।।ফিডেল ডি সাংমা।।
.টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার চুনিয়া গ্রামে পিতা রায়চান নকরেক এবং মাতা দেঙা মৃ-এর কোলে ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে পরেশ চন্দ্র মৃ। মধুপুরের আদিবাসীদের বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্মের চেতনাতে জাগ্রত করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর সীমাহীন অবদানের জন্য এলাকাবাসী এই কিংবদন্তি মহাপুরুষ পরেশ চন্দ্র মৃ-কে আবিমানি “গারো রাজা” উপাধি দেওয়া হয়।
.
আজ ৭ই মার্চ, স্বর্গীয় আবিমানি গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের আয়োজনে এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় জলছত্রে খিম্মা সঙা (স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন) এবং স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে পরিবারের পক্ষথেকে পরেশ চন্দ্র মৃর জ্যৈষ্ঠ মিসেস মুকুল দারু, মেজো কন্যা শিশিলিয়া দারু এবং তাঁর স্বামী মিহির মৃসহ মোট ১৮টি সংগঠন, অঙ্গসংগঠনের নেতৃবর্গ এবং এলাকার অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন।
.
অনুষ্ঠান শুরু হয় জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে পরেশ চন্দ্র মৃ-র স্মরণে খিম্মা সঙা এবং তাঁর আত্মার জন্যে প্রার্থনার মাধ্যমে। অতঃপর জাউপ সভাকক্ষে সাধারণ সম্পাদক মিঃ থমাস চাম্বুগং-এর সঞ্চালনায় সংগঠনের সভাপতি মিঃ ইউজিন নকরেকের স্বাগতিক বক্তব্য প্রদান করা হয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠার বিবরণ কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৬২ সন এক ঐতিহাসিক বছর। সেই বছরে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করা ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ফাদার উয়াং এর পরামর্শ ও সহযোগিতায় একটি সংগঠন শুরু করেন। সেসময় এ সংগঠনের নাম ছিল “জলছত্র জয়েনশাহী আদিবাসী ঋণদান সমবায় সমিতি”; যা বর্তমানে “জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ” নামে সুপরিচিত।
.
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সহসভাপতি, আবিমানি গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ-র জ্যৈষ্ঠ কন্যা মিসেস মুকুল দারু তাঁর পিতার স্মৃতিচারণ শুনতে শুনতে উপস্থিত আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। মিসেস মুকুল দারু তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, তাঁর পিতার কিশোর বয়সথেকেই পরোপকারী, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকারী, সুসংগঠক, সংগ্রামী জীবনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। নিজে সুশিক্ষিত হয়ে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জাতি অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সকলকে শিক্ষিত হওয়ার বিকল্প তিনি ভাবতেই পারতেন না। মনোবল এবং প্রবল ইচ্ছা শক্তির অধিকারী। তাই সমাজ উন্নয়নের কাজের পাশাপাশি আদিবাসী সমাজের অন্যায় অত্যাচারের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই আজ তাঁদের পরিবার সকলেই প্রতিষ্ঠিত। তিনি তাঁর পিতাকে আবিমানি “গারো রাজা” উপাধি প্রদানের জন্য গারো জাতির কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন বলে জানালেন।
.
মিসেস মুকুল দারু আর বলেন, আমরা তাঁর তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বাবার আদর্শ শিক্ষায় আমার সকলেই মোটামুটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেছি খুবই উদার, বিনয়ী এবং নম্র। তিনি ছোট বেলাথেকে আমাদের শিখিয়েছেন ভালোমন্দ বিচার করার চেতনা। তিনি ভালোবাসতে শিখিয়েছেন সমাজকে, শিখিয়েছেন নিজস্ব জাতীকে নিয়ে গর্ব করতে, সুরক্ষা ও সংরক্ষন করতে শিখিয়েছেন নিজস্ব কৃষ্টি কালচারকে। বাবার মহান আদর্শকে অনুসরণ করে বর্তমানে আমরা সমাজে বিভিন্ন ভাবে অবদান রাখার প্রচেষ্টায় আছি।
১৯৪৫-১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে দেশে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বেঁধেছিল, তখন অনান্য হিন্দু পরিবারের মতো বঙ্কিমবাবুর পরিবারও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কলকাতায় চলে যাবার সময় পরেশ চন্দ্র মৃকেও সাথে নিয়ে যান এবং নারিকেল ডাঙ্গা হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। পরেশ চন্দ্র মৃ স্কুল জীবনে হিন্দু পরিবারে থাকার সুবাদে একাধারে যেমন হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ন, মহাভারত, গীতা ও বেদান্তর দর্শণ পড়াশুনা করেছেন, তেমনই মাওসেতুং, মেসিম গোর্কি, এঞ্জেলস ও হিটলার লেলিনথেকে শুরু করে জীবনীগ্রন্থথেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম চন্দ্র, শরৎচন্দ্র, ফালগুনীর গ্রন্থসহ অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা তিনি পড়াশোনা করেছেন। কলকাতায় বঙ্কিম বাবুর পরিবারে থাকার সময়ই তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতক্ষ্য করেছেন এবং সে বাড়ীতে অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদদের আনাগোনা ও সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে পরেশ চন্দ্র মৃ নিজেও নিজ আদিবাসী সমাজের দুরাবস্থার কথা ভাবতেন এবং কুশিক্ষা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এ সমাজকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন।
.
আচিক মিচিক সোসাইটি এবং জাউপ- শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদিকা, আদিবাসী নেত্রী মিসেস সুলেখা ম্রং তাঁর বক্তব্যে আদিবাসীদের পরিবার এবং সামাজিক জীবনে পরেশ চন্দ্র মৃর অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, আমাদের এ সমাজ নেতা শুধু সুশিক্ষিতই নন, তিনি একজন আদর্শ কৃষকও বটে। তখনকার সময়ে আদিবাসীদের জীবন নির্ভর করতো জুমচাষকে ভিত্তি করে। তিনি এলাকার গারো সমাজের ভবিষৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ইদিলপুর গ্রামের মিচি মৃ-র পরামর্শে আনারস, লেবু, লিচু, আম, কাঁঠাল ইত্যাদির চাষ নিজে শুরু করে অন্যদেরও উৎসাহিত করেন। অন্যদিকে পরেশ চন্দ্র মৃ চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত না হয়েও নিজ এলাকায় চিকিৎসক হিসাবেও সুপরিচিত ছিলেন। সে সময় এলাকায় কোন চিকিৎসক না থাকায় গ্রাম্য কবিরাজ ও দেবতার ভোগ ও পূজা ছাড়া আর গারো ও অনান্য আদিবাসীদের কোন ঔষধ সেবন ও নিরাময়ের অভিজ্ঞতা ছিলনা। ফলে ম্যালেরিয়া, কালাজর, কলেরা এবং ডায়রিয়ায় অনেক লোক মারা যেত। তাই তিনি নিজে হোমিওপ্যাথি ও এলোপ্যাথি চিকিৎসার বই কিনে এনে পড়াশোনা করে এলাকাবাসীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনি নিজেও অসুস্থ্য হলে ইনজেকশন নেওয়ার জন্য পরেশ বাবুর কাছে গিয়েছেন।
.
আদিবাসী কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের সভাপতি, আদিবাসী নেতা মি আন্তনী মাংসাং তাঁর বক্তব্যে পীরগাছা সেন্ট পল চার্চ এবং উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় স্বর্গীয় পরেশ চন্দ্র মৃর বিশেষ অবদানের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রেও সাংসারেক ধর্মাবলম্বী গারো সমাজটি পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এলাকার আদিবাসীদের শিক্ষার আলো প্রজ্জলিত রাখার প্রচেষ্টায় তিনি স্কুলের ও র্গীজার উন্নয়নের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান এবং এরই ফলসরূপ বর্তমান পীরগাছা গ্রামের বুকে স্বগৌরবে মাথাউচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট পল উচ্চবিদ্যালয় এবং পীরগাছা সেন্ট পল চার্চ। যেখানে আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে পারছে এবং সুন্দর ও সুষ্ঠু জাতি গঠনের জন্যে উপযুক্ত প্রজন্ম তৈরী হচ্ছে সাথে পাচ্ছে আধ্যাতিক গঠনের সুযোগ।
.
পরেশ চন্দ্র মৃ-র আদর্শে যোগ্য একনিষ্ঠ অনুসারী, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি এবং বর্তমান উপদেষ্টা, আদিবাসী নেতা মিঃ অজয় মৃ তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই মহান নেতা যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করতেন এবং আমাদেরকেও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিবাদ করতে শিখিয়ে গেছেন। তৎকালীন পাকিস্তান শাসনামলে, ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার আদিবাসীদের একমাত্র আয়ের উৎস ঝুমচাষ বন্ধ করে দেন। মধুপুরের আদিবাসীদের ভূমির ন্যায্য অধিকারের লড়াই এখান থেকেই শুরু। আবার ১৯৫৬ সনে সরকার মধুপুরের আদিবাসী অধ্যুসিত গ্রামের বনানঞ্চলগুলো ধনী ব্যবসায়ীদের নিলামে বিক্রি করে দিয়ে পুনরায় সেখানে এবং আদিবাসীদের বাগান ও আবাদি জমিতেও গজারী ও শাল বাগান শুরু করে। তখনও সরাসরি প্রতিবাদ করা হয়।
১৯৫৬ সনে আবারও আদিবাসীদের উপর আঘাত আসে। ১৯১২সন থেকে ১৯১৯ সন পর্যন্ত সিএসসি রেকর্ড করা আদবাসীদের পত্তনী জমিগুলো নটিফিকেশন করে খাস ঘোষনা করে ও বনবিভাগের আওতায় নিয়ে যায়। তখন বাবা আরো কয়েকজন আদিবাসী নেতাদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায় বসেন। এলাকার আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তার নেতৃতে সরকারের কাছে সকলে মিলে মৌখিক ও লিখিত ভাবে আপত্তি জানান। এভাবে সকল আদবাসী জমি তখনও সাময়িক রক্ষা পায়।
.
১৯৬১ সনে পাকিস্তান সরকার ঘোষনা দেন যে এলাকার ৪০বর্গ মাইল নিয়ে জাতীয় উদ্যান করা হবে এবং সমস্ত আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদ করা হবে। অর্থাৎ প্রায় ১৫টি গ্রাম এর এরিয়ার ভেতর পড়ে। আবারও পরেশ বাবুর নেতৃতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মধুপুরের আদিবাসীগন সরকারের কাছে প্রতিবাদ লিপি প্রদান করেন।
.
১৯৬২ সনে প্রথমে শুধু চুনিয়া গ্রামের আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদের পায়তারা করেছিল। পরেশ বাবুর নেতৃতে আদিবাসীদের প্রতিবাদ জোড়ালো হওয়ায় তারা এই নেতাকে পার্কের নির্ধারিত এলাকার বাইরে বা টাঙ্গাইল শহরে রাজকীয় বাড়ী, অথবা ক্ষতিপূরণবাবদ তাঁর চাহিদা অনুসারে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরেশ চন্দ্র মৃ জাতির অস্থিত্বকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সকল প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে উলটো জনগণকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি তখনই ঘোষণা দেন, “এই গ্রাম এবং এই বন ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না। আমরা বনের সন্তান, বন ছাড়া আমরা বাঁচতে পারবো না”।
এছাড়াও ১৯৬৭ সনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনায়েম খাঁনের আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং পুনর্বাসনের ঘোষনা, ১৯৬৮ সনে পুনরায় চুনিয়া গ্রাম উচ্ছেদ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের নোটিশ করা হয়েছিল। ১৯৭২ সনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মন্ত্রীপরিষদ নিয়ে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করার উদ্দেশে দোখলায় আসেন। তখনও শেখ মুজিব নিজেই ঘোষনা দিলেন আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদের। অবশেষে ১৯৮০সনে জিয়ার সামরিক শাসন আমলে সামরিক আইন অনুযায়ী আবার উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সবক্ষেত্রেই দৃঢ় মনোবলের অধিকারী বাবু পরেশ চন্দ্র মৃ এলাকার লোকজনদের সংগঠিত করে সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রতিবাদ লিপি পেশ করে সৎসাহস দেখিয়েছেন, সফল হয়েছেন। একারণেই তিনি গারো নেতা, একারণেই তিনি আবিমানি গারো রাজা।
.
উক্ত আলোচক ছাড়াও এ স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন আদিবাসী লেখক ও সমাজকর্মী মিঃ ফিডেল ডি সাংমা; কারিতাস ইআইপি, মাঠকর্মকর্তা মিস সূচনা রুরাম; আদিবাসী নেত্রী ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মিসেস যষ্টিনা নকরেক; কর্পোস খ্রীষ্টি উচ্চবিদ্যালয়ের সিলনিয়র শিক্ষিকা এবং জাউপ- মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা পিউ ফিলোমিনা ম্রং, আদিবাসী নেতা ও সমাজকর্মী মিঃ মাইকেল নকরেক, ইউপি মেম্বার মিঃ নিতেন নকরেক প্রমুখ।
.
উল্লেখ্য, চুনিয়া গ্রামের বাড়িতে গারোদের সামাজিক নিয়মানুসারে এবং খ্রীষ্টযাগ অর্পনের মাধ্যমে আবিমানি গারো রাজা স্বর্গীয় পরেশ চন্দ্র মৃর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
.টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার চুনিয়া গ্রামে পিতা রায়চান নকরেক এবং মাতা দেঙা মৃ-এর কোলে ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে পরেশ চন্দ্র মৃ। মধুপুরের আদিবাসীদের বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্মের চেতনাতে জাগ্রত করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর সীমাহীন অবদানের জন্য এলাকাবাসী এই কিংবদন্তি মহাপুরুষ পরেশ চন্দ্র মৃ-কে আবিমানি “গারো রাজা” উপাধি দেওয়া হয়।
.
আজ ৭ই মার্চ, স্বর্গীয় আবিমানি গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের আয়োজনে এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় জলছত্রে খিম্মা সঙা (স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন) এবং স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে পরিবারের পক্ষথেকে পরেশ চন্দ্র মৃর জ্যৈষ্ঠ মিসেস মুকুল দারু, মেজো কন্যা শিশিলিয়া দারু এবং তাঁর স্বামী মিহির মৃসহ মোট ১৮টি সংগঠন, অঙ্গসংগঠনের নেতৃবর্গ এবং এলাকার অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন।
.
অনুষ্ঠান শুরু হয় জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে পরেশ চন্দ্র মৃ-র স্মরণে খিম্মা সঙা এবং তাঁর আত্মার জন্যে প্রার্থনার মাধ্যমে। অতঃপর জাউপ সভাকক্ষে সাধারণ সম্পাদক মিঃ থমাস চাম্বুগং-এর সঞ্চালনায় সংগঠনের সভাপতি মিঃ ইউজিন নকরেকের স্বাগতিক বক্তব্য প্রদান করা হয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠার বিবরণ কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৬২ সন এক ঐতিহাসিক বছর। সেই বছরে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করা ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ফাদার উয়াং এর পরামর্শ ও সহযোগিতায় একটি সংগঠন শুরু করেন। সেসময় এ সংগঠনের নাম ছিল “জলছত্র জয়েনশাহী আদিবাসী ঋণদান সমবায় সমিতি”; যা বর্তমানে “জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ” নামে সুপরিচিত।
.
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সহসভাপতি, আবিমানি গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ-র জ্যৈষ্ঠ কন্যা মিসেস মুকুল দারু তাঁর পিতার স্মৃতিচারণ শুনতে শুনতে উপস্থিত আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। মিসেস মুকুল দারু তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, তাঁর পিতার কিশোর বয়সথেকেই পরোপকারী, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকারী, সুসংগঠক, সংগ্রামী জীবনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। নিজে সুশিক্ষিত হয়ে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জাতি অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সকলকে শিক্ষিত হওয়ার বিকল্প তিনি ভাবতেই পারতেন না। মনোবল এবং প্রবল ইচ্ছা শক্তির অধিকারী। তাই সমাজ উন্নয়নের কাজের পাশাপাশি আদিবাসী সমাজের অন্যায় অত্যাচারের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই আজ তাঁদের পরিবার সকলেই প্রতিষ্ঠিত। তিনি তাঁর পিতাকে আবিমানি “গারো রাজা” উপাধি প্রদানের জন্য গারো জাতির কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন বলে জানালেন।
.
মিসেস মুকুল দারু আর বলেন, আমরা তাঁর তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বাবার আদর্শ শিক্ষায় আমার সকলেই মোটামুটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেছি খুবই উদার, বিনয়ী এবং নম্র। তিনি ছোট বেলাথেকে আমাদের শিখিয়েছেন ভালোমন্দ বিচার করার চেতনা। তিনি ভালোবাসতে শিখিয়েছেন সমাজকে, শিখিয়েছেন নিজস্ব জাতীকে নিয়ে গর্ব করতে, সুরক্ষা ও সংরক্ষন করতে শিখিয়েছেন নিজস্ব কৃষ্টি কালচারকে। বাবার মহান আদর্শকে অনুসরণ করে বর্তমানে আমরা সমাজে বিভিন্ন ভাবে অবদান রাখার প্রচেষ্টায় আছি।
১৯৪৫-১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে দেশে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বেঁধেছিল, তখন অনান্য হিন্দু পরিবারের মতো বঙ্কিমবাবুর পরিবারও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কলকাতায় চলে যাবার সময় পরেশ চন্দ্র মৃকেও সাথে নিয়ে যান এবং নারিকেল ডাঙ্গা হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। পরেশ চন্দ্র মৃ স্কুল জীবনে হিন্দু পরিবারে থাকার সুবাদে একাধারে যেমন হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ন, মহাভারত, গীতা ও বেদান্তর দর্শণ পড়াশুনা করেছেন, তেমনই মাওসেতুং, মেসিম গোর্কি, এঞ্জেলস ও হিটলার লেলিনথেকে শুরু করে জীবনীগ্রন্থথেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম চন্দ্র, শরৎচন্দ্র, ফালগুনীর গ্রন্থসহ অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা তিনি পড়াশোনা করেছেন। কলকাতায় বঙ্কিম বাবুর পরিবারে থাকার সময়ই তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতক্ষ্য করেছেন এবং সে বাড়ীতে অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদদের আনাগোনা ও সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে পরেশ চন্দ্র মৃ নিজেও নিজ আদিবাসী সমাজের দুরাবস্থার কথা ভাবতেন এবং কুশিক্ষা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এ সমাজকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন।
.
আচিক মিচিক সোসাইটি এবং জাউপ- শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদিকা, আদিবাসী নেত্রী মিসেস সুলেখা ম্রং তাঁর বক্তব্যে আদিবাসীদের পরিবার এবং সামাজিক জীবনে পরেশ চন্দ্র মৃর অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, আমাদের এ সমাজ নেতা শুধু সুশিক্ষিতই নন, তিনি একজন আদর্শ কৃষকও বটে। তখনকার সময়ে আদিবাসীদের জীবন নির্ভর করতো জুমচাষকে ভিত্তি করে। তিনি এলাকার গারো সমাজের ভবিষৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ইদিলপুর গ্রামের মিচি মৃ-র পরামর্শে আনারস, লেবু, লিচু, আম, কাঁঠাল ইত্যাদির চাষ নিজে শুরু করে অন্যদেরও উৎসাহিত করেন। অন্যদিকে পরেশ চন্দ্র মৃ চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত না হয়েও নিজ এলাকায় চিকিৎসক হিসাবেও সুপরিচিত ছিলেন। সে সময় এলাকায় কোন চিকিৎসক না থাকায় গ্রাম্য কবিরাজ ও দেবতার ভোগ ও পূজা ছাড়া আর গারো ও অনান্য আদিবাসীদের কোন ঔষধ সেবন ও নিরাময়ের অভিজ্ঞতা ছিলনা। ফলে ম্যালেরিয়া, কালাজর, কলেরা এবং ডায়রিয়ায় অনেক লোক মারা যেত। তাই তিনি নিজে হোমিওপ্যাথি ও এলোপ্যাথি চিকিৎসার বই কিনে এনে পড়াশোনা করে এলাকাবাসীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনি নিজেও অসুস্থ্য হলে ইনজেকশন নেওয়ার জন্য পরেশ বাবুর কাছে গিয়েছেন।
.
আদিবাসী কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের সভাপতি, আদিবাসী নেতা মি আন্তনী মাংসাং তাঁর বক্তব্যে পীরগাছা সেন্ট পল চার্চ এবং উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় স্বর্গীয় পরেশ চন্দ্র মৃর বিশেষ অবদানের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রেও সাংসারেক ধর্মাবলম্বী গারো সমাজটি পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এলাকার আদিবাসীদের শিক্ষার আলো প্রজ্জলিত রাখার প্রচেষ্টায় তিনি স্কুলের ও র্গীজার উন্নয়নের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান এবং এরই ফলসরূপ বর্তমান পীরগাছা গ্রামের বুকে স্বগৌরবে মাথাউচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট পল উচ্চবিদ্যালয় এবং পীরগাছা সেন্ট পল চার্চ। যেখানে আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে পারছে এবং সুন্দর ও সুষ্ঠু জাতি গঠনের জন্যে উপযুক্ত প্রজন্ম তৈরী হচ্ছে সাথে পাচ্ছে আধ্যাতিক গঠনের সুযোগ।
.
পরেশ চন্দ্র মৃ-র আদর্শে যোগ্য একনিষ্ঠ অনুসারী, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি এবং বর্তমান উপদেষ্টা, আদিবাসী নেতা মিঃ অজয় মৃ তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই মহান নেতা যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করতেন এবং আমাদেরকেও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিবাদ করতে শিখিয়ে গেছেন। তৎকালীন পাকিস্তান শাসনামলে, ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার আদিবাসীদের একমাত্র আয়ের উৎস ঝুমচাষ বন্ধ করে দেন। মধুপুরের আদিবাসীদের ভূমির ন্যায্য অধিকারের লড়াই এখান থেকেই শুরু। আবার ১৯৫৬ সনে সরকার মধুপুরের আদিবাসী অধ্যুসিত গ্রামের বনানঞ্চলগুলো ধনী ব্যবসায়ীদের নিলামে বিক্রি করে দিয়ে পুনরায় সেখানে এবং আদিবাসীদের বাগান ও আবাদি জমিতেও গজারী ও শাল বাগান শুরু করে। তখনও সরাসরি প্রতিবাদ করা হয়।
১৯৫৬ সনে আবারও আদিবাসীদের উপর আঘাত আসে। ১৯১২সন থেকে ১৯১৯ সন পর্যন্ত সিএসসি রেকর্ড করা আদবাসীদের পত্তনী জমিগুলো নটিফিকেশন করে খাস ঘোষনা করে ও বনবিভাগের আওতায় নিয়ে যায়। তখন বাবা আরো কয়েকজন আদিবাসী নেতাদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায় বসেন। এলাকার আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তার নেতৃতে সরকারের কাছে সকলে মিলে মৌখিক ও লিখিত ভাবে আপত্তি জানান। এভাবে সকল আদবাসী জমি তখনও সাময়িক রক্ষা পায়।
.
১৯৬১ সনে পাকিস্তান সরকার ঘোষনা দেন যে এলাকার ৪০বর্গ মাইল নিয়ে জাতীয় উদ্যান করা হবে এবং সমস্ত আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদ করা হবে। অর্থাৎ প্রায় ১৫টি গ্রাম এর এরিয়ার ভেতর পড়ে। আবারও পরেশ বাবুর নেতৃতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মধুপুরের আদিবাসীগন সরকারের কাছে প্রতিবাদ লিপি প্রদান করেন।
.
১৯৬২ সনে প্রথমে শুধু চুনিয়া গ্রামের আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদের পায়তারা করেছিল। পরেশ বাবুর নেতৃতে আদিবাসীদের প্রতিবাদ জোড়ালো হওয়ায় তারা এই নেতাকে পার্কের নির্ধারিত এলাকার বাইরে বা টাঙ্গাইল শহরে রাজকীয় বাড়ী, অথবা ক্ষতিপূরণবাবদ তাঁর চাহিদা অনুসারে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরেশ চন্দ্র মৃ জাতির অস্থিত্বকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সকল প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে উলটো জনগণকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি তখনই ঘোষণা দেন, “এই গ্রাম এবং এই বন ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না। আমরা বনের সন্তান, বন ছাড়া আমরা বাঁচতে পারবো না”।
এছাড়াও ১৯৬৭ সনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনায়েম খাঁনের আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং পুনর্বাসনের ঘোষনা, ১৯৬৮ সনে পুনরায় চুনিয়া গ্রাম উচ্ছেদ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের নোটিশ করা হয়েছিল। ১৯৭২ সনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মন্ত্রীপরিষদ নিয়ে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করার উদ্দেশে দোখলায় আসেন। তখনও শেখ মুজিব নিজেই ঘোষনা দিলেন আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদের। অবশেষে ১৯৮০সনে জিয়ার সামরিক শাসন আমলে সামরিক আইন অনুযায়ী আবার উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সবক্ষেত্রেই দৃঢ় মনোবলের অধিকারী বাবু পরেশ চন্দ্র মৃ এলাকার লোকজনদের সংগঠিত করে সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রতিবাদ লিপি পেশ করে সৎসাহস দেখিয়েছেন, সফল হয়েছেন। একারণেই তিনি গারো নেতা, একারণেই তিনি আবিমানি গারো রাজা।
.
উক্ত আলোচক ছাড়াও এ স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন আদিবাসী লেখক ও সমাজকর্মী মিঃ ফিডেল ডি সাংমা; কারিতাস ইআইপি, মাঠকর্মকর্তা মিস সূচনা রুরাম; আদিবাসী নেত্রী ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মিসেস যষ্টিনা নকরেক; কর্পোস খ্রীষ্টি উচ্চবিদ্যালয়ের সিলনিয়র শিক্ষিকা এবং জাউপ- মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা পিউ ফিলোমিনা ম্রং, আদিবাসী নেতা ও সমাজকর্মী মিঃ মাইকেল নকরেক, ইউপি মেম্বার মিঃ নিতেন নকরেক প্রমুখ।
.
উল্লেখ্য, চুনিয়া গ্রামের বাড়িতে গারোদের সামাজিক নিয়মানুসারে এবং খ্রীষ্টযাগ অর্পনের মাধ্যমে আবিমানি গারো রাজা স্বর্গীয় পরেশ চন্দ্র মৃর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন