ভাল ভাবে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে শমী। আই-লাইনারের কাজটা ভালো করতে পারেনি। ভ্রু-টা বেশ অনেকদিন আগে প−াগ করিয়েছিল সে। আদিবাসী ছোট চোখ দুটো ডাগর করার চেষ্টা করে। মেরুন রঙের ফিন্-ফিনে হালকা শাড়ীতে পেচানো থলথলে তার শরীরটা বেঢপ দেখাচ্ছে। মনকাড়া মুচ্কি হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে। না, হচ্ছে না – হয় না। আয়নার প্রতিবিম্বটা উচ্ছ্বাস হওয়ার বদলে মায়া ভরা সজল চোখে তাকিয়ে থাকে। ভেতরে পাথর চাঁপা দেওয়া নিজের ওপর ক্ষোভ আর কানড়বা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মক্ষিরানী সাজা অভ্যাস্ত হাতে আজ নিখুঁত তরুণী সাজা কখন যে অনভ্যাসে পরিনত হয়েছে। ইস্ বিউটি পার্লারে বিল দেওয়ার মত সামান্য টাকাও যদি থাকতো! নেইল-পলিশ আর মেহেদীর রঙে রাঙা হাতটি অল্পদামী চক্-চকে ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয় শমী। না টাকা খুব একটা নেই। বড় জোর সি.এন. জি-র ভাড়াটুকু হবে। বাসে যেতে পারলে কিছু টাকা বেঁচে যেত; কিন্তু আজ তারও উপায় নেই। আজকাল ঢাকা শহরে অনেক আদিবাসি উচ্চ শিক্ষার জন্য এসেছে; এরা আবার গল্প কবিতা লেখালেখিও করেন। করে কে দেখে আবার তাকেই নিয়ে গল্প ছাপিয়ে দেবে,তখন হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে যাবে। ইস্ সময়ও আর নেই! টিট্-টিট্-টিট্ করে থেকে থেকে মোবাইল ফোনটি বেজে চলেছে। আজ বেশ মালদার বাবুর ডাক। চট্ করে যেতে না পারলে লোকটা আবার মাইন্ড করে বসে। বড় লোকের ভিমরতি আর কি! একদিন এই লোকটা অভিমান করে বলেছিল- 
আগন্তুক আসেনি কাছে 
গো-ধূলি সন্ধায় একাকী বসে থেকে 
আশাহত- চলে গ্যাছি কতবার, 
অস্ত রবির আভায় 
যেন কে উঠে আসে- কাছে না আসতেই 
ফিরে যায়- এসেছিলো যতবার।
বাংলার সীমান্তে শমীদের গ্রাম। সেই আদিবাসী গ্রামে সারা বছরই পাহাড়ের র্শি-শিরে বাতাস। বর্ডারের নো-ম্যান ্স ল্যান্ডে শুকনো লাকড়ী আনতে গিয়ে সবুজে ঘেড়া গাছের ডালে, ঝোঁপ-ঝারে হরেক রকমের পাখির মধুর সুরের ডাক শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত তার। বৃদ্ধ বাবা মাঠে কাজ করার ফাঁকে গাছ থেকে শুকনো ডাল পেড়ে দিতেন। পাহাড়ী ঝর্ণার বেয়ে আসা শীতল জলে সড়বান শেষে বাড়িতে এসে শমী দেখতো সন্ধায় মা আর ছোট্ট বোনটি চুলোয় রানড়বা চড়িয়ে পুরানো ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন কোন চলচিত্রের কাহিনীর রূপদান করছে। মাঝে শমীদের সংসার ছিল বেশ বড়-সড়। চার ভাই-পাঁচ বোন, বাবা এবং চির রোগিনী মা। ভাই বোনের হিসাব করলে শমীর নম্বর অষ্টম। বিয়ের পর ছয় ভাই বোন আলাদা সংসারী হওয়ার পর এক বোন এবং ছোট্ট একটা ভাই নিয়ে কোন রকম কষ্টে শিষ্টে ছোট্ট দুটি কুঁড়ে ঘরে সংসারটা চলছিল তাদের। মাত্র কয়েক’শ গজ দূরে প্রাইমারী স্কুল কাম গীর্জা ঘর। কোনদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থেকেও স্কুলের সমস্ত লেখাপড়া তার অনায়াসে পড়া হয়ে যেত। গীর্জায় গাওয়া কোন গানই তার অজানা নয়। বাইবেলের অসংখ্য উপদেশ, ব্যাখ্যা আজও মনে গেঁথে আছে। শমীদের গ্রামে বিভিনড়ব ধর্মের; যেমন-হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিষ্টানদের বসবাস। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান, সকাল-সন্ধ্যা পূজার উলুধ্বণী, শিশুদের পড়া মুখস্ত- পাখিদের কলরব, বাড়ির পাশে বাতাসে কলা পাতার ফর-মর করা শব্দ সব সময় গ্রামটাকে মাতিয়ে রাখত। অফুরন্ত হেসে খেলে কেটে যেত অতীতের সোনালী দিনগুলো। হতভাগী শমীর আত্মীয় স্বজনের অনিয়মিত সহযোগীতায় মাত্র দশম শ্রেণী পর্যস্ত পড়া শুনা। ক্লাশের অত্যন্ত দুঃখী অথচ মেধাবী ছ্ত্রাী। টেষ্টে ভাল রেজাল্ট করেও টাকার অভাবে ফরম ফিল-আপটা করাটা আর হয়ে ওঠেনি। বাবার মৃত্যুর পর তাকে পড়া শুনা একেবারেই ছেড়ে দিতে হল। তার সাথে সংসারের অভাবের যন্ত্রণা, ভাই-বোনদের আবদার, তাদের পড়াশুনার খরচ, কারোর অসুখ-বিসুখে ঔষধবিহীন ভাল থাকার ব্যর্থ চেষ্টা ইত্যাদি দেখতে দেখতে বিপর্যস্ত শমী চাকুরী করার কথা ভাবতে থাকে। তারপরই প্রতিবেশী বান্ধবীর করুণায় ঠাঁই হয়েছে এই অচেনা অজানা ঢাকা শহরে।
আজব এই ঢাকা শহর। বড় বড় দালান কোঠা। পনের বিশ তলা দালানগুলো হাজার হাজার একতলা দালান আর বস্তির ঝোপ-খুপঁড়িগুলোকে যেন উপহাস করে- অবজ্ঞার চোখে দেখে। উপর তলার বড় লোকেরা যেমনটি করে। দামী দামী সব খাবার
খেয়ে পায়খানা-প্রস্রাব করে পাইপ দিয়ে ছেড়ে দেয় তা নিচু তলায় দুর্গন্ধ ছড়ায় যা এয়ারকুলারের হাওয়া খাওয়া লোকজন কখনোও টের পায় না। পথে বের হলেই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে শমির। শিসাযুক্ত বাতাস আর দূর্গন্ধে নিশ্বাস নেবার জো নেই। উঁচু তলার মানুষের খবর নিচু তলার কোন কিছুই বলতে পারে না; বোধ হয় তা চায়ও না। মনের মিল নেই; আছে শুধু প্রতিহিংসা আর ওপরে ওঠার নির্লজ্জ প্রতিযোগীতা। পাথরে গড়া দালানে বাস করে তারা বয়ে বেড়ায় পাথর হৃদয়। 
বে-রসিক মোবাইলটা আবার বাজছে। ‘ হ্যালো- হ্যাঁ। এই আসছি তো-।’ 
গতদিনের ডিউটিতে উপহার পাওয়া র্পাফিউমটা (আসলে চেয়ে নেওয়া) বগলে ফিচ্-ফিচ্ করে দিতে দিতে উত্তর দেয় শমী। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে সে। আদিবাসী জিহ্বা তো, জড়তা কাটতে চায় না। ‘ঠিক আছে ডার্লিং, আমি এক্ষুনি আসছি…’
আদিবাসী ভাষায় গালিটা দিতে পারলে ভাল লাগত। বাংলায় মন ভরে না। শহরে এসে কিছুটা ইংরেজী শিখেছে। 
‘ শালা বাস্টার্ড …’ মনে মনে কষে গাল দেয় সে। ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আয়নায় ঘুরে-ফিরে আর একবার নিজেকে দেখে নেয় শমী। বাধঁ ভাঙ্গা একটা দীর্ঘ-শ্বাস বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে। আজ যেখানে সে যাচ্ছে- তারা অনেক বড় লোক। স্ত্রী দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী। কখনো ইজি চেয়ারে সারাক্ষণ বসে থাকেন, কখনোবা জানালার গ্রীলটা ধরে বাইরে দূরের আকাশ দেখতে থাকেন। যেন কখনো তার জীবনে শাšিতর পরশ পায়নি; বিষাদ ভরা মুখ। অবশ্য শমীদের আদিবাসী মায়েরা এরকম অসুখ নিয়েও সারাদিন পরিশ্রম করে, স্বামী-সন্তানদের আহারের ব্যবস্থা করে। আর তার স্বামীটা আস্ত একটা বদমাশ। ক্ষুধার্ত শেয়াল কুকুরের মত সারাক্ষণ খাই খাই স্বভাব। উল−ুকটা আজ তার ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ীটা পাঠিয়ে দিলেই পারত- তা নয়, ঘন ঘন রিং দিচ্ছেন। ছোট লোক গরীব-দুঃখীদের দুঃখ-কষ্ট ওরা বুঝে না, বুঝতে চায় না। ওরা মনে করে কষ্টই যেন গরীবদের প্রাপ্য; না হলে- বড় লোকদের কাছে যেন অন্যায় করা হয়।
‘‘ ক্রুশের কাছে যাব যেন ক্ষমা পাই, মহাপাপীর তরেও সেথায় আছে ঠাঁই…’’ গীর্জার এই গানটা শুনে থমকে দাঁড়ায় শমী। গ্রামে থাকতে গানটা শুনে নি কখনও। ঢাকার গীর্জায় শুনেছে । আজ রবিবার। ঢাকা শহরে খ্রিষ্টান চাকুরী জীবিদের জন্য প্রত্যেক চার্চেই রবিবারে সন্ধ্যায় গীর্জার সুব্যবস্থা। আজকাল রবিবার কি সোমবার কিছুই মনে থাকে না শমীর। মনে পাপ নিয়ে সঠিকভাবে ধর্ম- কর্মে মন দেওয়া যায় না। গানটা শুনে মনটা কেমন কেমন করছে- ভেতরটা মোছর দিয়ে উঠছে। শাস্ত্র পাঠ হচ্ছে- 
‘‘তোমার হাত কিম্বা পা যদি তোমাকে পাপের পথে টানে তবে তা কেটে ফেলে দাও। দুই হাত ও দুই পা নিয়ে চিরকালের আগুনে পুড়বার চেয়ে বরং নুলা বা খোঁড়া হয়ে জীবনে ঢোকা তোমার পক্ষে ভাল । তোমার চোখ যদি তোমাকে পাপের পথে টানে তবে তা উপড়ে ফেলে দাও । দুই চোখ নিয়ে নরকের আগুনে পড়বার চেয়ে বরং কানা হয়ে জীবনে ঢোকা তোমার পক্ষে ভাল । 
…যা হারিয়ে গেছে তা উদ্ধার করবার জন্য মনুষ্যপুত্র এসেছেন । তোমরা কি মনে কর? ধর, একজন লোকের একশোটা ভেড়া আছে। সেগুলোর মধ্যে যদি একটা ভুল পথে চলে যায় তবে সে কি নিরানড়ববইটা পাহাড়ের ধারে রেখে সেই ভেড়াটা খুঁজতে যায় না? আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যদি সে সেটা পায় তবে যে নিরানব্বইটা ভুল পথে যায় নি, তাদের চেয়ে যেটা ভুল পথে চলে গিয়েছিল; তার জন্য সে আরও বেশী আনন্দ করে…” (মথি-১৮ঃ ০৮-১৩ পদ)।
বাইবেল ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে কানড়বায় ভেঙ্গে পড়ে শমী। হারিয়ে যাওয়া ভেড়া আর কেউ নয়; অনেকদিনের ভুল পথে যাওয়া শমী। সীমান্তে হারিয়ে যাওয়া – শমী। কিন্তু তার কীইবা উপায় ছিল। ভাল একটা কাজের সন্ধানে যেখানেই গেছে, সেখানে কোন কাজতো জোটেইনি; বরং অনেকটা অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ঢাকা শহরে এসে শমীর আসল পরিচয় যেমন ঢাকা পরে গেছে ঠিক তেমনি তার আজীবন লালিত সুখের স্বপড়ব, পৃথিবীর জন্য ভালবাসা, আশা-প্রত্যাশা সব কিছু শেষ হয়ে গেল। বান্ধবীর করুণায় অনেকদিন নির্লজ্জের মত খেয়েছে- পড়েছে; এ ভাবে আর কতদিন। বান্ধবীটির অনেক লোকের সাথে জানা পরিচয় আছে- তার হাত ধরেই কখন, কোথায় হারিয়ে গেছে শমী; নিজেও তা বুঝতে পারেনি। পেছনে প্রায় লেগে যাওয়া রিক্সার কলিং বেলের আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় শমী। বুঝতে পারে অনেক্ষণ ধরে সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। রিক্সা-ওয়ালার ঘাম মুছা মুখটা লাল হয়ে ঝক্-মক্ করছে। ডেব-ডেব করা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে শমীর দিকে।
‘আপা অনেক্ষণ ধইরা দাঁড়াইয়া আচেন, কোথাও যাইবেন-নি…? কোন উত্তর আসে না শমীর মুখথেকে। কানড়বায় নষ্ট হয়ে যাওয়া মেক্-আপটা মুছতে মুছতে রিক্সার হুডটা নামিয়ে উঠে পড়ে শমী। ক্রিং-ক্রিং; লক্কর-ঝক্কর আওয়াজ তুলে চলতে থাকে।
চলতে চলতে এক সময় রিক্সাটা অন্ধকার গলির ভেতর হারিয়ে যায়- সেই সাথে আদিবাসী শমী নিজেও …।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন