দৃষ্টিপাতঃ ৩, সকল ধর্মেই শান্তি আর স্বর্গের টোপ(প্লিজ, না পড়ে লাইক দিবেন না।)
“টাঙ্গাইলে হিন্দু পরিবারের আট সদস্যের ইসলাম গ্রহণ”- শিরোনামে খবরটি প্রথমবার পড়েছি ২ মার্চ/১৫ রাতে। আজ ১৫ মার্চ, আবার হঠাৎ করে অনলাইন নিউজগুলোতে প্রচারের হিড়িক পড়েছে। এ নিউজটি পড়ে যারা ধন্য ধন্য গাইছেন, হিপহিপ হুররে করছেন, তাঁদের দেখে আমার একটু একটু হিংসা হচ্ছে। কারণ সংখ্যাগুরু ইসলামথেকেও এরকম দুয়েকজন ধর্মান্তর হয়, কিন্তু তা নিউজে আসে না, আনা যায় না; তাই প্রচারও হয় না। কারণ এসব নিউজে আসলে আপনাদের মত আবেগপ্রবণ মানুষের রোষানলে পড়তে হবে- তা না বললেও আপনারাই বুঝবেন। তাই, এসব চিল্লাচিল্লি বাদ দিয়ে উক্ত পরিবারের কাছে গিয়ে দেখুন এ ঘটনার অভ্যন্তরে আরো কোন ঘটনা রয়েছে কিনা। আর শুধু এই পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বলছি না। কেউ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মটাকে ভালোবেসে, স্বর্গীয় সুখ-শান্তির আশায় ইসলাম বা যেকোন ধর্মে ধর্মান্তর হয়ে থাকেন, তাহলে সকলেরই তাঁদের এ ইচ্ছা এবং মূল্যবোধকে সম্মান জানানো উচিত বলে মনে করি।
শুধু এদেশের কথা বলছি না। পৃথিবীর সকল সংখ্যালঘুরা সবসময়ই চাপের মধ্যে থাকে। অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে, মেয়ে-ছেলের নিরাপত্তার আশায়, ক্ষুধার যন্ত্রনা এবং সামান্য মাথা গোঁজার ঠাই পাওয়ার আশায় অনেকেই স্বধর্ম ত্যাগ করে সংখ্যাগুরুদের ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে, হচ্ছে- এমন নজির পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। আমার ধারণা এ ঋষি পরিবারের ধর্মান্তরের ঘটনাটিও সেরকম কিছু হয়ে থাকতে পারে। আবার নাও হতে পারে, তবে আমার অনুমানের পেছনে নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি কারণ, উদাহারণ আমি পেশ করছি-
১) পারিবারিক পরিবেশথেকে চাপঃ আমার নানী গারোদের আদিধর্ম সাংসারেক-এর অনুসারী ছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, কলেরায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমার নানীরা (ওরা ৩ বোন) এতিম অবস্থায় খ্রীষ্টান মিশনারিদের সহায়তা পেতে পেতে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হলেন। কিন্তু নানীর জীবিত একমাত্র মামা অনেক আগেথেকেই হিন্দু/সনাতন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। আমার নানী বড় হতেই তাঁর মামার বদৌলতে এক সাংসারেক ছেলে(নানা)কে ধর্মান্তর করে বিয়ে দিতে গিয়ে নিজ ধর্মমতে অর্থাৎ হিন্দুমতে বিয়ে দিলেন। তখনথেকেই নানা-নানীর পরিবার সকলেই হিন্দু ধর্ম পালন করতেন। নানীর ধর্মান্তরের কাহিনী যদিও এটি, কিন্তু পিছিয়ে পড়া লোকসমাজে এরকম ধর্মান্তরের কাহিনী হয়তো বহুবিধ।
২) সামাজিক পরিবেশঃ আমার মা-মামারা বড় হতে হতে খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার বেড়ে গেছে। এদিকে গারো হিন্দু পরিবার কম থাকায় উপযুক্ত হিন্দু পাত্র না পাওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে মাকে খ্রীষ্টান পাত্রের সাথে খ্রীষ্টধর্ম মতে বিয়ে দিতে হলো। মায়ের আরো ৫ বোন আর ১ ভায়ের মধ্যে ১ বোন ছাড়া সবাই এখন খ্রীষ্টান। গারো মেয়েদের স্বামীর ঘরে চলে যাওয়াটা ছিলো গারো রীতির পরিপন্থি। তাই হিন্দু ধর্মমতে বিয়ে করায় সেই মাসীকে স্বামীর ঘরে চলে যেতে হলো। অর্থাৎ গারো হয়েও মাসী মায়ের ঘরে থাকতে পারলেন না। আমি বলতে চাইছি, বাধ্য হয়ে নানীকে খ্রীষ্টান মেয়ের সাথে থাকতে হলো। কিন্তু এই নানী তাঁর শেষ বয়সে আর হিন্দু ধর্মে থাকতে পারলেন না। খ্রীষ্ট ধর্ম পুনরায় গ্রহণ করলেন তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে। মৃত্যুর আগে তিনি বললেন, সবাই খ্রীষ্টান হয়ে গেছে, আমি একা হিন্দু থেকে কি করবো?
অন্যদিকে, ৯১-এ দেখলাম, “খ্রীষ্টাব্দ” নামের পত্রিকা নিয়ে কিছু হিন্দু এবং মুসলিম যুবক ঘোরাফেরা করছেন, পরে জানলাম এরা খ্রীষ্টান হয়েছেন। কারণ একটাই, অভাব। পরে নিজেদের খ্রীষ্টান দেখিয়ে খ্রীষ্টাব্দ সংস্থায় চাকরী পেয়েছেন। কিন্তু বিগত কয়েক সপ্তাহ আগে শুনলাম, নিজ এলাকায় নও খ্রীষ্টিয়ান সমাজে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী না পাওয়ায় তাঁদের সন্তানদের হিন্দুরা হিন্দু সমাজে এবং এবং মুসলিমরা মুসলিম সমাজে বিয়ে করিয়েছেন, আর নিজেরাও আবার আগের (হিন্দু ও মুসলিম) ধর্ম পালন করছেন। এলাকার বৃহত্তর খ্রীষ্টান সমাজ আদিবাসী সমাজ হওয়ায় এবং সংস্কৃতির কারণে এই অ-আদিবাসীদের বিয়ে-শাদীর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে নি।
৩) দারিদ্রতাঃ টাঙ্গাইলের মধুপুরথেকে বাসে করে ময়মনসিংহ যাচ্ছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম- দারিদ্রপূর্ণ টেলকী নামক গারো আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে বেশ কিছু ছোট ছোট টিনের ঘর চকচক করছে। ভাবলাম, বেশ! কিন্তু আরো বেশ কিছুদিন পর একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো, তাতে লেখা “নও মুসলিম...”; তারও কিছুদিন পর দেখলাম একটা জামে মসজিদ তৈরী হচ্ছে। অবশেষে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো- “ইসলামী ফাউণ্ডেশন” কর্তৃক যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাদের একটা করে টিনের ঘর, আর কিছু টাকা-পয়সা দিয়েছে। যারা মধুপুরথেকে বাসে করে ময়মনসিংহ গেছেন, তারা নিশ্চয়ই বনের মাঝখানে টেলকী নামক গ্রামে, রাস্তার পাশেই একটা মসজিদ এবং সাইনবোর্ড দেখে থাকবেন। এরকম উদাহারণ আরো দেওয়া যায়, ১৯৭৯-এ বয়’জ হোস্টেলে থাকার সময় একদিন দেখলাম, ফাঃ হোমরিক একজন যুবককে তাড়া করে গেইট পার করছেন। কারণ জানলাম, পরিবারের একমাত্র ছেলে চাকরী জুটাতে না পেরে মিশনে চাকরির আশায় খ্রীষ্টান হতে চেয়েছেন। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, সমাজ যাদের সহযোগিতায় আসে না, তাঁদের অনেকেই ধর্মান্তরের পথটিকে বেছে নিতে বাধ্য হয়।
৪) নিরাপত্তাহীনতাঃ ৭১-এর স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় হিন্দুদের পরিবারে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের কথা নাইবা বললাম। এদেশে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে সংখ্যালঘু হওয়ায় এলাকার সংখ্যাগুরু লোকদের দ্বারা বিভিন্নভাবে সম্পদ শোষণ ও নির্যাতনের ইতিহাস যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। একই কারণে বখাটেরা মেয়েকে উত্যক্ত করে, বিয়ের সমন্ধ আসললেও বখাটেরা বাঁধা দিয়ে, এমনকী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের হুমকী ইত্যাদির কারণে দিশাহারা এসব সংখ্যালঘুরা। এদেশের প্রায় সকল সংখ্যালঘু আদিবাসীদের সমাজথেকে মেয়েদের বিয়ের প্রলোভন, প্রেম ও বিয়ের কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কাহিনীও অতি পুরানো খবর। ফলে এসব সংখ্যালঘুরা বৃহত্তর সমাজে মিশে যাবার জন্য কৌশল হিসাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কাহিনী কতবার খবরের কাগজে পড়েছি, সে সংখ্যা আজ আর মনে নাই।
অন্যদিকে সংখ্যালঘু হওয়ায় নিজধর্ম পালনের পরিবেশ না পাওয়া এবং ধর্ম পালনে বাঁধাপ্রাপ্ত হতে হতে নিজের ধর্মের প্রতি আস্থা, ভক্তি কমে যেতে পারে- ফলশ্রুতিতে ধর্মান্তর করা খুবই সহজ এবং সফল কর্ম।
শেষ কথাঃ উপরোক্ত কারণ ভেবে আপনাদের মতো আমি কোন পক্ষেই ধন্য ধন্য গাইতে, হিপ-হিপ হুররে করতে পারি না। একই জাতের ফুল দিয়ে যেমন একটি ফুলের বাগানের সৌন্দর্য পূর্ণাঙ্গ হয় না, তেমনই কোন দেশ ও সমাজও নয়। বরং বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতির সহাবস্থানেই যে কোন সমাজ ও দেশ সুন্দর এবং ভাতৃত্বপূর্ণ হয়। সকল ধর্মেই শান্তি আর স্বর্গের টোপ দেওয়া থাকে; সুতরাং ধর্ম যার যেটা ভালো লাগে, সে সেটাই করুক। আমিও তাই করছি।
আমি সত্যিই বলছি, আপনাদের মতো এতোটা ধর্মভীরু বা ধার্মিক ব্যক্তি নই আমি। আমার ভালো কাজ, চিন্তা যেটুকুই করি, তা ধর্ম বা বেহেস্তের লোভে করি না; মানসিক প্রশান্তির জন্য করি, মানুষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করি...
।।ফিডেলডিসাংমা।। ১৫মার্চ,২০১৫।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন